নাইট শিফট

পেক্সেলস

সন্ধ্যা সাতটা। মৌনিরা বের হওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল। ১০ মিনিটের মধ্যেই বেরিয়ে বাস ধরতে হবে। পাশের ঘর থেকে মা-বাবার গলা শোনা যাচ্ছে।

‘মিনারা, তুমি মালপত্র বাঁধাছাঁদা শুরু করে দাও। সামনের শুক্রবারই আমরা এই বাসা আমরা ছেড়ে দেব। মেডিকেলের কাছেই একটা বাসা দেখে এসেছি।’

‘তোমার অফিস থেকে দূরে হয়ে যাবে না?’

‘যাবে। দরকার হলে আমিই রোজ বাসে ঝুলব। মেয়ের সেফটি সবার আগে।’

‘আলতাফ সাহেবের সঙ্গে কথা বলেছিলে?’

‘বলেছিলাম। ওই ব্যাটা তো একটা একচক্ষু সাইক্লপস। ছেলের পক্ষই নিল। বলে, “ইয়াং বয়স, এসব তো একটু হবেই। মেয়েদের দেখেশুনে রাখা লাগে। সন্ধ্যাবেলা বাইরে বের হওয়া ঠিক না। কত রকম বিপদ রাস্তায়!” বদমাশ ব্যাটা, তোর ছেলের জন্য আমি মেয়ে অশিক্ষিত বানিয়ে রাখব নাকি? এটাও বলে এসেছি যে আমরা আর থাকব না। ভাবছি, মেয়েটাকে এই কদিনের জন্য বড় আপার বাসায় রেখে আসব। সাবধানের মার নেই। ওর সিমটাও পাল্টে দিতে হবে।’

রেডি হতে হতে এসব শুনে রাগে-দুঃখে মৌনিরার কান্না পাচ্ছিল। এমন সময় দরজায় বাবা নক করলেন। চোখের পানি আড়াল করেই দরজা খুলল মৌনিরা।

‘মা, বেরোচ্ছিস? চল, তোর সঙ্গে আজকে আমিও যাব।’

মৌনিরাদের বাসা যে গলিতে, তার মুখেই একটি চা-সিগারেটের দোকান। যথারীতি সেখানে বসে বন্ধুদের সঙ্গে সিগারেট খেতে খেতে তাস খেলছিল আফসার। মৌনিরাদের বাড়িওয়ালা আলতাফ চৌধুরীর ছেলে। সে ইন্টার ফেল না বিএ ফেল, তা ঠিক কেউ-ই জানে না। সবাই শুধু জানে, তার কাজ হলো সারা দিন এই দোকানে বসে বন্ধুদের সঙ্গে চা-সিগারেট খাওয়া, তাস খেলা আর পাড়ার মেয়েদের বিরক্ত করা। হোয়াটসঅ্যাপে আফসারের গোটা বিশেক নম্বর মৌনিরা ব্লক করেছে। নতুন মেসেজের অ্যালার্ট এলেই কেমন যেন ভয় ভয় করে আজকাল মৌনিরার।

নতুন বাসার ঠিকানা যদি ওরা খুঁজে বের করে? মা তো এখন বাসায় একা। ওখানে যদি হামলা চালায়? আজকে বাসায় ফেরার পথে বাবাকে কিছু করবে না তো? সারাটা পথ এমন হাজারটা চিন্তা করতে করতে মৌনিরা নামল হাসপাতালের সামনে।

বাবাসহ মৌনিরাকে হেঁটে যেতে দেখে আফসারের গায়ে টোকা দিল ওর এক বন্ধু। অন্য দিন হলে এখনই সে বলে উঠত, ‘রাইতের বেলা একা কই যাও, সুন্দরী? আমি আসি সঙ্গে?’ বলেই খিস্তি করতে করতে বাসস্টপেজ পর্যন্ত আসত ওর পেছন পেছন। একদিন তো বাসে উঠে ফলো করতে করতে হাসপাতালের গেট পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। পুরো রাস্তাটায় মৌনিরা মনে মনে বলেছে, ‘হে খোদা, আজকের মতো শুধু নিরাপদে পৌঁছে দাও।’

আজ ওরা বাবাকে দেখে খিস্তি করছে না বটে, তবে পেছন পেছন আসছে ঠিকই। বাবাও বিষয়টা খেয়াল করেছেন। বাসস্টপেজে মৌনিরার এক হাত ধরে রেখে আস্তে আস্তে বললেন, ‘পেছনে তাকাবি না। করতে থাকুক ওদের যা খুশি।’

বাসে ওঠার পরও বাবা বললেন, ‘খবরদার তাকাবি না ওই দিকে!’

মৌনিরা না তাকিয়েও ভালোভাবেই জানে, বাসের জানালা দিয়ে আফসার এখনো হায়েনার মতো ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। বাসটা ছাড়তেই মৌনিরাও হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। এই যন্ত্রণা আর কদিনের মধ্যেই শেষ হবে ভেবে সান্ত্বনাও পাচ্ছিল। কিন্তু তারপরও অজানা একটা ভয় ওকে কিছুতেই ছাড়ছিল না। নতুন বাসার ঠিকানা যদি ওরা খুঁজে বের করে? মা তো এখন বাসায় একা। ওখানে যদি হামলা চালায়? আজকে বাসায় ফেরার পথে বাবাকে কিছু করবে না তো? সারাটা পথ এমন হাজারটা চিন্তা করতে করতে মৌনিরা নামল হাসপাতালের সামনে। বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল। সে জানে না, এত ভয় আর দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে সারা রাত কীভাবে কাজ করবে। সে শুধু জানে, তাকে পারতেই হবে।

পেক্সেলস

পনেরো বছর পর...

আফসারের খুব সিগারেটের তেষ্টা পেয়েছে। টেনশনে ওর সিগারেটের তেষ্টা বাড়ে। কিন্তু কিছুই করার নেই। এটা হাসপাতাল। দেয়ালে বড় বড় করে লেখা ‘No smoking’। পাশের রুম থেকে ইন্টার্ন ডাক্তারের উত্তেজিত কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছিল আফসার, ‘প্রিম্যাচিউর রাপচার, ম্যাম। সারভিক্সের মুখ এখনো খোলেনি। প্রচুর পানি পড়ে গেছে। ব্লাডও আসছে পানির সঙ্গে। আপনার বোধ হয় আসা দরকার, ম্যাম। ওকে, আমি গাড়ি পাঠাচ্ছি।’

প্রিম্যাচিউর রাপচার মানে যে কী, আফসার তা জানে না। গুগল সার্চ করে দেখার মানসিকতাও এখন আর নেই। তবে ইন্টার্ন ডাক্তারের কণ্ঠ শুনে মনে হচ্ছে সমস্যা একেবারে ছোট নয়। ছেলেমেয়ের মুখ দেখার আশা আফসার একরকম ছেড়েই দিয়েছিল। গত মাসে ১০ বছর হলো সে বিয়ে করেছে। আফসারের বাবা শেষ পর্যন্ত ছেলের চরিত্র শোধরাতে বিয়ে দেন দেখেশুনে। বহু চেষ্টা-তদবির করে ছোটখাটো একটা চাকরিতেও ঢুকিয়ে দেন আরও বেশ কিছু যোগ্য প্রার্থীকে ডিঙিয়েই। চরিত্র তার বেশ খানিকটা শুধরেছে বটে; এখন সে খেটে খাওয়া মানুষ। সারা দিন চায়ের দোকানে আড্ডা মারা বেকার যুবক নয়। তবে অফিসে নতুন কোনো মেয়ে যোগ দিলে পুরোনো স্বভাবটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে ঠিকই। কিন্তু ওই বড়জোর ফেসবুকে রোজ লাভ, লাইক আর ‘Api nyc lagca’ কমেন্ট করা পর্যন্তই। এর চেয়ে বেশি কিছু করার সাহস হয় না।

আফসারের স্ত্রী রুবিনা প্রথমবার কনসিভ করল বিয়ের পাঁচ বছর পর। বাসার সবাই কত্ত খুশি! সেই শিশু মায়ের পেটে তিন মাস থেকেই বিদায় নিল। তারপর আরও কয়েকবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। কোনোটা তিন মাসে তো কোনোটা সাত মাসে। এবার যখন রুবিনা গর্ভধারণ করার খবরটা দিল, আফসার তখন থেকেই নির্বিকার। ডাক্তারের কাছেও রুবিনা একাই যেত। অনেকের কাছেই নামডাক শুনে এই হাসপাতালের একজন সিনিয়র গাইনি বিশেষজ্ঞের কাছে আসত রুবিনা। কিন্তু নৈরাশ্যবাদী আফসার শুধু ভিজিট আর টেস্টের টাকাগুলোই ওকে নিয়মিত দিয়েছে, সঙ্গে আসেনি এক দিনও। শেষমেশ শিশুটি যখন মায়ের পেটে ৩৫ সপ্তাহ পার করেই ফেলল, আফসার ঠিক করেছিল, নেক্সট ভিজিটে রুবিনার সঙ্গে যাবে। তার আর প্রয়োজন হলো না। রাত তখন আনুমানিক সাড়ে ১২টা। রুবিনার খুব পানির পিপাসা পাওয়ায় সে বিছানা থেকে উঠেছিল। উঠে দাঁড়ানোমাত্রই তার শরীর থেকে প্রবল ধারায় শুধু পানি বেরোতে থাকল।

‘এই, এটা কি ওয়াটারব্রেক?’ রুবিনার চিৎকারে ধড়মড় করে বিছানা থেকে নামল আফসার। তারপর টেলিফোনে অ্যাম্বুলেন্স ডেকে সোজা এখানে। সিনিয়র ডাক্তারদের কেউ-ই এত রাতে হাসপাতালে ছিলেন না। রুবিনার ডাক্তারের সঙ্গেই ফোনে কথা বলছিল ইন্টার্ন ডাক্তারটি। তিনি এলেই সম্ভবত অপারেশন শুরু হবে।

আফসারের প্রচণ্ড অস্বস্তি হতে থাকে চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে। তবে তার অস্বস্তি দূর করে কথাগুলো বলেই দ্রুত হেঁটে চলে গেলেন ডাক্তার। কথাগুলো মাথা থেকে যাচ্ছিল না। এই ডাক্তার কি তবে তার অতীত সম্পর্কে কিছু জানেন?

ডাক্তার যে ১০ মিনিট আগে চলে এসেছেন, আফসার তা খেয়ালও করেনি। জুনিয়র এক ডাক্তার এসে বললেন, ‘ম্যাডাম চলে এসেছেন। আপনার ওয়াইফের প্রচুর ফ্লুইড বেরিয়ে গেছে। বাচ্চার হার্টবিটও কম। সিজারিয়ান করতে হবে।’

আফসার সব কাগজপত্রে সই দিয়ে টাকা জমা দেওয়ার পর ঠিক রাত দুইটায় রুবিনাকে ওটিতে নেওয়া হলো। তারপর যে কতক্ষণ কেটে গেছে, আফসার কিছুই ঠাওর করতে পারল না। ক্রমাগত সে শুধু সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজের স্ত্রী আর সন্তানের জীবন ভিক্ষা চাইছিল। এমন সময় নার্স এসে দিলেন আনন্দের সংবাদটি, ‘মিষ্টি কই? আপনার ছেলে হয়েছে।’

ঠিক কত বছর পর, তার নিজেরও জানা নেই। আফসার ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। আনন্দের কান্না।

নীল তোয়ালেতে প্যাঁচানো ছোট্ট পুঁটলির মতো শিশুটিকে প্রথমে ওর দাদিই কোলে নিলেন। তারপর জীবনে প্রথমবারের মতো ছেলেকে দুহাতে ধরল আফসার। মাঝবয়সী এক নারী ওটি থেকে বেরিয়ে এলেন। মুখে মাস্ক, সার্জিক্যাল গাউনটাও তখনো খোলা হয়নি। তিনিই রুবিনার ডাক্তার, যাকে মধ্যরাতে ঘুম ফেলে ছুটে আসতে হয়েছে রোগী আর তার সন্তানের জীবন বাঁচাতে। নার্স পরিচয় করিয়ে দিলেন, ‘ম্যাডাম, পেশেন্টের ফ্যামিলি।’

আবেগে আফসারের মা ডাক্তারের হাত জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, ‘শুকরিয়া, ম্যাডাম! এত রাতে ডাক্তার পাওয়া যাবে, আমরা চিন্তাই করিনি।’

ছেলেকে শক্ত করে দুই হাতে ধরে আফসারও বলে উঠল, ‘থ্যাংক ইউ, ম্যাম। কী বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ দেব।’

‘ধন্যবাদ দেওয়ার প্রয়োজন নেই। ইটস আ পার্ট অব মাই ডিউটি। তবে আপনার কাছে একটা অনুরোধ আছে।’

কৌতূহলী আফসার এবার সরাসরি ডাক্তারের দিকে তাকাল। মুখে মাস্ক থাকায় শুধু তার বুদ্ধিদীপ্ত চোখ দুটোই দেখা যাচ্ছে।

‘ছেলে বড় হলে ওকে চায়ের দোকানে বসে মেয়েদের টিজ করতে দেবেন না। ভবিষ্যতে রাতবিরেতে নারী ডাক্তার তারও প্রয়োজন হতে পারে। টিজিংয়ের ভয়ে যদি সবাই পড়াই ছেড়ে দেয়?’

আফসারের প্রচণ্ড অস্বস্তি হতে থাকে চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে। তবে তার অস্বস্তি দূর করে কথাগুলো বলেই দ্রুত হেঁটে চলে গেলেন ডাক্তার। কথাগুলো মাথা থেকে যাচ্ছিল না। এই ডাক্তার কি তবে তার অতীত সম্পর্কে কিছু জানেন? জোর করেই চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল আফসার। সে এখন বাবা। কত কাজ এখন!

সার্জিক্যাল গাউনের নিচে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল ডাক্তারের গলায় ঝোলানো পরিচয়পত্র। না হলে আফসার ঠিকই দেখতে পেত জ্বলজ্বলে অক্ষরে সেখানে লেখা—ডা. মৌনিরা হুদা। এমবিবিএস, এফসিপিএস, এমডি (গাইনি অ্যান্ড অবস)। সিনিয়র কনসালট্যান্ট, প্রসূতি বিভাগ...