যে কারণে দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ দেখতে হাজির হয়েছিল ৪০ হাজার দর্শক

ট্রেন দুটি যখন মুখোমুখি
জিআইএফ: একটু থামুন

১৮৯৬ সাল। যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে এবং তার চরম প্রভাব পড়েছে রেল খাতের ওপরেও। মানুষের চাকরিবাকরি নেই এবং তারা কোথাও ভ্রমণও করছে না। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য মিসৌরি, কানসাস ও টেক্সাস রেল কর্তৃপক্ষ (KATY নামে বেশি পরিচিত) যৌথভাবে এমন কিছু করার পরিকল্পনা করে, যাতে রেলে যাত্রীচাহিদা আবার আগের মতো বৃদ্ধি পায়।

ক্যাটির একজন যাত্রীপ্রতিনিধি উইলিয়াম জর্জ ক্রাশ তখন এক উদ্ভট পরিকল্পনা পেশ করেন। কর্তৃপক্ষকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে তাঁর পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করলে রেলের সুদিন ফিরতে সময় লাগবে না। এটা মানতেই হবে যে ক্রাশের ওই পরিকল্পনাটি ইতিহাসের বেপরোয়া, উদ্ভট এবং বিধ্বংসী পরিকল্পনাগুলোর অন্যতম। তো ক্রাশ কী প্রস্তাব দিয়েছিলেন? তিনি বলেছিলেন, দর্শকের সামনে দুটি চালকবিহীন ট্রেনের মধ্যে তীব্র বেগে মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটাতে হবে! ক্রাশের পরিকল্পনা বলে কথা! নামের সঙ্গে ভাবনার কী মিল দেখুন! বুঝতেই পারছেন, মূলত পাবলিসিটি স্টান্ট বা লোকদেখানো সাজানো ঘটনার পরিকল্পনাই ছিল সেটি।

আমেরিকান রেলরোডস: ডিক্লাইন অ্যান্ড রেনেসাঁ ইন দ্য টোয়েন্টিথ সেঞ্চুরি বইয়ের লেখক রবার্ট গ্যালামোর বলেন, টেক্সাস শহরে যখন দুটি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষের এই পাবলিসিটি স্টান্ট আয়োজন করা হয়, তখন যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ট্রেন তুমুল জনপ্রিয় এবং ক্যাটির জনপ্রিয়তাও তখন বাড়তির দিকেই ছিল। তবে এই পাবলিসিটি স্টান্টের কারণে ক্যাটির জনপ্রিয়তা আরও বেড়ে গিয়েছিল।

১৮৯৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বরের ওই আয়োজনের পোস্টার
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

রেলের জনপ্রিয়তা তখন ঊর্ধ্বমুখী ছিল সত্যি, কিন্তু একই সঙ্গে এ খাতকে তীব্র প্রতিযোগিতারও মুখোমুখি হতে হচ্ছিল। দুটি ট্রেনের ইচ্ছাকৃত সংঘর্ষের মতো একটি পাবলিসিটি স্টান্ট করার পেছনে এটাও একটা কারণ ছিল। শুধু একটা ভয় ছিল যে সংঘর্ষে ইঞ্জিনের বয়লার বিস্ফোরিত হবে কি না। একজন প্রকৌশলী ছাড়া বাকি সবাই বলেছিলেন, বয়লার বিস্ফোরণের ঝুঁকি নেই। ব্যস, ক্যাটির বোর্ড সদস্যরা অনুমতি দিয়ে দিলেন। ঘটনা কিংবা দুর্ঘটনা ঘটানোর স্থান হিসেবে বেছে নেওয়া হলো টেক্সাসের ম্যাকলেলান কাউন্টির এক এলাকাকে। এক দিনের জন্য এলাকাটির নাম দেওয়া হলো ‘ক্রাশ (Crush)’। ১৮৯৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বরের এ সংঘর্ষ ইতিহাসে ‘ক্র্যাশ অ্যাট ক্রাশ’ (Crash at Crush) নামে পরিচিত। পরিকল্পনা হাতে নেওয়ার পরপরই পুরো টেক্সাস, মিসৌরি ও আশপাশের অঞ্চলে খবরটি ছড়িয়ে পড়ে। ক্যাটি কর্তৃপক্ষ ট্রেনের ভাড়া কমিয়ে মাত্র দুই ডলার করে, যাতে আরও বেশি মানুষ সংঘর্ষটি সরাসরি দেখতে ঘটনাস্থলে আসতে পারে।

ক্যাটি কর্তৃপক্ষ ট্রেনের ভাড়া হাঁকে মাত্র দুই ডলার
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

শেষমেশ প্রায় ৪০ হাজার মানুষ দুটি ট্রেনের সংঘর্ষ দেখতে ঘটনাস্থলে হাজির হয়। মাত্র এক দিনের জন্য টেক্সাসের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহরে এত বড় এক আয়োজনের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এত বিশালসংখ্যক দর্শককে ঠিকঠাক নিয়ন্ত্রণ করার কোনো ব্যবস্থা কিন্তু কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করেনি।

যাহোক, ক্যাটি কর্তৃপক্ষ সংঘর্ষ ঘটানোর জন্য তিন মাইল লম্বা একটি অস্থায়ী রেললাইন স্থাপন করে। মুখোমুখি দুটি ট্রেনের একটি ছিল ৩৫ টনের লোকোমোটিভ, যার ইঞ্জিন নম্বর ছিল ৯৯৯ এবং অপরটি ছিল ৩৫ টনের আরেকটি লোকোমোটিভ, যার ইঞ্জিন নম্বর ছিল ১০০১। দুটি ট্রেনের সঙ্গেই ছিল ৬টি করে বগি।

সংঘর্ষের আগে ফটোসেশনে ট্রেন দুটি
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

পুরো আয়োজনটিকে আরও উৎসবমুখর করতে ঘটনাস্থলে বসানো হয়েছিল অস্থায়ী রেস্তোরাঁ ও জুসবার। স্টেশন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হয়েছিল রেললাইন থেকে দুই হাজার ফুট দূরে। ভিআইপি অতিথিদের জন্য ছিল আলাদা বসার ব্যবস্থা।

কিন্তু দুটি ৩৫ টনের লোকোমোটিভ ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ কেমন ধ্বংসাত্মক হতে পারে, সে ব্যাপারে অনেকেরই কোনো ধারণা ছিল না।

সংঘর্ষের ছবি তোলার পরপরই আলোকচিত্রী জার্ভিস ডিন চোখে আঘাত পান
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

বিকেল ঠিক চারটায় দুপাশ থেকে ট্রেন দুটি সর্বোচ্চ বেগে চালু করেন দুজন চালক। ট্রেনের গতি ঘণ্টায় ১০ মাইল স্পর্শ করার পর উভয় চালকই ঝাঁপ দিয়ে ট্রেন থেকে নেমে যান। খুব দ্রুতই ট্রেনগুলোর গতি ঘণ্টায় ৫০ মাইলে পৌঁছায় আর কিছুক্ষণ পরই ঘটে ‘কাঙ্ক্ষিত’ সেই সংঘর্ষ!

বিস্ফোরিত হয় ট্রেনের বয়লার
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

টেক্সাস স্টেট টেকনিক্যাল কলেজের পদার্থবিদ রন মিলার বলেন, ট্রেনগুলোর ভর এবং গতি প্রায় সবারই জানা ছিল। তারপরও যে তীব্র সংঘর্ষ হয়েছিল, সেটি ছিল অনেকের কাছেই আশ্চর্যের ব্যাপার।

সংঘর্ষের পর অনেকের আশঙ্কা সত্যি প্রমাণ করে ইঞ্জিনের বয়লার বিস্ফোরিত হয়। ঘটনাস্থলেই মারা যান দুজন এবং আহত হন অনেকেই। উইলিয়াম জর্জ ক্রাশকে তৎক্ষণাৎ চাকরিচ্যুত করা হয়।

সংঘর্ষের পর দর্শকের ভিড়
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

দুজন দর্শকের মৃত্যু নিয়ে যে হুলুস্থুল হওয়ার কথা ছিল, সেটি অবশ্য আর হয়নি। বরং দুঃসাহসিক আয়োজনটি ঘিরে মানুষের উচ্ছ্বাস এবং একেবারে ভিন্ন অভিজ্ঞতার কথাই ব্যাপকভাবে প্রচার পায়। ফলে ক্যাটির যাত্রীসংখ্যাও দ্রুত বাড়তে শুরু করে।

সংঘর্ষের স্থানে স্মৃতিফলক ও ডানে উইলিয়াম জর্জ ক্রাশ
ছবি: সংগৃহীত

পাবলিসিটি স্টান্টটি ব্যবসায়িক সাফল্য পাওয়ায় চাকরিচ্যুত হওয়ার অল্প কিছুদিন পরই জর্জ ক্রাশকে আবার নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে ব্যবসায়িক সাফল্য পেলেও কোনো দেশ বা সংস্থাই আর কখনো তেমন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।

টেক্সাসে জন্ম নেওয়া বিখ্যাত পিয়ানোবাদক ও সুরকার স্কট জপলিন ১৮৯৬ সালের ওই সংঘর্ষের স্মরণে পিয়ানোতে একটি সুর তুলেছিলেন। ‘গ্রেট ক্রাশ কলিশন মার্চ’ শিরোনামের ওই সুরটি শুনতে পারেন এখানে...

সূত্র: ওয়াকোহিস্ট্রি ডটওআরজি

আরও পড়ুন