যে বাজারে মাকড়সাভাজা যেন মুড়িমুড়কি

স্পাইডার মার্কেটে ক্রেতা–বিক্রেতা ও স্রেফ দর্শনার্থীর সমাগম
লেখক

আমাদের পার্বত্য অঞ্চলে বাঁশ যে সবজি হিসেবে দারুণ জনপ্রিয়, সে কথা আমি জেনেছিলাম অনেক দেরিতে। মিয়ানমার ভ্রমণে গিয়ে দেখেছি, চা-পাতার সালাদ দারুণ জনপ্রিয় এক খাবার। জাপানে গিয়ে কাঁচা মাছ পাতে তোলার অভিজ্ঞতা হয়েছে। ভিয়েতনাম ও চীনের স্ট্রিট ফুড তো পর্যটকদের কাছে অতি লোভনীয়। পুরো আফ্রিকাতেও বিচিত্র খাদ্য গ্রহণের ঐতিহ্য চলে আসছে বহুকাল ধরে। মোট কথা, বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন অঞ্চল ও জাতিভেদে খাদ্যাভ্যাস বিচিত্র।

তবে চা অথবা পানীয়ের সঙ্গে মুড়িমুড়কির মতো মজা করে পোকামাকড় খেতে দেখেছি কম্বোডিয়া ভ্রমণে গিয়ে। তার আগে ২০১২ সালে ব্যাংকক শহরে প্রথমবারের মতো ছোট ছোট পতঙ্গ ভেজে বিক্রি করতে দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছিল বটে। তবে তা খুব স্বল্প পরিসরে। কাজেই কম্বোডিয়ার স্পাইডার মার্কেটে ঘুরে আসার অভিজ্ঞতা না বললেই নয়।

কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেন শহরে দুই দিন ঘোরাঘুরি শেষ করে খুব সকালে রওনা করেছিলাম সিয়াম রিপ শহরের দিকে। গাড়িতে চড়ে বসতে বসতে গাইড বললেন, ‘আমাদের আট ঘণ্টার মতো সময় লাগবে। পথে আমরা দুটি জায়গায় বিরতি দেব—একটি স্পাইডার মার্কেটে, অন্যটি পুরোনো এক শহরে।’ গাইডের কথায় বুঝলাম, তিনি আমার পুরোনো শহরপ্রীতির কথা ইতিমধ্যে জেনে গেছেন।

দেখতে আচারের মতো, আদতে আচার নয়
উইকিপিডিয়া

প্রায় ঘণ্টা দেড়েক ড্রাইভ করার পর হাইওয়ের পাশে এক বাজারের গিয়ে থামল আমাদের গাড়ি। দূর থেকে দেখে বাজারটিকে আহামরি কিছু মনে হচ্ছিল না। ছোট শহরের আর দশটা বাজারের মতোই। তবে কয়েক কদম ভেতরে যেতেই আক্কেলগুড়ুম। কাঁধে ট্রে নিয়ে অল্প বয়সী এক মেয়েকে এগিয়ে আসতে দেখলাম। ভালো করে খেয়াল করে দেখি, ওর ট্রেতে চকচক করছে গাবদাগোবদা আরশোলার ভাজা। মেয়েটি ওর পণ্যসম্ভার দেখিয়ে হাসিমুখে বলল, ‘ইউ ক্যান ট্রাই ইট! ইট ইজ ভেরি টেস্টি।’

আমার কাছে মনে হলো, বাংলাদেশের কোনো বাদাম বিক্রেতা মেয়েকে দেখছি। কিন্তু কাঁধের ওপরের ওই ট্রের আরশোলা দেখে কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। আমার আমতা আমতা ভাব দেখে গাইড স্থানীয় ভাষায় মেয়েটিকে কী যেন বললেন। মেয়েটি দূরে সরে গেল।

স্পাইডার মার্কেটের দোকানগুলো নারীরাই চালায়
লেখক

মেয়েটি চলে যেতেই মামুলি বাজারটা হঠাৎ করে আমার কাছে বিচিত্র ঠেকতে শুরু করল। কারণ, বাজারের একটা পাশে মাকড়সা, ব্যাঙাচি, কাঠবিড়ালি, রেশমপোকা, ঝিঁঝিপোকা, আরশোলা, ঘাসফড়িংসহ আরও নানা জাতের পোকামাকড় ভাজি করে বিক্রি করা হচ্ছে। একেক দোকান আবার একেক প্রাণী-পতঙ্গের পসরা সাজিয়ে বসেছে। মজার বিষয় হলো, প্রতিটি দোকানের বিক্রেতাই বিভিন্ন বয়সী নারী। যাঁরা ফেরি করে মাকড়সাভাজা বিক্রি করছেন, তাঁরাও নারী। বাজারের অন্য পাশে ফলমূল আর সবজিও অবশ্য বিক্রি হচ্ছিল।

এই সেই মাকড়সাভাজা
লেখক

প্রশ্ন আসতে পারে, কম্বোডিয়ার মানুষ কেন পতঙ্গ আর প্রাণীগুলো খাবার হিসেবে পাতে তুলে নিল? খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল, এই ঐতিহ্য প্রাচীন নয়। এর পেছনে আছে বিশেষ কারণ। আমার গাইড জানালেন, ১৯৭৫ সালে কুখ্যাত খেমাররুজ বাহিনী যখন কম্বোডিয়া দখল করে নেয়, তখন খাদ্যের অভাব দেখা দেয় মারাত্মক আকারে। ফলে তখন থেকেই মানুষেরা এ-জাতীয় খাবার পাতে তুলে নেয় বাধ্য হয়ে। আর পরে তা পরিণত হয় অভ্যাসে। বেশ কবছর আগে টেলিভিশনের খবরে দেখেছিলাম, ভারতের বিহার রাজ্যের কোনো এক গ্রামের লোকজন খিদের তাড়নায় ইঁদুর খেতে শুরু করেছিল।

এটা হলো ঝিঁঝিপোকার কুড়মুড়ে ভাজা
লেখক

বুঝতেই পারছেন, কম্বোডিয়ায় মাকড়সাভাজা দারুণ জনপ্রিয় এক খাবার। দেশটির পর্যটনের সঙ্গেও এই খাবার যুক্ত হয়েছে দারুণভাবে। চোখের সামনেই নানান দেশের পর্যটকদের দেখলাম স্পাইডার মার্কেটে সাগ্রহে ভিড় জমিয়েছেন। কম্বোডিয়ানরা তো বলে, ‘আমাদের দেশে ভ্রমণে এসে অ্যাংকর ওয়াত মন্দির দেখার পাশাপাশি স্পাইডার মার্কেটে ঢুঁ না মারলে ভ্রমণটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।’

আমি অবশ্য ভ্রমণ অসম্পূর্ণ রাখার পক্ষপাতী নই। স্পাইডার মার্কেটে যখন ঢুকেছি, তখন সব চোখ মেলে দেখতে হবে। কাজেই প্রায় প্রতিটি দোকানের সামনে উঁকি মারলাম। এক নারী দোকানি মাকড়সাভাজা দেখিয়ে বললেন, ‘মাকড়সা খেতে অনেকটা কাঁকড়ার মতো। তবে আপনি যখন গিলতে যাবেন, তখন এর স্বাদ কিছুটা তেতো লাগবে।’

বর্ণনা শুনে বেশি কথা বাড়ালাম না। হেঁটে অন্য দোকানের দিকে গেলাম। মাকড়সা বাজারের বিচিত্র সব খাবার খাওয়ার সাহস তো আমার ছিল না, কাজেই খাবি খাওয়া ছাড়া উপায় কী! তবে ফেরার সময় পোকামাকড়ের বাজার থেকে এক ডজন কলা কিনে গাড়িতে উঠলাম। মাঝপথে খিদে পেলে একটা কিছু খেতে হবে তো!