মিসরীয়রা আশ্রয় খোঁজেন যে গুবরে পোকায়

মন্দিরের দেয়ালে আঁকা স্ক্যারাব
লেখক

২০১৯ সালে মিসর ভ্রমণের সময় লুক্সর শহরেও যাওয়া হয়েছিল। শহরের লুক্সর মন্দিরে (নির্মাণকাল খ্রিষ্টপূর্ব ১৪০০ অব্দ) ঘুরতে গিয়েই চোখে পড়েছিল একটি পোকার ভাস্কর্য। যার চারপাশে অনেক মানুষ ঘুরছিল। স্বভাবতই কৌতূহলী হলাম ভাস্কর্যটি সম্পর্কে জানতে।

আমার গাইড বললেন, এটি স্ক্যারাবের ভাস্কর্য। এই পোকাকে মিসরীয়রা ভাবে বদনজর আর অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার রক্ষাকবচ। এমন উপকথাই যুগে যুগে বিশ্বাস করে আসছে তারা। অনেকটা যেন আমাদের দেশে শিশুদের কপালে কাজল দিয়ে কালো গোল টিপ এঁকে দেওয়ার মতো। অনেকের বিশ্বাস, এতে শিশু কুনজর, অশুভ দৃষ্টি থেকে রক্ষা পায়!

লুক্সর মন্দিরে স্ক্যারাবের ভাস্কর্য
লেখক

গুগল করে জানতে পারি, স্ক্যারাব একধরনের গুবরে পোকা। ছয় পেয়ে শক্ত খোলসের পোকাটি দশমিক শূন্য ৮ থেকে ৬ দশমিক ৭ ইঞ্চি আকারের হয়ে থাকে। ওজনে ১০০ গ্রামের মতো। এই গুবরে পোকার দেখা মেলে ভূমধ্যসাগর, দক্ষিণ এবং পূর্ব ইউরোপের আরব উপদ্বীপে, তুরস্কের ক্রিমিয়াতে এবং অবশ্যই মিসরে। চকচকে প্রাণীটির উল্লেখ পাওয়া যায় আদি মিসরের প্রায় প্রতিটি হায়রোগ্লিফিক্স, পুরাকীর্তি আর ভাস্কর্যে। অলংকার, সিলমোহর ইত্যাদিতে পাওয়া যায় প্রতিকৃতিও। ফারাওদের সমাধিতে খোদাই করে, মমির সঙ্গে পোশাকে রাখা হতো এই ক্ষুদ্র পোকার প্রতিকৃতি। বহু মূল্যবান পাথর ও ধাতু দিয়ে স্ক্যারাবের আকৃতি তৈরি করত মিসরীয়রা।

ভ্রমণের সময় ১০০ ফ্যাক্টস, এইনসেন্ট ইজিপ্ট, অল অ্যাবাউট ইজিপ্টইজিপশিয়ান মিউজিয়াম বইগুলো সংগ্রহ করেছিলাম। বইয়ের পাতা থেকে জানতে পারি ভাস্কর্যের ইতিহাস।

এই ছোট গুবরে পোকা আসলে মিসরীয়দের প্রধান দেবতা আমুন রা-র প্রতীক। আমুন রা-র রয়েছে তিনটি রূপ, প্রথম রূপের নাম খেপরি (উষার দেবতা) দ্বিতীয় রূপটি রা স্বয়ং (দিনের দেবতা) সর্বশেষ রূপ ছিল সন্ধ্যার দেবতা (নাম আতুম)। মিসরের প্রাচীন অধিবাসীরা স্ক্যারাবকে উষার দেবতা খেপরির পবিত্র একটি রূপ মনে করে উপাসনা করত।

খেপরি রূপের সঙ্গে তারা পেয়েছিল স্ক্যারাবের জীবনচক্রের এক আশ্চর্য মিল। স্ক্যারাব, গোবরের ভেতরে ছোট ছোট ডিম পেড়ে রাখে‚ এরপর বলের মতো গুটি তৈর করে। ছোট গোবরের বলগুলোকে তারা পা দিয়ে ঠেলে মাটিতে গড়িয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যায়। মিসরীয়রা বিশ্বাস করত‚ উষার দেবতা খেপরি বিগত রাতের সূর্যের মৃত্যুর পর প্রতিদিন সকালে বৃত্তাকার নতুন সূর্যকে আকাশের গায়ে গড়িয়ে নিয়ে আসেন। আর এভাবেই নতুন দিনের সূচনা হয়। এর সঙ্গে স্ক্যারাবের ডিম গড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার সাদৃশ্য রয়েছে।

দেয়ালে আঁকা স্ক্যারাব

স্ক্যারাব বা এই গুবরে পোকাকে আমরা কেউ কেউ দেখেছি কিন্তু! সেটা হলিউডের বিখ্যাত দ্য মামি সিনেমায়। মিসরের এক অভিশপ্ত পুরোহিতের মমি নিয়ে শুরু হয়েছিল যার কাহিনি, সেখানে বেশ কয়েকটি জায়গায় দেখানো হয় কালো রঙের হাজারো গুবরে পোকা।

এখনো মিসরের শহরগুলোর স্যুভেনির শপে গলার লকেটে, হাতের আংটিতে, চাবির রিংয়ে, মিসরীয়দের ঐতিহ্যবাহী পোশাকে দেখতে পাওয়া যায় স্ক্যারাবের নানা প্রতিকৃতি। আমার ১২ দিনের মিসর ভ্রমণের সময় সব মন্দিরের দেয়ালের গায়ে স্ক্যারারের অঙ্কিত ছবি দেখতে পেয়েছি। এখনো মিসরের প্রাত্যহিক জীবনে স্ক্যারাব গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, মিসরীয়রা স্ক্যারাবের প্রতিকৃতি যেকোনো উপায়ে নিজেদের সঙ্গে রাখতে পছন্দ করে।