রোগা হতে চেয়েছিলেন রোগা করে দিয়েছি

নাসিরুদ্দিন হোজ্জার জন্ম তুরস্কে ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে। নানা চরিত্রে ও পেশায় তাঁকে তাঁর কয়েক শ গল্পে হাজির হতে দেখা যায়। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, হোজ্জা এখন আর তুরস্কের নন, সারা বিশ্বের। ইউনেসকো তাঁর গল্পগুলোকে বিশ্বসাহিত্যিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দিয়েছে। হোজ্জা অবশ্য একেক অঞ্চলে একেক নামে অভিহিত। যেমন উজবেকিস্তান ও চীনে তিনি আফেন্দি বা এফেন্দি। তাঁর গল্প কখনো নির্মল হাস্যকৌতুকে, কখনো বুদ্ধির ঝলকে, কখনো বা নৈতিক শিক্ষার দ্যুতিতে উজ্জ্বল। কখনো নিজেকে নিজেই ব্যঙ্গ করেছেন।

রোগা হতে চেয়েছিলেন রোগা করে দিয়েছি

একসময় চিকিৎসক হিসেবে নাসিরুদ্দিনের বেশ সুনাম ছিল। একদিন গ্রামের জমিদার এলেন তাঁর কাছে। বললেন, ‘বড় মুটিয়ে যাচ্ছি নাসিরুদ্দিন, মেদ কমাতে চাই। একটু ওষুধ দাও।’

নাসিরুদ্দিন অনেকক্ষণ ধরে তাঁর দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘ওষুধ আমি দেব না। দিন আপনার ফুরিয়ে এসেছে। দিন পনেরোর মধ্যেই আপনি মারা যাবেন।’

ভয়ে-ভাবনায় জমিদার টলতে টলতে বাড়ি ফিরে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। খাবারে তাঁর রুচি নেই। চা অত ভালোবাসতেন, সেই চা-ও আর ভালো লাগে না। ঘুম আসে না। চোখে সামান্য একটু তন্দ্রামতো এলেও ক্ষণে ক্ষণে চমকে ওঠেন দুঃস্বপ্নে। মোসাহেব-ইয়ার-বন্ধুপরিবৃত হয়ে আড্ডা মারা, গল্পগুজব করাতেও তাঁর আর অভিরুচি নেই। তাড়াতাড়ি হারিয়ে গেল সেই উজ্জ্বল দিনগুলো! দেহখানা শুকিয়ে প্রায় কাঠ।

পনেরোটা দিন কাটিয়ে, বিপৎসীমা অতিক্রম করে জমিদার এলেন নাসিরুদ্দিনের কাছে। বললেন, ‘এদিকে আয় ব্যাটা হাতুড়ে ডাক্তার, দ্যাখ, বহাল তবিয়তে আমি তোর সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। পনেরো দিন পরে আপনি মারা যাবেন—কী আমার গণক ঠাকুর রে!’

নাসিরুদ্দিন বললেন, ‘রাগ করবেন না, জমিদার হুজুর। নিজের শরীরের দিকে চেয়ে দেখুন। রোগা হতে চেয়েছিলেন, রোগা করে দিয়েছি। এখন চিকিৎসাবাবদ পারিশ্রমিকের টাকাটা দিয়ে দিন।’

এক নম্বর বেকুব

পারস্য দেশের কয়েকজন ব্যবসায়ী এসেছেন দরবারে বাদশাহর পছন্দসই ঘোড়া বিক্রি করতে। বাদশাহ বেশ কিছু ভালো ঘোড়া কিনলেন। এর চেয়েও ভালো ঘোড়া তাঁদের দেশে আছে শুনে বাদশাহ তাঁদের এক শ মোহর অগ্রিম দিলেন। এ ঘটনার দিন কয়েক পর বাদশাহ নাসিরুদ্দিন হোজ্জাকে হুকুম দিলেন, তাঁর রাজ্যে যত বোকা, কম বুদ্ধির লোক আছে, তাদের একটা তালিকা প্রস্তুত করতে। দুদিন প্রচণ্ড খেটেখুটে হোজ্জা ছাব্বিশ পাতার একটা তালিকা প্রস্তুত করলেন। সেই তালিকার ওপর চোখ বোলাতেই বাদশাহ দেখলেন, তাতে সবার প্রথমে তাঁর নিজের নাম।

‘সে কী মোল্লা, আমার নাম সবার প্রথমে কেন?’

‘বাহ্‌ রে, অজানা-অচেনা ইরানি ব্যবসায়ীদের সম্বন্ধে কোনো কিছু না জেনেই এককথায় এতগুলো মোহর যিনি অগ্রিম দেন, তাঁকে তো বেকুবদের তালিকায় প্রথমেই রাখতে হবে।’

‘আর, তারা যদি সত্যি সত্যি ভালো ঘোড়া নিয়ে হাজির হয়, তাহলে?’ বাদশাহ আশান্বিত হয়ে বলেন।

‘হুজুর, তাহলে আর কি, তাহলে ওই তালিকার প্রথম বেকুব আপনার নাম কেটে, তাদের নামই বসিয়ে দেব’, মোল্লা নাসিরুদ্দিন বললেন।

সূত্র: আখতার হুসেনের সংকলন ও সম্পাদনায় প্রথমা প্রকাশনের নাসিরুদ্দিন হোজ্জার ১০০ গল্প বই থেকে