বাসের হকার যেভাবে স্যামকে সামিউল বানাল

আঁকা: রাজীব

বাসে উঠল স্যাম, গরমে অতিষ্ঠ সে। শীতকাল চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এত গরম পড়বে, ভাবা যায় না। স্যামের আসল নাম অবশ্য স্যাম নয়, স্যামুয়েলও না, তার নাম সামিউল। বড় নাম ছোট করে ফেলার অলিখিত নিয়ম সব দেশেই আছে। দেশভেদে সেটা একেক রকম হয়। যেমন আমাদের দেশে আতাহার হয়ে যায় আতা, সুমাইয়াকে ডাকা হয় সুমু বলে। তবে সামিউল তার নামটা ছোট করেছে ইংরেজি মাধ্যমে। তাই সামিউল হয়ে গেছে স্যাম। বন্ধুরাও তাকে স্যাম নামেই ডাকে। সামিউল এতে ইংরেজ অভিজাত্য খুঁজে পায়। কেউ নাম জিজ্ঞেস করলে স্যামই বলে সে, ফেসবুক আইডিও খুলেছে ওই নামেই।
যানজটে বসে আছে স্যাম। সবকিছু অসহ্য লাগছে। এর মধ্যে আবার এক হকার উঠেছে বাংলা ভাষার ওপর বই বিক্রি করতে। ‘ডিজগাস্টিং!’ মনে মনে ভাবে সামিউল, ‘ইংরেজি ভাষার বই হলেও কিছু একটা হতো। এই বাংলা ভাষার বই দিয়ে কী হবে! যত্ত সব রাবিশের দল! এমনিতে জ্যাম, তার মধ্যে এত হট্টগোল ভালো লাগে!’ সামিউলের ভাবাভাবির মধ্যেই হকার বই বিক্রির প্রচারণা শুরু করে দিয়েছে, ‘ভাইসব, বাংলা ভাষা নিয়ে গোপন সমস্যায় ভুগছেন? ঠিকঠাক বাংলা বলতে পারেন না? মুখ দিয়ে ফরফর করে ইংলিশ বের হয়ে যায় কিন্তু সেগুলোর বাংলা অর্থই মনে করতে পারেন না?...’
লোকটা বলেই যাচ্ছে। হঠাৎ করে সামিউল ‘ডিজগাস্টিং’-এর বাংলা মনে করতে পারছে না! তার পাশের সিটের লোকটা ঘুমাচ্ছে। হকারের চিৎকারে বোধ হয় তার ঘুমের ব্যাঘাত হয়েছিল, তাই বলে উঠল, ‘দেশটা স্টুপিডে ভরে গেছে! কোনো কমনসেন্স নেই এদের!’ এদিকে হকার লোকটার থামাথামির লক্ষণ নেই। সে বলেই চলেছে, ‘আমার এই বইটি পড়েন, একদম ফকফকা বাংলা পারবেন। সিরিয়াল ধইরা পড়বেন, লাইন ধইরা শিখবেন। ওই যে পিছনের থেকে তিন নাম্বার সিটের ভাই আমাকে স্টুপিড বললেন, আমার নাকি কমনসেন্স নাই। দাদা, বলুন তো এই কমনসেন্স আর স্টুপিডের বাংলা কী?’

হকার লোকটা বাসে ক্রমাগত বলেই চলছে, ‘এক কপি কিনলে আরেক কপি ফ্রি...’। সামিউল খেয়াল করে দেখল, বাসের সবাই হকারের মনোযোগী শ্রোতা হয়ে উঠেছে। কেউ কেউ বইও কিনছে। হকার তাদের একটা করে ক্যাশমেমোও দিচ্ছে!

সামিউলের পাশের সিটের লোকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। তাঁর বোধ হয় ‘স্টুপিড’ আর ‘কমনসেন্সের’ বাংলা এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না। সামিউলও সঙ্গে সঙ্গে একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল। সে ভাবছে, কিছুক্ষণ আগে যে হকার লোকটাকে ‘রাবিশ’ বলল, সেটারই–বা বাংলা কী! সে মনে মনে ভাবছে, ‘নাহ্, হকারটা বেশ স্মার্ট।’ এটা ভাবতে না-ভাবতেই সামিউলের মনে হলো ‘স্মার্ট’-এর ভালো বাংলাই বা কী!
নাহ্, এত মানসিক চাপ সামলানো সোজা ব্যাপার নয়। সামিউল মনে মনে বলছে, ‘আজকাল মেমোরির অবস্থা বেশ খারাপের দিকে...!’ এটুকু ভাবতে না-ভাবতেই আবার সে জিহ্বায় কামড় দিয়ে বসল, এই ‘মেমোরি’র বাংলাটা যেন কী!
‘অনেক হয়েছে!’ মনে মনে ভাবল সামিউল, ‘ফেসবুক, টুইটারে সারা দিন ইংরেজিতে বাতচিত করতে করতে বাংলার বারোটা বেজে গেছে!’
হকার লোকটা বাসে ক্রমাগত বলেই চলছে, ‘এক কপি কিনলে আরেক কপি ফ্রি...’। সামিউল খেয়াল করে দেখল, বাসের সবাই হকারের মনোযোগী শ্রোতা হয়ে উঠেছে। কেউ কেউ বইও কিনছে। হকার তাদের একটা করে ক্যাশমেমোও দিচ্ছে! সামিউল ভাবছে, ‘আগে ৩০ দিনে জাপানি ভাষা শিক্ষার বই কিনত মানুষ। এখন কি তাহলে বাংলা ভাষাও জাপানি ভাষার মতো দুর্বোধ্য হয়ে পড়েছে!’
হঠাৎ যানজট খুলে গেল। হকার লোকটা বাস থেকে নেমে যাচ্ছে। সামিউল দৌড়ে গিয়ে একটা বই নিল। হকার ক্যাশমেমো করার সময় জিজ্ঞেস করল, ‘দাদা, আপনার নামটা?’ সামিউল বলল, ‘আমার নাম স্যাম...’ পরমুহূর্তেই কিছু একটা ভেবে বলল, ‘নাহ্, আমার নাম সামিউল লিখুন।’