বিয়ে তাড়ানো ভূত

অলংকরণ: শিখা

শফিক লুঙিতে একটা মালকোঁচা মেরে বলল, ‘পল্টিটা গেল কই? ও জানে না আজকে কঠিন ম্যাচ?’

আমরা পল্টুকে ‘আদর’ করে পল্টি ডাকে। তো সেই পল্টিকে ঠিক সময়ে মাঠে না দেখে আমার মেজাজও খারাপ হয়ে গেল। যতই প্রীতি ম্যাচ হোক, পশ্চিমপাড়ার বিপক্ষে যেকোনো ম্যাচই আমাদের কাছে বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচের মতো। পল্টি আবার আমাদের পাড়ার মুস্তাফিজ। ওর স্লোয়ার আর কাটারে নাকানিচুবানি খায়নি এমন কোনো ব্যাটসম্যান কমই আছে।

বাবলু নতুন কেনা ব্যাটটা মাটিতে ঠোকাতে ঠোকাতে বলল, ‘কালকে ক্লাস শেষে বাসায় ফেরার সময় কী জানি ঝামেলার কথা বলছিল। খেয়াল করিনি।’

শফিক দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘ওর আবার কিসের ঝামেলা!’

পল্টির অবশ্য একটাই ঝামেলা, সেটা ওর বাবা। ওর বাবার নাম খবিরউদ্দিন। কিন্তু এলাকায় সবাই আড়ালে-আবডালে খবিশউদ্দিন বলে ডাকে। এই নামকরণ বেশ যুক্তিসংগত। পল্টুর বাবার মতো খবিশ এই এলাকায় কম আছে। সব বিষয়ে তাঁর খবিশগিরি না ফলালে পেটের ভাত হজম হয় না। বন্ধুর বাবা বলে আমরা এই নামের সদ্ব্যবহার করতে পারি না। তবে শফিক মাঝেমধ্যে রেগে গেলে উচ্চারণ করে ফেলে। এই যেমন এখনই মুখ ফসকে বলে ফেলল, ‘অবশ্য খবিশউদ্দিন যদি বাসায় থাকে, তাহলে বাইরে বের হওয়া কঠিন। কিন্তু ম্যাচের কথা ও মাথায় রাখবে না? বেকুব একটা।’

এতটুকু বলতে না-বলতেই মাঠের পুব দিক থেকে ধুলো উড়িয়ে একটা মোটরসাইকেল ছুটে আসতে লাগল। আমাদের এলাকায় মোটরসাইকেল খুব বেশি দেখা যায় না। যে চার-পাঁচটা মোটরসাইকেল আছে, তার মধ্যে একটা ওই পল্টুদের। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে বোঝা গেল, পল্টুই আসছে!

বাবু বিড়বিড় করে বলে উঠল, ‘এ তো অসম্ভব!’

সত্যিই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে পল্টু। ওর বাবার এই মোটরসাইকেল যক্ষের ধন। পল্টু তো পল্টু, ওর বাবা ছাড়া এই রকেটতুল্য যানটিতে আর কেউ হাত দিতে পেরেছে বলে আমাদের জানা নেই।

পল্টু আমাদের সামনে ঘটাং করে ব্রেক কষে মোটরসাইকেল থামিয়েই হড়বড় করে বলল, ‘আজকে আমি খেলতে পারব না।’

শফিক চোখ গরম করে হুংকার দিল, ‘মানে কী!’

: মানে হচ্ছে বড় আপাকে দেখতে এসেছে। ছেলেপক্ষের জন্য সেভেনআপ আনতে সদরে যাচ্ছি। এইসব আর সহ্য হয় না!

কথাগুলো বলতে বলতে পল্টুর গলা ধরে এল। বেশ বোঝা গেল—এটা একটা বড় ঝামেলা! আসলেই তো, ওর বড় বোনের বয়স আর কত হবে! এর মধ্যেই বিয়ের আলাপ! আমরা পড়ি ক্লাস এইটে, পল্টুর বড় বোন মানে বুবলি আপা পড়ে ক্লাস টেনে।

আমাদের আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই পল্টু মোটরসাইকেলে ভটভট আওয়াজ তুলে রাস্তার দিকে ছুটে গেল।

পল্টুর বাবা হাতজোড় করে শফিকের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বাবা রে, আমি আর মেয়ের বিয়ে দেব না, বাবা। আমাকে মাফ করে দেন, বাবা!’ এতটুকু বলেই কাটা কলাগাছের মতো ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেলেন তিনি! মুখে জমিয়ে রাখা কেরোসিনের অর্ধেকটা গিলে ফেলে আর বাকি অর্ধেকটা ফেলে দিয়ে পল্টু বলে উঠল, ‘ধর ধর!’

২.

পরদিন স্কুলে এসেও পল্টুর একই মূর্তি দেখতে হলো। বাসায় কেউ রাজি না, কিন্তু ওর বাবা তেড়িয়া। মেয়ের বিয়ে তিনি দিয়েই ছাড়বেন। পল্টু খাতার পাতা ছিঁড়ে দলা পাকাতে পাকাতে বলল, ‘কী যে করি! আপা দুই দিন হয় কিছুই খায় না। খালি কান্নাকাটি করে। ভাল্লাগে না কিছু। ধুর!’

‘ধুরধার করে কোনো লাভ আছে?’ শফিক একটা ঝাড়ুর কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে বলল, ‘তোর বাপটাকে একটু টাইট দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’

আমি হাতে কিল মেরে বললাম, ‘ঠিক। কায়দা করে যদি তাঁকে বোঝানো যায় যে এই বয়সে বিয়ে খুব ভয়ানক একটা ব্যাপার, তাহলে হয়তো কাজ হবে।’

পল্টু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। বাবু বলল, ‘কায়দাটা কী? আর চাচার ওপর কায়দা ফলানো কি এতই সোজা?’

শফিক বেঞ্চে তাল ঠুকতে ঠুকতে বলল, ‘সোজা ভাবলেই সোজা। এই বিয়ে ঠেকাতেই হবে।’

বাবু এবার বইয়ের জ্ঞান ঝাড়তে লাগল, ‘সেটাই! বইয়ে পড়িস নাই, বাল্যবিবাহ বেআইনি।’

সুযোগ পেয়ে আমিও জ্ঞান জাহির করতে ভুললাম না, ‘শুধু বেআইনি না, সাংঘাতিক রিস্কিও। এই বয়সে বিয়ে হলে তারপর বাচ্চাকাচ্চা হলে কত বিপদ হতে পারে! মনে আছে, গত বছর আমাদের পাশের বাসার ফুলি আপার অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের এক-দেড় বছর হতে না-হতেই শোনা গেল বাচ্চা হবে। আর কদিন পর তো ডেলিভারির সময় মারাই গেল! ফুলি আপার বয়সও খুব কম ছিল।’

শফিক মনে হয় জ্ঞানের কথায় চটে গেল, ‘এত জ্ঞান ফলাবি না তো! বুবলি আপার বিয়ে আমরা ঠেকাবই—এটাই ফাইনাল।’

পল্টু এবার মুখ খুলল, ‘কিন্তু কীভাবে? আপার কত শখ, পড়াশোনা করবে, দেশ-বিদেশ ঘুরবে। ও চলে গেলে কে আমাকে ব্যাট কেনার টাকা জোগাড় করে দেবে...’

বলতে বলতে ও ফ্যাচফ্যাচ করে কেঁদে ফেলল। শফিক দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘খালি আছে নিজের ধান্ধায়, ব্যাট কেনার টাকা কে দেবে, এইটা নিয়ে টেনশন। গাধা কোথাকার!’ এতটুকু বলে জানালার ওপাশের আকাশ-বাতাস দেখতে লাগল ও। আমাদের চুপচাপ থাকতে দেখে আবার মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘একটা বুদ্ধি আছে।’

শফিকের মাথায় যে বুদ্ধি আছে, এটা আমরা ভালো করেই জানি। তবে কতটা সুবুদ্ধি কতটা কুবুদ্ধি—সেটা নিয়ে তর্ক করা যেতে পারে। এবার সেই তর্কে না গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী বুদ্ধি?’

শফিক যে বুদ্ধিটা দিল, সেটা শুনে আমাদের তো বটেই স্বয়ং পল্টুর মুখেও হাসি ফুটল।

৩.

পল্টুর বাবার ধান-চালের ব্যবসা। আড়তটা উপজেলা সদরে। বাসায় ফিরতে ফিরতে তাঁর রাত দশটা-এগারোটা বেজে যায়। আজও তেমনটাই হওয়ার কথা। চৈত্র মাস। কৃষ্ণপক্ষের রাত। ব্রিজের নিচ দিয়ে যে ছোট নদীটা বয়ে গেছে, সেটায় এখন হাঁটুপানি। ফলে আমরা খুব সহজেই ব্রিজের নিচে নদীর পাড়ে বসে থাকতে পারছি। বাবু অবশ্য আমাদের সঙ্গে নেই। ও দাঁড়িয়ে আছে ব্রিজটা থেকে আরও খানিকটা সামনে, একটা ঝোপের আড়ালে ঘাপটি মেরে আছে ও। হাতে একটা টর্চ আছে ওর। মোটরসাইকেলের হেডলাইটের আলো বা শব্দ শুনলেই টর্চটা দুইবার জ্বালিয়ে আমাদের সতর্কবার্তা পাঠাবে।

সবকিছু ঠিকঠাক করে কতক্ষণ বসে ছিলাম মনে নেই। এর মাঝে দুই-একটা সাইকেল ব্রিজের ওপর দিয়ে চলে গেছে। এ ছাড়া সবকিছু সুনসান। পল্টু একসময় ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, ‘আমার তো ভয় করছে রে!’

শফিক ওর ঘাড়টা চেপে ধরে দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, ‘ভয় করছে তো এখানে কী করিস! বাসায় গিয়ে মর!’

এতটুকুতেই পল্টু ভয়টা গিলে ফেলল। তবে আমারও যে ভয় করছিল না, তা নয়। কিন্তু ভয় পেয়ে আর কী হবে। বড় বড় শ্বাস নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। কোথায় যেন পড়েছিলাম—বড় বড় শ্বাস নিলে ভয় কেটে যায়। কিন্তু সময় তো আর কাটে না! একসময় যখন ‘ধুর’ বলে উঠে পড়তে যাব বলে ভাবছি, ঠিক সেই সময় ‘ভট ভট’ করে আওয়াজ এল কানে। বাবুর সিগন্যাল না পেলেও বুঝে ফেললাম, এটা পল্টুর বাবার মোটরসাইকেলের শব্দ। এমন বাজে একটা শব্দ এত মধুর লাগল, বলে বোঝাতে পারব না।

আমরা চটপট রেডি হয়ে গেলাম। বাবুও অন্ধকারে গুড়ি মেরে এগিয়ে এল আমাদের কাছে। শফিক আগে থেকেই সাদা আলখাল্লাটা পরে ছিল। মাথায় হেলমেটের মতো করে হাঁড়িটা পরেই রাস্তায় উঠে গেল। আমি রেডি হয়ে গেলাম হোমমেড চোঙাটা নিয়ে। পল্টু আর বাবু রেডি কেরোসিনের বোতল হাতে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেই হয়।

হেডলাইটের আলোটা ছোট্ট বিন্দু থেকে আস্তে আস্তে বড় হতে লাগল। আর আমার বুকের ভেতর ঢিবঢিব শব্দটাও বাড়তে লাগল সঙ্গে সঙ্গে। বাকিদেরও নিশ্চয়ই একই অবস্থা। মোটরসাইকেলটা একসময় ব্রিজের ওপর উঠে এল। শফিক লম্বা লম্বা পা ফেলে দুই হাত উঁচু করে দাঁড়িয়ে পড়ল ব্রিজের ঠিক মাঝখানটায়। ওকে দেখতে ঠিক ভয়ালদর্শন একটা ভূতের মতো লাগছে। ঘ্যাচ করে ব্রেক কষলেন পল্টুর বাবা। অন্ধকারে তাঁর মুখের ভাবভঙ্গি কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। তবে কাঁপাকাঁপা গলায় ‘ইয়া মাবুদ’ বলে উঠলেন একবার। আমি ঠিক সেই মুহূর্তে চোঙে মুখ লাগিয়ে বললাম, ‘খবিশউদ্দিন! আজকে তোর খবর আছে!’

পল্টুর বাবা প্রায় কাঁদোমাদো হয়ে বললেন, ‘ওরে মা রে! বাঁচারে মা!’

শফিক ততক্ষণে হাত-পা নাচিয়ে পল্টুর বাবার সামনে পায়চারি করছে। আমিও চালিয়ে গেলাম, ‘আজকে তোর কলজে টেনে ছিঁড়ে ফেলব! কত বড় সাহস, তুই তোর অল্প বয়সী মেয়েটাকে বিয়ে দিচ্ছিস! তুই জানিস, বাল্যবিবাহ আইনে তোর জেল হবে?’

পল্টুর বাবা তোতলাতে লাগল, ‘না না না...কী কী কী চান আপনি?’

‘তোর রক্ত চাই রক্ত!’ এতটুকু বলতেই পেছন থেকে বাবু মুখে কেরোসিন নিয়ে বিশাল একটা আগুনের কুণ্ডলী বানিয়ে ছুড়ে দিল সামনে। সেটা দেখে ‘ওরে বাবা’ বলে আঁতকে উঠলেন পল্টুর বাবা। আমি আবার খনখনে গলায় বললাম, ‘তুই যদি তোর মেয়ের বিয়ে বন্ধ না করিস, তাহলে তোর রক্ষা নাই!’

পল্টুর বাবা হাতজোড় করে শফিকের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বাবা রে, আমি আর মেয়ের বিয়ে দেব না, বাবা। আমাকে মাফ করে দেন, বাবা!’ এতটুকু বলেই কাটা কলাগাছের মতো ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেলেন তিনি! মুখে জমিয়ে রাখা কেরোসিনের অর্ধেকটা গিলে ফেলে আর বাকি অর্ধেকটা ফেলে দিয়ে পল্টু বলে উঠল, ‘ধর ধর!’

শেষকথা: সেই রাতে ভূতের ভয়ে এক সপ্তাহ বিছানায় ছিলেন পল্টুর বাবা। কাজটা যে আমরা করেছি, সেটা অবশ্য তিনি স্বপ্নেও কল্পনা করেননি। তবে সেটা বেশ কাজে দিয়েছে। বুবলি আপার বিয়ে নিয়ে আর একটা কথাও বলেননি। এদিকে কয়েক দিনের মধ্যেই বুবলি আপা আমাদের ‘স্পেশাল’ ভোজ দেবেন বলে একটা আশ্বাস পাওয়া গেছে।