প্রেমিকার বিয়ে দিতে আমি নাকি এক্সপার্ট

অবিশ্বাস্য শোনালেও সত্য যে আমি প্রথম প্রেমে পড়ি ক্লাস সিক্সে; পাশের বাড়ির টুনা আপার। টুনা আপা খিলখিল করে হাসে আর আমার মাথা ঝিমঝিম করে। কিন্তু এটা যে প্রেম তা বুঝে ওঠার আগেই ঠাস করে টুনা আপার বিয়ে হয়ে গেল! তার গায়েহলুদে আমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলাম আর বিয়েতে গিয়ে খাসির রেজালা দিয়ে ধুমসে পোলাও খেলাম।
দ্বিতীয়বারের ঘটনা ক্লাস নাইনে। এইটের সোমাকে দেখলাম এবং দেখেই আমার ভেতরে কে যেন গেয়ে উঠল—কোথা হতে আনলে গো এমন রূপের বন্যা!
সোমার বৃত্তি পরীক্ষার কোচিং ক্লাস। আমি ঘুম থেকে উঠে রাস্তার পাশে দাঁড়াই। সোমা ছাতা মাথায় আসে। আমি তার ছাতার তলায় ঢুকে যাই। একদিন তার ছাতা ধরতে গিয়ে হাত ছুঁয়ে ফেললাম। পরবর্তী তিন দিন সেই সুখে ঘুমালাম না পর্যন্ত। নিজের হাত নিজেই ধরে বসে থাকি। বন্ধুরা জোর করে সেই হাত সাবান-পানি দিয়ে ধুয়ে দিলে আমি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারলাম! তিন মাসের মাথায় সেই সোমার বিয়ে হয়ে গেল!

সোমার বাবার সঙ্গে আমার সরাসরি কথা বলার উপায় ছিল না। তাই একটা চিঠি লিখলাম তাঁকে। চিঠিটা ছিল এ রকম—

শ্রদ্ধেয় আঙ্কেল,
সালাম নেবেন। আপনি কি জানেন ১৮ বছর বয়সের নিচে কোনো মেয়ের বিয়ে দিতে হয় না! শুনেছি, সোমার বিয়ে। সোমার বয়স কত? বাল্যবিবাহ আইনে তো আপনাকে জেলের ভাত খেতে হবে!
আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী


বিয়ের এক বছর পর সোমার সঙ্গে একবার দেখা হয়েছিল। তার কোলে তখন ফুটফুটে একটা মেয়ে। সোমা বলেছিল, যেদিন ওর বিয়ে হয়ে যায়, সেদিনই চিঠিটা ওর বাবা নাকি পেয়েছিলেন। বাল্যবিবাহ ও জেলের ভাত খুব স্ট্রাইকও করেছিল বাবার মাথায়। কিন্তু বিয়েটা তো হয়েই গিয়েছিল...চিঠিটা যদি আর একটু আগে আসত...!
এই আফসোস নিয়েই কলেজে উঠেছিলাম আর প্রেমে পড়েছিলাম তানিয়ার। ছিপছিপে গড়নের হরিণ চোখের মেয়ে। তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতেই কেটে গিয়েছিল একটা বছর। প্রেম নিবেদনের যখন উপযুক্ত সময় এল, তিনটা বই আর এক প্যাকেট চকলেট নিয়ে সেদিন কলেজে গেলাম। কলেজ সরগরম। চারদিকে উত্তেজনা! ছাত্রনেতা রবুর সঙ্গে নাকি তানিয়া পালিয়ে গেছে! রবুর মতো ষন্ডার ভেতর তানিয়া কী পেল, ভাবতে ভাবতেই এক শ বছরের নিঃসঙ্গতায় কাটল আমার কলেজজীবন।

তূর্ণা আজ কাজি অফিস থেকে তার প্রাইভেট টিউটরকে বিয়ে করে ফিরেছে। অনেক নাটকের পর তূর্ণার বাসায় তাদের মেনেও নিয়েছে। ওদিকে ঝর্ণা আমাকে এসএমএস করেছে। অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে লিখেছে, ‘আর একটা মাস পর তূর্ণাকে ভালোবাসলে কী খুব ক্ষতি হয়ে যেত, হীরক?’

বন্ধুরা তখন এক অদ্ভুত তত্ত্ব দেওয়া শুরু করল। আমি নাকি সেই প্রাণী, যার সঙ্গে যে কারও প্রেম হলেই তার নাকি বিয়ে হয়ে যায়! প্রেমিকার বিয়ে দিতে আমি নাকি এক্সপার্ট!
বন্ধুদের নিষ্ঠুরতায় আমার মনে তীব্র জেদের সঞ্চার হয়, প্রেম আমাকে করতেই হবে! এবং তারচেয়েও বড় কথা, প্রেমিকাকেই বিয়ে করতে হবে! বন্ধুরা যা বলে তা ভুল প্রমাণ করে ছাড়ব! এই তীব্র জেদের ভেতর এল মিলা। কিন্তু দুর্ভাগ্য আর কাকে বলে, তার বিয়ে আগে থেকেই ঠিক হয়ে ছিল। শুধু ডেট ফিক্সড হয়নি। মিলা এল, আমি প্রেমে পড়লাম এবং মিলার বিয়ের ডেট ফিক্সড হয়ে গেল। মিলার সঙ্গে তিন দিনের প্রেম ভেঙে খানখান হয়ে গেল। ভাঙা মন নিয়ে ভাবলাম, বন্ধুরা যা বলে তা-ই বোধ হয় ঠিক! আমি যাকে ভালোবাসি তারই নিশ্চয়ই বিয়ে হয়ে যায়!
মন খারাপের এই কালে এগিয়ে এল বন্ধুরাই। আমার এক বন্ধুর কাজিন, নাম ফারিয়া, তার বিয়ে হচ্ছে না। দেখতে খারাপ, পড়ালেখায় খারাপ ইত্যাদি কিছুই না। কিন্তু কোনো এক অদ্ভুত কারণে ফারিয়ার বিয়ে হচ্ছে না। বন্ধু আমার হাত ধরল। বলল, ‘এখন তুই-ই যদি কিছু করতে পারিস!’
: আমি এখানে কী করব?
: তুই যদি ফারিয়াকে ভালোবাসিস তাহলে ওর নিশ্চয়ই বিয়ে হয়ে যাবে!
: কী বলিস এই সব?
: চেষ্টা করে দেখ না বন্ধু! দোহাই লাগে!
ফারিয়াকে নিয়ে এক সপ্তাহ ঘুরলাম। টিএসসি, শাহবাগ, সিনেপ্লেক্স। ফুচকা-কফি-বিরিয়ানি। অষ্টম দিনে ভাগ্যের শিকে ছিঁড়ল। ফারিয়ার জন্য সম্বন্ধ এল সুদূর অস্ট্রেলিয়া থেকে। আমি ‘আই লাভ ইউ’ বলার পনেরো দিনের মাথায় ফারিয়ার বিয়ে হয়ে গেল। ফেসবুকে এখনো তার সঙ্গে যোগাযোগ হয়। সে লিখে পাঠায়, ‘ভাইয়া, তুমি না থাকলে যে আমার কী হতো!’ আমি বুকে পাথর চাপা দিয়ে একটা স্মাইলি পাঠিয়ে কনভারসেশন শেষ করি!
এর মধ্যে হুট করেই ডেকে পাঠালেন ছোট চাচি।
: শোন, তোর নামে যা শুনলাম তা কি সত্যি? তোর প্রেমিকা হলেই নাকি মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়?
: জি। কথা সত্যি!
: আউটস্ট্যান্ডিং!
: এখানে আউটস্ট্যান্ডিংয়ের কী আছে? এটা তো খুবই কষ্টের ব্যাপার!
: কষ্টের কোথায় গাধা? এ ক্ষমতা তো সবার থাকে না! তোর আছে। তুই তো হিরো, ট্র্যাজিক হিরো! ইতিহাসে তোর নাম লেখা থাকবে!
: ইতিহাসে নাম থাকার দরকার নেই। একটা প্রেমিকাকেও বিয়ে করতে পারলাম না, আর ইতিহাস!
: রোমিও পেরেছিল? মজনু পেরেছিল? তুই হলি আমাদের আধুনিক রোমিও, মজনু!
: আমি এসব হতে চাই না! আমি প্রেম করে একটা বিয়ে করতে চাই!
: চুপ থাক, গাধা। শোন, আমার এক বান্ধবীর মেয়ে, নাম ঝর্ণা, তাকে একবার ‘আই লাভ ইউ বলে’ আয় তো!
: মানে কী চাচি?
: আরে, বলে আয় না! আমার বান্ধবী একটা সুপাত্র খুঁজছে! তোর কোনো প্রেমিকার খারাপ কোনো বিয়ে হয়েছে, অ্যাঁ? যা, ঝরনাকে ‘আই লাভ ইউ’ বলে আয়! তাহলে মেয়েটার নিশ্চয়ই ভালো কোনো জায়গায় বিয়ে হয়ে যাবে!
: চাচি, এই সব কী বলেন আপনি?
: যা বলছি তাই কর। ফটর ফটর করে কথা বলিস না!
গেলাম চাচির বান্ধবীর বাসায়। পেলাম জামাই–আদর। ঝর্ণা এল, সঙ্গে এল তূর্ণা! দুজনেই রূপসী। কিন্তু তূর্ণা যেন একটু বেশি সুন্দর। আমি ঝর্ণাকে ‘আই লাভ ইউ’ বললাম, কিন্তু মনে মনে ভালোবেসে ফেললাম তূর্ণাকে। ঝর্ণাকে নিয়ে ফুচকা খাই, কিন্তু তূর্ণার জন্য মনটা পোড়ে। শেষ পর্যন্ত তূর্ণার ফেসবুকে লিখেই দিলাম, ‘তূর্ণা, আই লাভ ইউ! আমি ঝর্ণাকে না, আসলে তোমাকে ভালোবাসি!’
পরের ঘটনাটা অত্যন্ত হতাশার। আর দুর্ভাগ্যের। আর বেদনার। আর কষ্টের। তূর্ণা আজ কাজি অফিস থেকে তার প্রাইভেট টিউটরকে বিয়ে করে ফিরেছে। অনেক নাটকের পর তূর্ণার বাসায় তাদের মেনেও নিয়েছে। ওদিকে ঝর্ণা আমাকে এসএমএস করেছে। অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে লিখেছে, ‘আর একটা মাস পর তূর্ণাকে ভালোবাসলে কী খুব ক্ষতি হয়ে যেত, হীরক?’
বেদনাহত আমি এর উত্তরে কী লিখব! প্রেমিকার বিয়ে দিতে দিতে হৃদয় এখন চীনের প্রাচীরের মতো শক্ত হয়ে গেছে। তবু ঝর্ণার এসএমএসে বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। এই মোচড়ের উৎস কোথায়? তাহলে কি আমি ঝর্ণাকেও ভালোবাসি?
ভাবছি, আর প্রেম নয়, এবার একেবারে বিয়েই করে ফেলব। আচ্ছা, বউ হিসেবে ঝর্ণা কি খুব খারাপ হবে?