তিস্তা ও রঙ্গিত যেভাবে পাশাপাশি বয়ে যেতে লাগল

পৃথিবীর তৃতীয় সর্বোচ্চ পর্বতচূড়া কাঞ্চনজঙ্ঘার কোলের কাছে ছোট্ট রাজ্য সিকিম। ‘সিকিম’ অর্থ নতুন বাড়ি। রাজ্যটির অপর নাম দেনজং, যার অর্থ লুকানো ধানখেত। রাজ্যটি বহুদিন বাইরের পৃথিবীর কাছে অচেনাই ছিল। সিকিম খুব সুন্দর। তিন দিকে পাহাড় ঘিরে আছে। উত্তরে বরফঢাকা সুউচ্চ পর্বতচূড়া, অসংখ্য ঝরনা, অজস্র পাখি, রংবেরঙের প্রজাপতি, বিচিত্র অর্কিড আর বাহারি ফুলের মেলা। বসন্তকালে ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় উপত্যকা। ফুলের সমারোহের জন্য সিকিমকে বলা হয় হিমালয়ের উদ্যান। পুব দিকে ভুটান আর পশ্চিমে নেপাল। ৭ হাজার ৯৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনে বাস করে মাত্র ৬ লাখ ১০ হাজার মানুষ। সিকিমের আদিবাসী লেপচারা একসময় এসেছিল আসাম থেকে। পরে নেপালি ও ভুটিয়ারা আসে নেপাল ও ভুটান থেকে। প্রাচীন ও দীর্ঘদিনের স্বাধীন সিকিম ১৯৭৫ সালে পরিণত হয় ভারতের ২২তম রাজ্যে। সিকিমের বরফগলা জলরাশি ঝরনা ও জলপ্রপাত হয়ে উপত্যকায় নেমে হয়েছে তিস্তা নদী ও রঙ্গিত নদ। তিস্তা নেমেছে সোজা পথে। রঙ্গিত এঁকেবেঁকে, পথে পথে মোচড় খেয়ে। সব পাহাড়ি ও আদিবাসীদের মতো সিকিমের আদি বাসিন্দা লেপচাদের মধ্যে প্রচলিত আছে নানা উপকথা। এই দুই নদ–নদী নিয়েও আছে মজার এক গল্প...

ভারতের কালিম্পং-দার্জিলিং রোডে লাভার্স মিট ভিউ পয়েন্টে দাঁড়ালে দেখা যায়, তিস্তা ও রঙ্গিত পাশাপাশি বয়ে যাচ্ছে
সংগৃহীত

একসময় হিমালয়ের কোলে সুখে–শান্তিতে বাস করত দুই নদ–নদী। নদীটির নাম তিস্তা আর নদের নাম রঙ্গিত। একদিন রঙ্গিত তিস্তাকে বলল, তারা আলাদা পথে সমতলে নামবে। দেখা যাবে কে আগে পৌঁছায়। প্রস্তাবে রাজি হলো তিস্তা। ঠিক হলো, একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য দুই নদীই পথপ্রদর্শক নেবে। তিস্তা তার পথপ্রদর্শক হিসেবে একটা সাপ বেছে নিল। রঙ্গিত পছন্দ করল পাখি। সে ভাবল, পাখিই আগে পৌঁছাবে।

একদিন একই সঙ্গে দুই নদী যাত্রা শুরু করল। শুরু হলো প্রতিযোগিতা। ডানে-বাঁয়ে না তাকিয়ে তিস্তা তার পথপ্রদর্শক সাপকে অনুসরণ করে সোজা চলতে লাগল। পাখিটি ছিল নিষ্কর্মা। যেতে যেতে সে একসময় বলল, ‘ওই দেখা যাচ্ছে একটা সুন্দর পোকা!’ ব্যস, পোকা ধরতে সেদিকে ছুটতে লাগল সে। রঙ্গিত বিরক্ত হয়ে বলল, ‘আমি এখন প্রতিযোগিতায় আছি। আর তুমি কিনা...!’

পাখিটা মুখ ভেংচে বলল, ‘উড়তে হলে তো খেতে হবে। না খেয়ে কি ওড়া যায়?’ বলেই সে দূরের পাকা শস্যখেত দেখে উড়াল দিল। বেচারা রঙ্গিত ছুটল তার পিছু পিছু। পাখির পেছনে ছুটতে ছুটতে তাকে বারবার বাঁক নিতে হয়। এভাবে ছুটতে ছুটতে রঙ্গিত একটি খাড়া পাড় থেকে লাফিয়ে নামতে যাবে, তখন দেখে, দূরে তিস্তা তার জন্য অপেক্ষা করছে। দেখে তো সে লজ্জায় মরে যায়। কারণ, সে হেরে গেছে। রঙ্গিত ভাবল, মানুষের কাছে সে মুখ দেখাবে কী করে! পরাজয়ের গ্লানি থেকে তার মনে জন্ম নিল ক্রোধ। ভীষণ রেগেমেগে সে সমতলে নেমেই পাগলের মতো ছুটল। বন্যা হয়ে বাড়িঘর ভাসিয়ে দিল আর গাছপালা।

রঙ্গিতের কর্মকাণ্ড দেখে তিস্তা ভয়ে চিৎকার করল, ‘থামো থামো! লক্ষ্মী রঙ্গিত, আমি জানি, তোমার কোনো দোষ নেই। সব দোষ ওই পাখিটির। দয়া করে তুমি শান্ত হও। নিরীহ বেচারিদের আর ক্ষতি কোরো না।’

রঙ্গিত তার কথা শুনে শান্ত হলো। তারপর দুই নদ–নদী একসঙ্গে ছুটে চলল সমতল ধরে।

কালিম্পং-দার্জিলিং রোডে লাভার্স মিট ভিউ পয়েন্ট বলে একটা জায়গা আছে। সেখানে দাঁড়ালে দেখা যায়, দুই নদ–নদী পাশাপাশি বয়ে যাচ্ছে।

লেপচারা এখনো এই দুই নদ–নদীর মিলনস্থানকে পবিত্র ভূমি বলে মনে করে। প্রতিবছর মাঘ মাসে আয়োজন করে উৎসবের। অনেক দূর থেকে সেখানে ছুটে যায় লেপচা নারী ও পুরুষের দল। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নদীতে ডুব দিয়ে উঠে শুরু করে নাচ–গান।

জর্জ কত্তুরানের ফোক টেলস অব সিকিম বই অবলম্বনে ইশতিয়াক আলম