ব্যাগের ভেতর হৃৎপিণ্ড নিয়ে ঘোরেন তাঁরা

হৃৎপিণ্ড চালু রাখার জন্য একটি ব্যাকপ্যাক নিয়ে ঘুরতে হয় সেলওয়া হুসেইনকে। এর ওজন প্রায় ১৫ পাউন্ড। ব্যাগে থাকে ব্যাটারি, ইলেকট্রিক মোটর ও একটি পাম্প...

হৃৎপিণ্ড চালু রাখার জন্য একটি ব্যাকপ্যাক নিয়ে ঘুরতে হয় সেলওয়া হুসেইনকে
ছবি: ডেইলি মেইল

দেখতে অনেকটা সাধারণ পিঠে ঝোলানো ব্যাগের মতো। ঠিক যেমনটা আপনি প্রয়োজনীয় জিনিস নেওয়ার জন্য ব্যবহার করেন বা ছোট্ট ল্যাপটপের ঠাঁই হয় যেখানে। কিন্তু পার্থক্য হলো এই বিশেষ ব্যাগে থাকে শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের রিমোট কন্ট্রোল।

রিমোট কন্ট্রোল শব্দটা আসলে প্রতীকী অর্থে ব্যবহার করা। পৃথিবীতে কিছু মানুষ আছেন, নানা কারণে যাঁদের হৃদ্‌যন্ত্র পুরোপুরি অচল হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসাশাস্ত্রে তাঁদের হৃদ্‌যন্ত্র প্রতিস্থাপনের সুযোগ থাকে। কিন্তু চাইলেই কি আর যখন-তখন তরতাজা হৃদ্‌যন্ত্র মেলে! তখন অপেক্ষা করতে হয়। আর অপেক্ষার সেই সময়টায় রোগীদের পিঠে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় সম্পূর্ণ কৃত্রিম হৃদ্‌যন্ত্র (টোটাল আর্টিফিশিয়াল হার্ট বা টিএএইচ)। একটি ব্যাকপ্যাকে নিয়ে ঘুরতে হয় সেটি।

রোগীদের পিঠে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় সম্পূর্ণ কৃত্রিম হৃদ্‌যন্ত্র (টোটাল আর্টিফিশিয়াল হার্ট বা টিএএইচ)। একটি ব্যাকপ্যাকে নিয়ে ঘুরতে হয় সেটি
ছবি: ডাইকার্ডিওলোজি ডটকম

বিশ্বে সম্পূর্ণ কৃত্রিম হৃদ্‌যন্ত্র ব্যবহার করার বেশ কটি উদাহরণ আছে। যুক্তরাজ্যের সেলওয়া হুসেইন তেমনই একজন। ২০১৭ সালের মাঝামাঝি তাঁর হৃৎপিণ্ড একেবারে অচল হয়ে গিয়েছিল। দুই সন্তানের মা সেলওয়ার বয়স তখন ৩৯ বছর। হাসপাতালে নেওয়ার পর দেখা যায়, তাঁর হৃদ্‌যন্ত্র আর কাজ করছে না। এরপর চিকিৎসকেরা বুঝতে পারেন, তাঁর হৃদ্‌যন্ত্র প্রতিস্থাপন করতে হবে। কিন্তু দাতা পাওয়া যায়নি সময়মতো। তাই ওই বছরের শেষের দিকে সেলওয়ার শরীরে বসানো হয় কৃত্রিম হৃদ্‌যন্ত্র।

একে চালু রাখার জন্য একটি ব্যাকপ্যাক নিয়ে ঘুরতে হয় সেলওয়াকে। এর ওজন প্রায় ১৫ পাউন্ড। ব্যাগে থাকে ব্যাটারি, ইলেকট্রিক মোটর ও একটি পাম্প। এটি সেলওয়ার কৃত্রিম হৃদ্‌যন্ত্রকে চালু রাখে ও নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে হৃদ্‌যন্ত্রের মাধ্যমে পুরো দেহে রক্ত চলাচল অব্যাহত থাকে।

সেলওয়া হুসেইনকে ওই সময় নেওয়া হয়েছিল যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত হেয়ারফিল্ড হাসপাতালে। সেখানে অভিজ্ঞ চিকিৎসকেরা তাঁর প্রাকৃতিক হৃদ্‌যন্ত্র অপসারণ করে সেখানে কৃত্রিমটি বসান। ব্যাগে করে হৃদ্‌যন্ত্র বয়ে নেওয়ায় অভ্যস্ত হতে সেলওয়ার কয়েক মাস সময় লেগেছিল। এরপর সর্বত্র চলাচলের ক্ষেত্রেই সেলওয়াকে এই ব্যাগ বইতে হতো। তা তিনি ঘরেই থাকুন বা রাস্তায়!

২০১১ সালে যুক্তরাজ্যেই আরেক ব্যক্তির দেহে বসানো হয়েছিল এমন হৃদ্‌যন্ত্র। তার দুই বছর পর ৫০ বছর বয়সী ওই ব্যক্তির হৃদ্‌যন্ত্র প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল। যত দূর জানা যায়, তিনি বেশ সুস্থই ছিলেন। রেবেকা হ্যান্ডারসনের ভাগ্য অবশ্য অতটা সুপ্রসন্ন ছিল না।

সম্পূর্ণ কৃত্রিম হৃদ্‌যন্ত্রের জন্য সেলওয়াকে খরচ করতে হয়েছিল প্রায় ৮৬ হাজার পাউন্ড। সেটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের একটি কোম্পানির তৈরি। অস্ত্রোপচারে সময় লেগেছিল প্রায় ৬ ঘণ্টা।

মানুষের পুরো দেহে রক্ত সঞ্চালনের কাজটি করে থাকে হৃদ্‌যন্ত্র। যখন এর নিলয় অকার্যকর হয়ে পড়ে, তখন আর সেটি কাজ করে না। কৃত্রিম হৃদ্‌যন্ত্রের কাজ এখানেই। মূলত হৃদ্‌যন্ত্রের নিচের অংশে বসানো হয় এটি। চালু থাকে ব্যাকপ্যাকে থাকা ব্যাটারির সাহায্যে। দেহের সঙ্গে ব্যাগের সংযোগ থাকে দুটি নলের মাধ্যমে। এভাবেই পুরো দেহে রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া চালু রাখে কৃত্রিম হৃদ্‌যন্ত্র বা টিএএইচ।

তবে এ ক্ষেত্রে রোগীকে যেমন একটি ব্যাগ পিঠে ঝোলাতে হয়, তেমনি জরুরি প্রয়োজনের জন্য আরেকটি ব্যাগও সঙ্গে রাখতে হয় সব সময়। সেলওয়া হুসেইনের বেলায় এই দায়িত্ব পালন করতেন তাঁর স্বামী। জরুরি প্রয়োজন হলে ব্যাগ পাল্টানোর জন্য সময় বরাদ্দ থাকে মাত্র ৯০ সেকেন্ড!

জরুরি প্রয়োজনের জন্য রোগীর সঙ্গে দুটি ব্যাগ রাখতে হয় সব সময়। সেলওয়া হুসেইনের বেলায় এই দায়িত্ব পালন করতেন তাঁর স্বামী
ছবি: ডেইলি মেইল

এর আগেও অবশ্য এমন কৃত্রিম হৃদ্‌যন্ত্র ব্যবহারের উদাহরণ আছে। ২০১১ সালে যুক্তরাজ্যেই আরেক ব্যক্তির দেহে বসানো হয়েছিল। তার দুই বছর পর ৫০ বছর বয়সী ওই ব্যক্তির হৃদ্‌যন্ত্র প্রতিস্থাপন করা হয়। যত দূর জানা যায়, তিনি বেশ সুস্থই ছিলেন।

রেবেকা হ্যান্ডারসনের ভাগ্য অবশ্য অতটা সুপ্রসন্ন ছিল না। ক্যানসারের কারণে তাঁর হৃদ্‌যন্ত্র পুরোপুরি অচল হয়ে গিয়েছিল। কৃত্রিম হৃদ্‌যন্ত্র লাগানোর পর এক বছর তিনি বেঁচে ছিলেন। গত বছর ২৪ বছরের এই তরুণীর মৃত্যু হয়। হৃদ্‌যন্ত্রের ক্যানসারে ভোগা প্রথম রোগী হিসেবে তাঁর শরীরে বসানো হয়েছিল কৃত্রিম হৃদ্‌যন্ত্র। সেলওয়ার মতোই পিঠে ঝোলানো ব্যাগে তা নিয়ে ঘুরতেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া এই মেধাবী তরুণী।

কৃত্রিম হৃদ্‌যন্ত্র লাগানোর পর এক বছর বেঁচে ছিলেন রেবেকা হ্যান্ডারসন
ছবি: দ্য টাইমস

অবশ্য ২০১৮ সালের পর অন্তর্জালে সেলওয়া হুসেইনের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না। বিশ্বাসযোগ্য কোনো সংবাদমাধ্যম তাঁর অবস্থা নিয়ে আর কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তবে আশা, তিনি সুস্থ আছেন। পিঠে ঝোলানো ব্যাগে হৃদ্‌যন্ত্রটি নিয়ে হাঁটছেন পৃথিবীর পথে। ঢিপ ঢিপ ঢিপ ঢিপ...!

তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, বিবিসি, ডেইলি মেইল, এক্সপ্রেস ডট কো ডট ইউকে, হেলথ ডট হার্ভার্ড ডট এডু ও যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল হার্ট, লাং অ্যান্ড ব্লাড ইনস্টিটিউটের ওয়েবসাইট