বুড়ো ঘোড়াটি যেভাবে সিংহ ধরে আনল

অলংকরণ: পল গ্যালডন

অনেক দিন আগে এক গাঁয়ে এক চাষি ছিল। গরু, ছাগল, ভেড়া, কুকুর, বিড়াল ও পায়রার সঙ্গে তার ছিল একটি ঘোড়া। ঘোড়াটা চাষির জন্য খাটতে খাটতে অকালে বুড়ো হয়ে গেল। বুড়ো হলেও তার মনটা ছিল ভালো।

চাষি দেখল, ঘোড়াটা দিন দিন আরও দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। কাজেই সে ভাবল, তাকে আর বসিয়ে বসিয়ে খাইয়ে লাভ নেই। বরং ক্ষতিই হচ্ছে।

তাই চাষি একদিন ঘোড়াকে ডেকে বলল, ‘তুমি বাপু আমার বাড়ি থেকে চলে যাও। নিজের পথ নিজে দেখো। তোমাকে বসিয়ে রেখে খাওয়াতে পারব না। সাফ কথা।’

চাষির কথা শুনে ঘোড়ার মাথায় পড়ল বাজ। এই বুড়ো বয়সে সে কোথায় যাবে? কী খাবে? কীভাবে জীবন যাবে? থাকবেই-বা কোথায়?

ঘোড়া বিনীত হয়ে চাষির কাছে আরজ করল, ‘আমি সারা জীবন তোমার জন্য খাটলাম। সে জন্য হলেও আমাকে দয়া করো। বিদায় দিয়ো না, বাবা! দোহাই।’

চাষি বলল, ‘হ্যাঁ, তবে তোমার অনুরোধ বিবেচনা করতে পারি। এক শর্তে। যদি তুমি একটি জ্যান্ত বাঘ ধরে আনতে পারো।’

ঘোড়া জীবন্ত বাঘ ধরে এনেছে, এমন কথা কেউ কোনো দিন কোথাও শুনেছ নাকি? ঘোড়া ভাবল। কিন্তু কী আর করা? দুঃখভরা মন নিয়ে ঘোড়া চাষির ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল, যা থাকে কপালে! গিয়ে বনের ধারে খেয়েদেয়ে এক গাছের ছায়ায় জিরিয়ে নিতে লাগল। তখন এক শিয়াল সেখানে এসে হাজির।

অলংকরণ: পল গ্যালডন

শিয়াল ঘোড়াকে বলল, ‘কী ভাই, একা একা বনের ধারে যে তুমি? চাষির বাড়ি থেকে চলে এলে নাকি?’

ঘোড়া চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে তার দুঃখের কথা সব বলল। গড়গড় করে। হ্রেষা ডাক দিয়ে, ফোঁস ফোঁস করে।

শিয়াল তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বলল, ‘তুমি দুঃখ করো না, ভাই। চাষি তোমাকে একটা বাঘ ধরে নিয়ে যেতে বলেছে। এই তো? আমি বলছি, তুমি একটি জীবন্ত সিংহ নিয়ে যাবে। বাঘের চেয়ে সিংহ আরও বলবান। সিংহ দেখে তোমার মালিক আরও বেশি খুশি হবে।’

এদিকে হয়েছে কি, কিছুদিন আগে এই বনে এক সিংহ এসে আসন গেড়েছে। সে বনের পশুদের ধরে ধরে খাচ্ছে। সে এক মহা বিভীষিকা! বনের সবাই সিংহের অত্যাচারে অস্থির। সিংহ পশুর রাজা। তাই মুখ ফুটে কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না। এদিকে সিংহটা বুড়ো হয়ে এসেছে, বুদ্ধিশুদ্ধিও কম। তবু সবাই ভয় পায়।

শিয়ালও অনেক দিন ধরে ভাবছে, কী করে সিংহকে উচিত সাজা দেওয়া যায়। ঘোড়াকে পেয়ে এবার সে এক ফন্দি বের করল। দেখা যাক, সফল হওয়া যায় কি না।

শিয়াল ঘোড়াকে বলল, ‘তুমি মড়ার মতো মাটিতে পড়ে থাকো। তবে তার আগে ভালো করে খেয়ে নাও। গায়ে শক্তি আনো। জীবনের মতো একবার শক্তি জমা করে নাও শরীরে। আমি বুড়ো সিংহটাকে এখানে নিয়ে আসব, তারপর এক কাজ করব। হুক্কাহুয়া বলে তিন চিৎকার দেব। তখন তুমি আচমকা উঠে দেবে দৌড়। জীবনের সব শক্তি দিয়ে। দৌড়ে সোজা চাষির ঘরে গিয়ে থামবে। তারপর নেবে দম। তার আগে নয়। কেমন?’

যেমন বলা তেমন কাজ।

ঘোড়া পথের ওপর মড়ার মতো চার পা ছড়িয়ে পড়ে রইল।

এদিকে শিয়াল বনে ঘুরে ঘুরে সিংহকে খুঁজে বের করল। তাকে অভিবাদন জানিয়ে একপাশে বসল। তারপর বলল, ‘মহারাজের জয় হোক। আশা করি মহারাজ সব দিকে কুশল। আমি আপনার বিনীত সেবক। মারলে মারতে পারেন। কাটলে কাটুন।’

শিয়ালের তোষামোদে সিংহ মহাখুশি। সে শিয়ালকে মারবে না ঠিক করল। শুধু মুচকি হেসে বলল, ‘শান্ত হও, বাছা। তোমার কোনো ভয় নেই।’

অলংকরণ: পল গ্যালডন

শিয়াল তখন আরও বিনয়ের সঙ্গে বলল, ‘একটা সুসংবাদ রাজাধিরাজ। একটু দূরে ওই পথের ধারে আপনার নাম শুনে একটা ঘোড়ার কলজে থেমে গেছে। মরে পড়ে আছে। গা এখনো গরম। তার মাংসে আজ আপনার চমৎকার ভোজ হবে। আপনি যদি অনুগ্রহ করে আমার সঙ্গে তশরিফ আনেন! তাহলে আমি আপনাকে সেখানে নিয়ে যেতে পারি।’

সিংহের ভীষণ খিদে পেয়েছিল। নড়তে-চড়তে পারছিল না। কাজেই শিয়ালের অনুরোধে সঙ্গে সঙ্গে রওনা দিল। যেতে যেতে শিয়াল বলল, ‘মহারাজ, আপনার পেছনের দুটি পায়ের সঙ্গে ঘোড়ার লেজটা কষে বেঁধে দিলে খুব ভালো হবে। তাহলে আপনি নিজে তাকে আপনার গুহায় নিয়ে গিয়ে মহারানিদের সঙ্গে মিলেঝুলে খেতে পারবেন। তারাও তো না খেয়ে আছে, তাই না?’

সিংহ গম্ভীরভাবে বলল, ‘তা–ই হবে। আমার একটা দাঁতে শুল হয়েছে। মুখ দিয়ে টানাটানি করতে গিয়ে ব্যথা বাড়িয়ে কী লাভ! সিংহীরা ঘোড়ার চামড়া দাঁতে কেটে দিলে আমি খাওয়া শুরু করব।’

অবশেষে পৌঁছাল তারা ঘোড়ার কাছে। শিয়াল খুব বিনয়ের সঙ্গে সিংহের পায়ের ধুলো মাথায় নিয়ে কাজ শুরু করল। ঘোড়ার লেজের সঙ্গে কষে সিংহের পেছনের দুপা দিল বেঁধে। তারপর বাপ-দাদার শেখানো বুলি ছাড়ল, হুক্কা হুক্কা হুয়া।

শোনার সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়া তার সারা জীবনের শক্তির কথা মনে করে দিল লাফ। উঠল চার পায়ে দাঁড়িয়ে। দিল জোর কদমে দৌড়। ছুটল চাষির বাড়ির দিকে। সিংহ হতভম্ব।

চাষি তার বউ, ছেলেমেয়ে, কুকুর, পাড়াপড়শি ও শিয়ালকে নিয়ে সিংহকে খাঁচায় পুরল। খাঁচাসহ সিংহকে রাজার কাছে নিয়ে অনেক টাকায় বেচে দিল। রাজাও মহাখুশি।

চাষি বুঝতে পারল তার বিশ্বস্ত ঘোড়া সত্যি খুব মূল্যবান। সেদিন থেকে সে ঘোড়ার যত্ন নিতে লাগল। আরও বেশি করে। ঘোড়াও পরম সুখে আছে। আর সে এখনো না মরে থাকলে চাষির ঘরে খুব সুখেই আছে।

বনেও শিয়াল ও অন্য সব পশুপাখিও শান্তিতে আছে বলে শুনেছি। কেউ না শুনে থাকলে এখন শুনুক।

গ্রিম ভাইদের রূপকথা অবলম্বনে