অনুপ্রেরণা
মসলার ব্যবসা করেই পদ্মভূষণ আর কোটি কোটি টাকা
মহাশয় ধর্মপাল গুলাতি এক জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন মসলার ব্যবসা করে। বলা হয়ে থাকে, তিনিই মানুষের মধ্যে ‘রেডিমেড’ অর্থাৎ একদম রান্নার উপযোগী মসলার ব্যবহার জনপ্রিয় করেছেন। এই মসলাই তাঁকে সম্পদের পাহাড় দিয়েছে। সম্মান দিয়েছে। আর দিয়েছে মানুষের ভালোবাসা। সেই ভালোবাসা সঙ্গে নিয়েই গতকাল ৩ ডিসেম্বর ৯৭ বছর বয়সে চিরকালের মতো বিদায় নিলেন ভারতীয় জনপ্রিয় মসলার ব্র্যান্ড এমডিএইচের এই কর্ণধার। পড়ুন তাঁর বর্ণাঢ্য জীবন সম্পর্কে...
রংচঙে বেশভূষা, তা দেওয়া জাঁদরেলে গোঁফ আর লাল পাগড়ির বাহার দেখে ধর্মপাল গুলাতির বর্ণাঢ্য জীবনের কিছুটা আঁচ করা যায়। অনেকেই তাঁকে ‘দাদাজি’ বলে ডাকত। ‘মসলার রাজা’ হিসেবে সুপরিচিত। ভারতীয় মসলার বাজারে দীর্ঘদিন আধিপত্য ধরে রেখেছে তাঁর প্রতিষ্ঠান। পৈতৃক সূত্রে ছোট একটি মসলার দোকান দিয়ে ব্যবসা শুরু করলেও সময়ের ব্যবধানে হয়েছেন ভারতের অন্যতম সফল ব্যবসায়ী।
ধর্মপাল গুলাতির জন্ম পাকিস্তানের শিয়ালকোটে। সেখানে ছোট এক মসলার দোকান ছিল তাঁর বাবা চুনি লালের। পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব ভালো ছিল না। পঞ্চম শ্রেণিতেই বন্ধ হয়ে যায় গুলাতির লেখাপড়া। এরপর বাবার সঙ্গে নেমে পড়েন মসলার ব্যবসায়ে।
সাতচল্লিশের দেশভাগের সময় পাকিস্তান ছেড়ে সপরিবার ভারতে আসেন গুলাতি। সম্বল মোটে দেড় হাজার রুপি। সেই অর্থে কী আর করবেন? কাজ নেন ঘোড়ার গাড়ি চালনার। ওদিকে তাঁর বাবা দিল্লির কারোলবাগে আবারও ছোট্ট একটি মসলার দোকান দাঁড় করার চেষ্টা করেন। দিন কয়েক বাদে ঘোড়ার গাড়ি ছেড়ে বাবার ব্যবসার চালকের আসনে বসেন। তারপর? তরকারিতে যেভাবে মসলার রূপ-রং ছড়ায়, তেমনই ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে এমডিএইচের নাম। আর বাড়ি বাড়ি সুবাস ছড়িয়ে যাওয়ার মতো করে দিল্লি ছাড়িয়ে দেশের অন্য রাজ্যগুলোতে স্থাপন করা হয় তাঁর কারখানা।
গল্পের বাকিটা শুধু অর্জনের। বাড়তে থাকে পণ্যের সংখ্যা। নিজ দেশের বাইরেও গুলাতির মসলার চাহিদা ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে ভারত ও দুবাইয়ে ১৮টি কারখানা আছে প্রতিষ্ঠানটির। এই দুটি শহরে তো আছেই, এর বাইরে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে আছে আরেকটি কার্যালয়। আর এমডিএইচ ব্র্যান্ডের নামে আছে ৬০টির বেশি ধরনের পণ্য। ভারতের বাজারে ৮০ শতাংশ মসলার চাহিদা পূরণ করে এমডিএইচ।
২০১৭ সালে তিনিই ছিলেন ভারতের ভোগ্যপণ্য ঘরানার প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সর্বাধিক বেতনপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। ওই বছর তিনি ২১ কোটি রুপি বেতন নিয়ে পেছনে ফেলেন গোদরেজের বিবেক গম্ভীর, আদি গোদরেজ, হিন্দুস্তান ইউনিলিভারের সঞ্জীব মেহতা ও আইটিসি লিমিটেডের যোগেশ চন্দর দেবেশ্বরকে। পরবর্তী বছর বেতন হিসেবে তাঁর অ্যাকাউন্টে জমা হয় ২৫ কোটি রুপি।
আর শুধু ব্যবসার কথা বলা কেন? টিভির পর্দাতেও কি কম জনপ্রিয় ছিলেন গুলাতি? ঘটনাক্রমে নিজের পণ্যের বিজ্ঞাপনে মডেল হন তিনি। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়াকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘বিজ্ঞাপনের জন্য কনের বাবার চরিত্রের নির্ধারিত শিল্পী শুটিংয়ের দিন অনুপস্থিত ছিলেন। পরিচালক তখন আমাকে বলল, আপনিই তো এই চরিত্রে অভিনয় করতে পারেন। ভাবলাম, আমি অভিনয় করলে তো একজন শিল্পীর পারিশ্রমিকও বেঁচে যাবে। তাই রাজি হয়ে গেলাম।’ দর্শকও সাদরে গ্রহণ করে দাদাজিকে।
ব্যবসা খাতে অবদানের জন্য গেল বছর ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ‘পদ্মভূষণ’ পান গুলাতি। এখন তাঁর ছয় মেয়ে এমডিএইচের আঞ্চলিক পণ্য সরবরাহের দেখভাল করেন। আর সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করছেন তাঁর ছেলে।
এমডিএইচের পূর্ণ রূপ মাহাশায়াঁ দি হাট্টি। বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘মহাশয়ের দোকান’। দোকান রয়ে গেছে ঠিকই। তবে মহাশয় আর নেই।
সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া