তিনিই আঁকেন নোবেলজয়ীদের পোর্ট্রেট

২০২০ সালের নোবেলজয়ীদের পোর্ট্রেটের সঙ্গে শিল্পী নিকলাস এলমেহেদ

সুইডেনের স্টকহোমে একে একে নোবেলজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়, আর পর্দায় ভেসে ওঠে তাঁদের পোর্ট্রেট। কালো আউটলাইনে সোনালি রাংতা দিয়ে এই পোর্ট্রেটগুলো আঁকেন নিকলাস এলমেহেদ। সে কারণেই অক্টোবর মাসটা নিকলাসের জন্য আলাদা। পর্দার আড়ালে থাকলেও অত্যন্ত ব্যস্ততায় কাটে তাঁর সময়। এ বছর নোবেলের মৌসুম শেষ হলে ই-মেইল করেছিলাম নিকলাসের কাছে। খানিক বিরতিতে জবাব এল, ‘বলো, কী জানতে চাও?’ জানতে চাইলাম, যে নোবেলজয়ীদের নাম জানতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকে বিশ্ব, নিকলাস কি তা আগেভাগেই জেনে যান?

সাক্ষাৎকার পর্বে যাচ্ছি। তবে তার আগে নিকলাস সম্পর্কে দুটো কথা জানিয়ে রাখি। সুইডেনে বাড়ি এই শিল্পীর। স্ত্রী-সন্তানসহ ওখানেই থাকেন। ২০১২ সালে শিল্পনির্দেশক হিসেবে নোবেল মিডিয়াতে যোগ দেন। সে সময় বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে নোবেলজয়ীদের সবার ভালো ছবি পাওয়া যেত না। ঠিক হলো, ইন্টারনেট ঘেঁটে যাঁদের ছবি মিলবে না, নিকলাস আঁকবেন তাঁদের ছবি।

২০১৪ সালে নোবেল মিডিয়ার চাকরি ছেড়ে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ শুরু করলেন। তবে নোবেলজয়ীদের ছবি আঁকার কাজটা তাঁরই থাকল। সেবার সব নোবেলজয়ীর বেলায় একই নিয়ম প্রযোজ্য হলো, সবার ছবি আঁকতে শুরু করেন নিকলাস। সে নিয়মই এখনো চলছে।

২০২০ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেলজয়ী স্যার রজার পেনরোজের পোর্ট্রেট আঁকছেন নিকলাস। বিশেষ আঠার সাহায্যে পোর্ট্রেটে সোনালি রাংতা লাগান তিনি
ফেসবুক থেকে
প্রশ্ন:

নোবেলজয়ীদের পোর্ট্রেটগুলোতে মোটা কালো দাগের সঙ্গে থাকে সোনালি রাংতা। এই ধাঁচে আঁকেন কেন?

নিকলাস: পোর্ট্রেটগুলো এভাবে আঁকার একটা কারণ ব্রেকিং নিউজের আবহ দেওয়া। বলিষ্ঠ ভিজ্যুয়াল ইমপ্রেশন তৈরির চেষ্টা থাকে। ২০১৭ সালে গ্রাফিক-সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত নেয় নোবেল প্রাইজ কমিটি। ঠিক করা হয়, নোবেল পুরস্কার ঘোষণার মূল রং হবে সোনালি। তবে একরঙা সোনালি নয়, হয়তো সোনালি টেক্সচার।

২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পোর্ট্রেটগুলোতে আমি কালোর সঙ্গে নীল আর হলুদ রং ব্যবহার করতাম। ২০১৭ সালে এসে সোনালির সঙ্গে মানিয়ে পোর্ট্রেট আঁকার কথা বলা হলো। অনেক ধরনের সোনালি রং দিয়ে পরীক্ষা করে দেখেছি। রাংতাটাই মনে ধরল। অত্যন্ত পাতলা এই রাংতা বিশেষ আঠার সাহায্যে ছবিতে লাগিয়ে দিতে হয়। সাদা পটে কালো আউটলাইনের সঙ্গে সোনালি রাংতা—আমার মনে হয় এটার একটা আবেদন আছে।

প্রশ্ন:

তা তো আছেই। আপনার আঁকা পোর্ট্রেটগুলো তো নোবেল মিডিয়ার সদর দপ্তরের দেয়ালে রাখা আছে। কোনো নোবেলজয়ী কি তাঁর পোর্ট্রেট সম্পর্কে কখনো প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন?

নিকলাস: সত্যি বলতে আমি কখনো নোবেলজয়ীদের কাছ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া পাইনি। আমার মনে হয়, তাঁরা নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর খুব ব্যস্ত থাকেন।

এবার সাহিত্যে নোবেলজয়ী মার্কিন কবি লুইজ গ্লুইকের পোর্ট্রেট আঁকার পর নিকলাস এলমেহেদ
প্রশ্ন:

নোবেলজয়ীদের কোন পোর্ট্রেটটি আপনার সবচেয়ে পছন্দের?

নিকলাস: এবারের কথা বলছেন? এ বছর লম্বা চুলের পোর্ট্রেট করেছি বেশ কজনের। ভালো লেগেছে। একটা যদি নির্বাচন করতেই হয় তবে লুইজ গ্লুকের পোর্ট্রেটের কথা বলব। লম্বা চুলের ছাঁটের সঙ্গে তাঁর গাল ও মুখমণ্ডলের রেখা দারুণ।

প্রশ্ন:

২০১২ সালে নোবেল মিডিয়ায় যোগ দেওয়ার দুই বছর পর সে চাকরি ছেড়ে দিয়ে আবার তাদের জন্য ফ্রিল্যান্স শিল্পী হিসেবে কাজ শুরু করলেন। সেটা কেন? নোবেলজয়ীদের ছবি আঁকার বাইরে আপনি আর কী করেন?

নিকলাস: অর্ধেক সময় আমি অন্যান্য প্রকল্পে কাজ করি। বাকি সময়গুলোতে নোবেল মিডিয়ার মতো আমার অন্যান্য যে ক্লায়েন্ট আছে, তাদের জন্য ভিজ্যুয়াল কনটেন্ট তৈরি করি। যেমন সুইডেনের জাতীয় ফুটবল দলের (নারী ও পুরুষ) জন্য মোশন গ্রাফিকসের নকশা করি।

প্রশ্ন:

এমন কেউ কি আছেন, নোবেলজয়ী হিসেবে যার পোর্ট্রেট আঁকতে চান?

নিকলাস: হ্যাঁ, বেশ কয়েকজন আছেন, নোবেলজয়ী হিসেবে যাঁদের পোর্ট্রেট আমি আঁকতে চাই। তবে নামগুলো বলতে চাই না। বলে দিলে লোকে ভাববে আমি হয়তো পরবর্তী সম্ভাব্য নোবেলজয়ীদের সম্পর্কে তথ্য জেনে গেছি।

অনুশীলনের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পোর্ট্রেট এঁকেছিলেন তিনি
ফেসবুক থেকে
প্রশ্ন:

তা বটে। বাংলাদেশিদের মধ্যে শেষবার নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেটা ২০০৬ সালে। আপনি তখনো নোবেল মিডিয়ার জন্য কাজ শুরু করেননি। তবে দেখছি, আপনি রবীন্দ্রনাথের পোর্ট্রেট এঁকেছেন। কেন এঁকেছিলেন?

নিকলাস: নতুন ধাঁচে পোর্ট্রেট আঁকার অনুশীলনের জন্য আমি আগের অনেক নোবেলজয়ীর ছবি এঁকেছি। যেমন মারি কুরি, আইনস্টাইন কিংবা মারটিন লুথার কিং। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো কিংবদন্তির মুখাবয়বের বিশেষত্ব আমার খুব ভালো লাগে। স্টকহোমের নোবেল মিউজিয়ামে আমি তাঁর পুরোনো সাদাকালো ভিডিও দেখেছি। সত্যিই তাঁর চরিত্রে বিশেষত্ব আছে।

প্রশ্ন:

আপনি যদি নোবেল জেতেন তো নিজের পোর্ট্রেট কি নিজেই আঁকবেন?

নিকলাস: তেমনটাই তো হওয়ার কথা। অন্তত যতক্ষণ নোবেলজয়ীদের আঁকার কাজটা আমার। তবে প্রশ্ন হলো, কোন বিভাগে সে সাফল্য আমার কাছে ধরা দেবে।

প্রশ্ন:

নিজের সম্পর্কে কী বলবেন?

নিকলাস: তেমন কিছু না। খেলাধুলা আমার খুব পছন্দের। সপ্তাহে বেশ কয়েক দিন আমি ফ্লোরবল, ফুটবল আর কিকবক্সিং অনুশীলন করি। বিয়ে করেছি। তিন সন্তান আছে। এই তো।

প্রশ্ন:

আসল প্রশ্নটাই করা হলো না। মূল ঘোষণার কতক্ষণ আগে আপনাকে নোবেলজয়ীদের নাম জানানো হয়?

নিকলাস: নোবেল প্রাইজ কমিটির পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞা থাকায় আমি তা বলতে পারছি না, দুঃখিত। তবে আমাকে খুব দ্রুত কাজ করে একেকটা পোর্ট্রেট শেষ করতে হয়। বড়জোর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে।

নিকলাস এলমেহেদের অন্য কাজগুলো দেখা যাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর প্রোফাইলে, সেটা হোক ফেসবুক কিংবা ইনস্টাগ্রামে