শপিং কার্ট যেভাবে জীবন সহজ করে দিল

শপিং কার্ট দূর করেছে পণ্য বহনের হ্যাপা
ছবি: প্রথম আলো

সুপারশপে ঢোকার পর প্রথমেই আমরা কী করি? বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একটা শপিং কার্ট টেনে নিই। সুপারশপের তাকে পণ্য সাজানো থাকে থরে থরে। আমরা ওই সাজানো পণ্যের পাশ দিয়ে হাঁটি আর প্রয়োজনীয়গুলো রাখি কার্টে। এই শপিং কার্ট বা ট্রলি সুপারশপে বাজার করার ক্ষেত্রে যোগ করেছে আলাদা মাত্রা। দূর করেছে পণ্য বহনের হ্যাপা। শপিং কার্টের ব্যবহার আরেক জায়গায় খেয়াল করেছেন নিশ্চয়ই। বিভিন্ন ই-কমার্স ওয়েবসাইটে পণ্য কেনার জন্য ক্লিক করলেই একটা কার্টের আইকন দেখা যায়। কখনো কি মনে হয়েছে, এই শপিং কার্ট কীভাবে এল?

নিজের উদ্ভাবিত কার্ট হাতে সিলভান ন্যাথান গোল্ডম্যান (বাঁয়ে) এবং তাঁকে নিয়ে লেখা বইয়ের প্রচ্ছদ
ছবি: সংগৃহীত

শপিং কার্টের কেতাবি নাম ‘হুইলড শপিং কার্ট’। ১৯৩৭ সালে এই কার্ট উদ্ভাবন করেন সিলভান ন্যাথান গোল্ডম্যান (১৮৯৮–১৯৮৪)। যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমায় ‘হাম্পটি ডাম্পটি’ নামের এক চেইন গ্রোসারি শপ ছিল তাঁর। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রে বড় বড় দোকানে ‘সেলফ সার্ভিস’ চালু হয়ে গেছে। গোল্ডম্যান খেয়াল করেছিলেন, হাতে বহনযোগ্য ছোট ঝুড়ি নিয়ে বাজার করতে ক্রেতাদের বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল। ১৯৮৪ সালের ২৭ নভেম্বর নিউইয়র্ক টাইমসকে গোল্ডম্যান বলেছিলেন, ‘যখনই ওই ঝুড়িটা ভরে যেত, ক্রেতারা আর কিছু কিনতে চাইত না।’

১৯২০–এর দশকে সুপারমার্কেট কোম্পানি ‘পিগলি উইগলি’ তাদের দোকানগুলোতে ক্রেতাদের জন্য সেলফ সার্ভিস চালু করে। অন্য যে দোকানগুলো পরে তাদের অনুসরণ করতে শুরু করে, ‘হাম্পটি ডাম্পটি’ তাদের অন্যতম।

পেটেন্টে গোল্ডম্যানের শপিং কার্টের নকশা
ছবি: সংগৃহীত

প্রথমে শপিং কার্টের বেশ কিছু মডেল নিয়ে ভাবতে শুরু করেছিলেন গোল্ডম্যান। একটা ভাঁজ করা চেয়ারের মতো কাঠামোর নিচে যুক্ত করেছিলেন চাকা। পরে সেই চেয়ারের ওপরে এবং নিচে যোগ করেন আরও দুটি কার্ট বা বাক্স। দুটি কার্টেই পণ্য রাখা যেত। পরবর্তী সময়ে কার্ট ঠেলার সুবিধার্থে যোগ করা হয় হাতল। কার্টগুলো যখন ব্যবহার করা হতো না, তখন রাখা হতো ভাঁজ করে। ফলে সুপারশপগুলো এক জায়গায় একসঙ্গে অনেক কার্ট রাখতে পারত।

১৯৫৫ সালের লাইফ ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ (বাঁয়ে) এবং গোল্ডম্যানের প্রথম শপিং কার্ট
ছবি: সংগৃহীত

১৯৪০ সালে গোল্ডম্যান শপিং কার্টের পেটেন্ট নেন। প্রথম দিকে ক্রেতারা একে সাদরে গ্রহণ করেননি। নারীরা মনে করতেন, তাঁরা যেহেতু সন্তানদের জন্য আলাদা ট্রলি ব্যবহার করেন, তাই শপিংয়ের সময় আরেকটা ট্রলি বা কার্ট ‘বোঝার ওপর শাকের আঁটি’ হয়ে যাবে। আর পুরুষেরা মনে করতেন, শপিং করতে এসে কার্ট ঠেলাটা ঠিক তাঁদের সঙ্গে যায় না!

গোল্ডম্যানের তিন কৌশল

সার্বিক অবস্থা দেখে গোল্ডম্যান একটা বিজ্ঞাপন নির্মাণ করেছিলেন। বিজ্ঞাপনে দেখা গিয়েছিল এক ক্লান্ত নারীকে। যিনি এক হাতে নিজের ব্যাগ আর অন্য হাতে ঝুড়ি নিয়ে শপিং করছেন। কিন্তু ওই নারী এতটাই ক্লান্ত ছিলেন যে মনে হচ্ছিল তিনি ঝুড়িটা হাত থেকে রাখতে পারলেই বাঁচেন! বিজ্ঞাপনের শেষে লেখা ছিল, ‘আদর্শ দোকানে এ ধরনের সমস্যা নেই।’

শপিং কার্ট জনপ্রিয় করতে মডেল ভাড়া করেছিলেন গোল্ডম্যান
ছবি: সংগৃহীত

কেবল বিজ্ঞাপন নয়, গোল্ডম্যান সে সময় কিছু নারী ও পুরুষ মডেল ভাড়া করছিলেন। এ মডেলরা শুধু অন্যদের উৎসাহিত করার জন্য কার্ট নিয়ে শপিং করতেন। মডেলদের সঙ্গে দোকানের প্রবেশমুখে একজন কর্মীও নিয়োগ করেছিলেন গোল্ডম্যান। কোনো ক্রেতা দোকানে ঢুকলে ওই কর্মী কুশল বিনিময় করে একটা কার্ট ব্যবহার করার অনুরোধ করতেন। ক্রেতা যদি নিতে না চাইত, তখন ওই কর্মী ভেতরে থাকা মডেলদের দেখিয়ে বলতেন, ‘দেখুন, ওরা কী আরামে শপিং করছে!’

গোল্ডম্যানের ফোল্ডিং ক্যারিয়ার করপোরেশনের বিজ্ঞাপন
ছবি: সংগৃহীত

গোল্ডম্যানের এসব কৌশল দারুণ কাজে দিয়েছিল। ১৯৪০–এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে শপিং কার্ট হয়ে ওঠে ব্যাপক জনপ্রিয়। এতই জনপ্রিয়তা পায় যে নতুন সুপারশপগুলো পণ্য রাখার সারির মাঝখানে কার্ট ব্যবহারের জন্য বাড়তি জায়গাও রাখতে শুরু করে। শপিং কার্টের জনপ্রিয়তা দেখে গোল্ডম্যান পরে ফোল্ডিং ক্যারিয়ার করপোরেশন নামে একটা কোম্পানির গোড়াপত্তন করেন। ওই কোম্পানি শপিং কার্ট বানাত। সেখান থেকেও বেশ ভালো আয় করেছিলেন গোল্ডম্যান।

নকশায় পরিবর্তন

আধুনিক শপিং কার্ট
ছবি: সংগৃহীত

আমরা এখন যে শপিং কার্ট দেখি, সেগুলোতে মূলত ওপরে একটা বড় কার্ট থাকে আর নিচের দিকে থাকে ভারী পণ্য রাখার জন্য একটা পাটাতন। ১৯৫০–এর দশকে ট্রলিতে শিশুদের বসার স্থান যোগ করা হয়, যাতে শপিং করতে গেলে অভিভাবকদের দুটি আলাদা ট্রলি বা কার্ট ব্যবহার করতে না হয়। যদিও নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা কার্টে শিশুদের বসার স্থান যোগ করার বিরুদ্ধে মত দিয়ে আসছেন। কারণ, এটি দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে।

যাহোক, এর পর থেকে সুপারশপে গেলে আপনি নিশ্চয়ই মনে মনে সিলভান ন্যাথান গোল্ডম্যানকে একটা ধন্যবাদ দেবেন! দেওয়ারই কথা; জীবন সহজ করে দেওয়া একটা কিছু উদ্ভাবন করা আদতে অতটা সহজ নয় যে! রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘সহজ কথা যায় না লেখা সহজে।’ একইভাবে বলতে পারি, ‘সহজ জিনিস যায় না গড়া সহজে!’

সূত্র: মেন্টাল ফ্লস