‘তুই’ কি ‘আমারে’ চেনে?

কোলাজ: একটু থামুন

তুই চিনস আমারে?—এটি এ দেশের একটি বহুল প্রচারিত ও প্রচলিত সংলাপ। বাংলাদেশে জন্মে এবং এখানকার রূপ–রস–গন্ধে বড় হয়ে ওঠা প্রতিটি মানবসন্তান কখনো না কখনো এই সংলাপ হয় আওরেছে, নয় শুনেছে। কিন্তু সব সময় কি ‘আমারে’ চিনতে পারে ‘তুই’? নাকি ‘তুই’–কে চেনাতে নিজের পরিচয় নিজেই দেয় ‘আমারে’?

এই অঞ্চলে সবাই রাজা হতে চায়। ক্ষমতা একটি অত্যন্ত লোভনীয় চকলেট। সেই লেবেঞ্চুষের স্বাদ নিতে সবাই উদ্‌গ্রীব থাকে, সবাই। ঠিক যেমনটা খাঁ খাঁ মরুভূমির মতো ফাঁকা রাস্তায় যান পেতেও আমাদের আকাঙ্ক্ষা থাকে চরম পর্যায়ে। যান পাওয়ার পর কখনো যদি ভাড়াটে চালক মুখ বেঁকিয়ে বলে দেন, ‘যামু না’, তবে অনেক সীমিত পরিসরের ভদ্র ব্যক্তি রাগে–দুঃখে বলে উঠতে পারেন, তুই চিনস আমারে?

এ ক্ষেত্রে এই সংলাপ মুখ থেকে নিঃসৃত হওয়ার পেছনে মূল বিষয়টি থাকে, নিজেকে উত্তমরূপে চেনানো। অন্তত শাব্দিকভাবে সেটাই বোঝা যায়। এটি স্বাভাবিক। কারও তো আর মুখে পরিচয় লেখা থাকে না। ফলে জানানোটা কোনো খারাপ কাজ নয়। কিন্তু কেন জানি এই চেনানোর কাজটি করতে গেলেই শুরু হয়ে যায় হুজ্জত।

আমরা অচেনাকে চিনতে চাই না সহজে। অচেনা যখনই নিজেকে চেনানোর কাজটা শুরু করে, অর্থাৎ শুরুতে প্রশ্নটা করে তখনই আমরা বিগড়ে যাই। অন্যকে চেনার বদলে নিজেদের পরিচয় দিতে শুরু করি। শুরু হয়ে যায় নিজেদের পরিচয় জানানোর উৎসব। সেখানে অন্যকে চেনার বা জানার কোনো অনুসন্ধিৎসা দেখা যায় না। সবাই বলতে থাকে—‘তুই চিনস আমারে?’

কিন্তু অন্যকে ‘আপনি’ বলে সম্মান দেখাতে আমরা ততটা তৎপর নই কখনোই। তাই ‘তুই’–এর রাজত্বে ‘আপনি’ হারিয়ে যায় বেমালুম। আর সবাই সবাইকে ভুরু কুঁচকে বলতে থাকে, ‘দোষী তুই তুই তুই তুই…’!

তবে কি আমাদের গণহারে সোশ্যাল অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার হলো? তেমনটা হলে নতুন বা অপরিচিত মানুষের সঙ্গে পরিচিত হতে মানসিকভাবে বেশ সমস্যা হয়, অনেকেই অপরিচিতকে পরিচিত বানাতে চান না। আর আমাদের ক্ষেত্রে তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে হয়তো বাদানুবাদ শুরু হয়। আমরা তখন শুধু নিজেদের পরিচয়ই দিয়ে যাই। ‘আমারে’ ও ‘তুই’—এই দুই পক্ষই একে–অন্যকে তখন তুই–তোকারি করতে থাকে।

‘তুই’ বা বাংলা ব্যাকরণ অনুযায়ী মধ্যম পুরুষের তুচ্ছার্থক ব্যবহারে অবশ্য এ অঞ্চলের সব হোমোসেপিয়েন্স বরাবরই পটু। আর সেটি যখন নিজেকে চেনানোর বিষয়ে ব্যবহার হয়, তখন তা অত্যন্ত আগ্রাসী হিসেবে দেখা দেয়। বন্ধু বা স্বজনদের ডাকা ‘তুই’ আর তা থাকে না। একবার ভেবে দেখুন। তুই চিনস আমারে না বলে যদি নরম সুরে মুখে একটু হাসি ঝুলিয়ে বলা যেত, ‘আপনি কি আমাকে চেনেন?’—তবেই কিন্তু সব সমস্যার সমাধান অনেকাংশে হয়ে যেত।

কিন্তু অন্যকে ‘আপনি’ বলে সম্মান দেখাতে আমরা ততটা তৎপর নই কখনোই। তাই ‘তুই’–এর রাজত্বে ‘আপনি’ হারিয়ে যায় বেমালুম। আর সবাই সবাইকে ভুরু কুঁচকে বলতে থাকে, ‘দোষী তুই তুই তুই তুই…’!

পরিতাপের বিষয় হলো, দিন শেষে ‘আমারে’কে আর চেনাই হয় না ‘তুই’–এর। তাদের মধ্যে কোনো সখ্য গড়ে ওঠে না। কেউ কারও বন্ধু হয় না, হয়ে ওঠে না স্বজন। ‘আমারে’ ও ‘তুই’—দুই পক্ষই মুখ গোমড়া করে দুদিকে মুখ ঘুরিয়ে পাশাপাশিই বসে থাকে। কিন্তু কেউ কাউকে দেখতে পারে না পুরোপুরি।

আহা, ‘তুই’ যদি চিনতে পারত ‘আমারে’! কী ভালোই না হতো।