যুদ্ধের সময় ছেলেশিশু বেশি জন্মায় কেন

পৃথিবীর অঞ্চলভেদে নারীর সংখ্যা
ছবি: সংগৃহীত

স্বাভাবিক সময়ে প্রতি ১০০টি মেয়েশিশুর বিপরীতে ১০৭টি ছেলেশিশু জন্ম নেয়। এ তথ্য দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। শত শত বছর ধরেই ছেলেশিশুর জন্মহার মেয়েশিশুর তুলনায় বেশি। যেহেতু পুরুষের মৃত্যুহার নারীর তুলনায় বেশি, তাই ছেলেশিশুর জন্মহার বেশি হওয়াকে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা হিসেবে ব্যাখ্যা করেন অনেকে। তবে বহু বছর ধরে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন দেশের শিশু জন্মহারের ওপর জরিপ চালিয়ে দেখেছেন, যুদ্ধ ও যুদ্ধ–পরবর্তী সময় সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে ছেলেশিশুর জন্মহার উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি থাকে।

এ তথ্যে নানান প্রশ্ন সামনে চলে আসে নিঃসন্দেহে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এর কোনো বিজ্ঞানসম্মত উত্তর খুঁজে পাচ্ছিলেন না। যদিও এটা নিয়ে বেশ কিছু তত্ত্ব প্রচলিত আছে। যেমন অনেকে মনে করেন, যুদ্ধে নিহত পুরুষ সৈন্যদের শূন্যস্থান পূরণে এটা প্রকৃতির এক ভারসাম্য রক্ষার প্রয়াস। আবার অনেকে মনে করেন, যুদ্ধফেরত সৈন্যরা দীর্ঘদিন পর সঙ্গীদের কাছে পেয়ে তুলনামূলক বেশি ঘনিষ্ঠ হয়; ফলে ওই নারী সঙ্গীদের ডিম্বাণু নিষিক্ত হওয়ার সম্ভাবনা যায় বেড়ে। এবং সেই সঙ্গে ছেলেশিশু জন্মের হারও বেড়ে যায়। একে বলা হয় ‘রিটার্নিং সোলজার ইফেক্ট’। কিন্তু ‘ইভল্যুশনারি বায়োলজি’ জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তত্ত্বগুলোকে খারিজ করে দেওয়া হয়েছে। এ গবেষণায় দেখা গেছে, ব্যক্তির পারিবারিক ইতিহাস কীভাবে সন্তানের লিঙ্গ সম্পর্কে ধারণা দিতে পারে।

যুক্তরাজ্যের নিউক্যাসল ইউনিভার্সিটির গবেষক কোরি জিলাটলি তাঁর পিএইচডি নিবন্ধের অংশ হিসেবে একটি গবেষণা চালিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘দম্পতিরা বেশি শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করছে বলেই ছেলেশিশু বেশি হয়, এ তত্ত্ব আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না।’

জাপানের বিপক্ষে যুদ্ধজয়ের পর যুক্তরাষ্ট্রের টাইম স্কয়ারে এক মার্কিন নাবিক ও সাদা পোশাক পরা নারীর এই ছবি ‘আইকনিক’ হয়ে উঠেছে
ছবি: আলফ্রেড আইজেনস্টিড

পুরুষ চিংড়ি, পুরুষ কীট এবং মানব পুরুষের ওপর চালানো বিভিন্ন গবেষণা নজর কেড়েছিল কোরি জিলাটলির। ওই গবেষণাগুলোতে দেখা গিয়েছিল, কোনো দম্পতির সন্তানের লিঙ্গ কী হবে, তা নির্ভর করে পুরুষ সঙ্গীর মা–বাবার সন্তানদের লিঙ্গের ওপর। অর্থাৎ কোনো পুরুষের সন্তানের লিঙ্গ কী হবে, তা নির্ভর করে তার ভাই-বোনের সংখ্যা ওপর। আরও সহজ করে বললে, কোনো পুরুষের যদি বোনের তুলনায় ভাইয়ের সংখ্যা বেশি থাকে, তাহলে তার নিজের ক্ষেত্রে মেয়ের তুলনায় ছেলেসন্তান হওয়ার প্রবণতা বেশি। এ প্রবণতার সঙ্গে যুদ্ধকালীন বেশি ছেলেশিশু জন্মের কোনো সম্পর্ক আছে কি না, তা যাচাই করার জন্য জিলাটলি উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপের ৯২৭টি পরিবারের পারিবারিক ইতিহাস নিয়ে গবেষণা চালান। ওই পরিবারগুলোর প্রতি প্রজন্মের সদস্যদের লৈঙ্গিক অনুপাত লিপিবদ্ধ করেন তিনি।

জিলাটলি বলেন, ‘এসব পরিবারের পারিবারিক ইতিহাস গবেষণা করে দেখা গেছে, সন্তান ছেলে হবে নাকি মেয়ে, সেটা অনেকটাই উত্তরাধিকারসূত্রে নির্ধারিত। আমরা এখন জানি, যেসব পুরুষের ভাইয়ের সংখ্যা বেশি, তাদের ছেলেসন্তান বেশি। যদিও নারীদের ক্ষেত্রে এ প্রবণতা লক্ষণীয় নয়।’

আমরা জানি, পুরুষের দুটি ক্রোমোজোম—XY। জিলাটলি মনে করেন, পুরুষের বীর্যের কত অংশ X ক্রোমোজোম এবং কত অংশ Y ক্রোমোজোম বহন করবে, সেটি মূলত নির্ভর করে একটি জিনের ওপর। এ জিন নারী–পুরুষ উভয়েরই আছে, তবে পুরুষেরটি সক্রিয়। নারীর দুটি ক্রোমোজোমই যেহেতু XX, তাই পুরুষের বীর্যের XY ক্রোমোজোমই সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণ করে। তাই যত বেশিসংখ্যক Y ক্রোমোজোম থাকবে, সন্তান ছেলে (XY) হওয়ার প্রবণতা তত বেশি।

১৯৪০ সালের সেপ্টেম্বরে ব্যাটল অব ব্রিটেনের সময় লন্ডনের পূর্বাঞ্চলের এক শহরতলিতে ঘরহীন তিন শিশু
ছবি: রয়টার্স

কিন্তু এ মডেল কীভাবে যুদ্ধ ও যুদ্ধ–পরবর্তী সময়ে ছেলেশিশুর জন্ম বেশি হওয়াতে প্রভাব রাখে? উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যেতে পারে। জন ও রিচ নামের দুজনের কথা চিন্তা করা যাক। জনের তিন ছেলে, যারা সবাই যুদ্ধে গেছে এবং তার আরেকটি মেয়ে আছে, যে যুদ্ধে যায়নি। অন্যদিকে রিচের পারিবারিক কাঠামো বিপরীত—তিন মেয়ে, এক ছেলে। জনের ছেলে যেহেতু তিনজন, তাই তার ছেলেদের মধ্যে কারও না কারও যুদ্ধ থেকে বেঁচে ফেরার সম্ভাবনা বেশি। এবং তারা যেহেতু ছেলে, তাই তাদের ক্রোমোজোমে Y–এর উপস্থিতি থাকবেই। ফলে এ পরিবার থেকে তুলনামূলক বেশি ছেলে সন্তানের জন্ম হবে। রিচের যেহেতু এক ছেলে, তাই সে মারা গেলেই রিচ ছেলেশূন্য হয়ে পড়বে। আর যদি যুদ্ধে তার ছেলে বেঁচেও যায়, তাহলেও আনুপাতিক দিক থেকে এ পরিবারে মেয়েশিশুর হার বেশি হবে। জিলাটলির মডেল অনুসারে এতে ছেলে ও মেয়ের জন্মের আনুপাতিক হার স্বাভাবিক অবস্থায় আসবে।

সূত্র: পপুলার সায়েন্স