মৃতদের আবাসিক এলাকা

বেভারলি হিলস অব দ্য ডেড সমাধিক্ষেত্রের একটি সমাধি ভবন
লেখক

সমাধিস্থল বা কবরস্থান অনেক পর্যটকের অবশ্যই দেখার তালিকায় যুক্ত হয় ভ্রমণের শেষ বেলায়। বিষয়টা অনেকটা এমন, যদি ঘুরেফিরে বাড়তি সময় পাই, তবেই তা দেখব। কিন্তু ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলা ভ্রমণে গিয়ে আমার ‘মাস্ট সি’ তালিকায় ছিল দুটি সমাধিস্থল, যার একটি চীনাদের সমাধিক্ষেত্র।

এই সমাধিক্ষেত্র প্রতিষ্ঠা করা হয় ফিলিপাইনে স্পেনীয় ঔপনিবেশিক আমলে
লেখক

সমাধিস্থানটি ম্যানিলার শহরতলিতেই অবস্থিত। সেদিন সমাধিক্ষেত্রে থামতে হয়েছিল নির্দিষ্ট স্থানে, যেখানে গাড়ি রেখে গাইড আমাকে হেঁটে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু কয়েক কদম হাঁটার পরও ঠিক সমাধি দেখতে পেলাম না। তাই গাইডকে জিজ্ঞেস করলাম ‘সিমেট্রি তো দেখছি না, আরও কতটা পথ যেতে হবে আমাদের?’ তিনি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, ‘আমরা যে পথে হাঁটছি তার দুপাশে যা দেখছেন, এগুলোই সিমেট্রি।’ আমাদের চলতি পথের দুপাশে কারুকাজ করা সুসজ্জিত বাড়ি, কোনোটা দোতলা, কোনোটা তিনতলা। আমার মনে হচ্ছিল কোনো পরিকল্পিত আবাসিক এলাকায় হাঁটছি। যে এলাকার শেষ প্রান্তে হয়তো সমাধিক্ষেত্র শুরু। গাইড তখন স্মিত হেসে বলেন, এগুলোই সমাধি।

বাড়িগুলো শুধু সুসজ্জিতই নয়, আছে আধুনিক সুযোগ-সুবিধাও
লেখক

শান্ত ও সরু পথ ধরে হাঁটার সময় মনে হচ্ছিল বাড়িগুলো কেবল একেকটি সমাধি নয়, যেন সমাধিসৌধ। খোদাই করা স্মৃতি ভাস্কর্যগুলো যেন গল্প বলছে। পুরো জায়গাটিকে শহরের ভেতর আরেকটি শহর বলে মনে হচ্ছিল, ঠিক রোম শহরের ভেতর যেমন ভ্যাটিকান সিটি। সমাধিক্ষেত্র পরিভ্রমণের সময় আমার কাছে একই সঙ্গে সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক ও স্থাপত্যের এক অপূর্ব মেলবন্ধন মনে হচ্ছিল।

সমাধিস্থলের বাড়িগুলো চীনা স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত
লেখক

‘বেভারলি হিলস অব দ্য ডেড’ সিমেট্রির পোশাকি নাম। ইউরোপীয় পর্যটকদের কাছে নামটি বেশ জনপ্রিয়। ম্যানিলার এক স্থানীয় বাসিন্দার মুখে শুনেছিলাম, এটি এমন এক সমাধিক্ষেত্র, যেখানে জীবিতের চেয়ে মৃতরা ভালো ঘরে আছেন। ঘুরতে ঘুরতে মনে হচ্ছিল, তিনি একদম ঠিক বলেছেন। প্রত্যেকটি কবর একেকটি সাজানো বাড়ি। প্রতিটি বাড়িতে রান্নাঘর, গোসলখানা, শয়নকক্ষ দেখলাম। সমাধিস্থদের আত্মীয়রা অনেক সময় এসব বাড়িতে এসে থাকেন, প্রিয়জনের ‘সান্নিধ্য’ নেন।

ইতিহাসের পাতায়

সমাধিস্থ ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরা সমাধিভবনে সময় কাটাতে পারে
লেখক

সমাধিস্থলটি এখন ম্যানিলা সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন। ফিলিপাইনে স্পেনীয় ঔপনিবেশিক আমলে এই সমাধিক্ষেত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। চীনা বণিক সম্প্রদায়কে ক্যাথলিক কবরস্থানে সমাহিত করতে বারণ করা হয়েছিল বলে তখনকার বিত্তশালী চীনা পরিবারগুলো তাদের প্রিয়জনকে এখানে সমাধিস্থ করতে শুরু করে।

সমাধিভবনের সামনে চীনের ঐতিহ্যবাহী প্রতীক—ড্রাগন
লেখক

চীনারা প্রাচীনকাল থেকে বিশ্বাস করে, আত্মা অবিনশ্বর। সেই আত্মা যেন পার্থিব সমস্ত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য উপভোগ করতে পারে, সে জন্য এমন স্থাপত্যশৈলীর বাড়ি নির্মাণ করা। বাড়িগুলো শুধু সুসজ্জিতই নয়, আছে আধুনিক সুযোগ-সুবিধাও। যেমন গরম এবং ঠান্ডা জলের ব্যবস্থা, ফ্লাশিং টয়লেট, বিদ্যুৎ, রান্নাঘর, খাবারের জায়গা এমনকি অতিথি কক্ষও। কিছু সমাধিভবনের সামনে আছে শোভাময় বাগান। রোববার ছাড়াও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পরিবার সমাধিভবনে সময় কাটাতে আসে। সেখানেই তারা খাবার রান্না করে, মৃত ব্যক্তির স্মরণে খালি চেয়ার রেখে ঐতিহ্যগত খেলার আয়োজন করে।

দেশে ও বিদেশে অনেক সমাধিক্ষেত্রে আমি ভ্রমণ করেছি। কিন্তু ম্যানিলায় চীনাদের এই সমাধিস্থল যে এক ব্যতিক্রম অভিজ্ঞতা ছিল, তা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না!