শীর্ষ ধনী থেকে দেউলিয়া, তারপর দোষী সাব্যস্ত হলেন যে নারী উদ্যোক্তা

বিশ্বখ্যাত পত্রপত্রিকাগুলোর প্রচ্ছদই বলে দিচ্ছে, রাতারাতি তারকা বনে গিয়েছিলেন তিনি
কোলাজ: সংগৃহীত

তাঁকে ভাবা হয়েছিল সময়ের অন্যতম সফল নারী। মাত্র কয়েক ফোঁটা রক্তের মাধ্যমে মানবদেহের রোগ নির্ণয়ের ধারণা দিয়ে খুব অল্প বয়সেই অর্থ-বিত্ত-সাফল্যের দেখা পেয়েছিলেন তিনি। নাম উঠেছিল ফোর্বস ম্যাগাজিনের তৈরি করা বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ধনী বা বিলিয়নিয়ার ব্যক্তিদের বার্ষিক তালিকায়। তাঁর কোম্পানি থেরানোসের বাজারমূল্য একপর্যায়ে ৯০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কোম্পানিটি সিলিকন ভ্যালিতে হয়ে উঠেছিল বিস্ময়ের আরেক নাম। যাঁকে নিয়ে বিশ্বের উদ্যোক্তারা গর্ব করতেন, যাঁর ‘সাফল্য’ চিকিৎসাবিজ্ঞানে নতুন আশার সঞ্চার করেছিল, শেষমেশ দেখা গেল সেই এলিজাবেথ হোমস আপাদমস্তক প্রবঞ্চক!

মাত্র কয়েক ফোঁটা রক্তের মাধ্যমে মানবদেহের রোগ নির্ণয়ের ভুয়া ধারণা দিয়েছিলেন এলিজাবেথ
ছবি: সংগৃহীত

এলিজাবেথ হোমসের বয়স এখন ৩৭। তাঁর উত্থানের শুরু মাত্র ১৯ বছর বয়সে, ২০০৩ সালে। ৪ জানুয়ারি মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার এক আদালত প্রতারণা ও যড়যন্ত্রের মামলায় হোমসকে দোষী সাব্যস্ত করে এক যুগান্তকারী রায় দিয়েছেন। আদালত রায়ে বলেছেন, হোমসের বিরুদ্ধে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণার ষড়যন্ত্র এবং ইলেকট্রনিক মাধ্যমে প্রতারণার তিন ঘটনাসহ মোট চারটি অভিযোগের সন্দেহাতীত প্রমাণ পেয়েছেন তাঁরা।

কে এই এলিজাবেথ হোমস?

সময়রেখায় দেখে নেওয়া যাক তাঁর উত্থান-পতন…
২০০২ সালে প্রেসিডেন্ট স্কলারশিপ নিয়ে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন এলিজাবেথ
ছবি: রয়টার্স

২০০৩

১৯ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা ছেড়ে প্রতিষ্ঠা করেন ‘রিয়েল-টাইম কিওরস’ কোম্পানি। এই কোম্পানিই পরে নাম বদলে হয় ‘থেরানোস’। ডায়াগনস্টিক পরীক্ষায় বিপ্লব ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে এলিজাবেথ হোমস এই কোম্পানি শুরু করেন।

থেরানোস সদর দপ্তরের একাংশ
ছবি: থেরানোস

২০০৪

নতুন কোম্পানিটি ৬ মিলিয়ন ডলার তহবিল সংগ্রহ করতে সক্ষম হয় এবং এতে কোম্পানির দাম বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৩০ মিলিয়ন ডলারে।

রমেশ ‘সানি’ বালওয়ানি
ছবি: সিক্সটি মিনিটস

২০০৯

এলিজাবেথ হোমসের তখনকার সঙ্গী রমেশ বালওয়ানি থেরানোসের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন। রমেশ বালওয়ানি মার্কিন ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। জন্ম পাকিস্তানে, ১৯৬৫ সালে। পরে পরিবারসহ চলে যান ভারতে।

২০১০

থেরানোস আরও ৪৫ মিলিয়ন ডলার তহবিল সংগ্রহ করে ফেলে। এতে কোম্পানির বাজারমূল্য বেড়ে হয় এক বিলিয়ন ডলার।

নিউইয়র্কে ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভের বার্ষিক বৈঠকের সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সঙ্গে এলিজাবেথ হোমস
ছবি: রয়টার্স

২০১১

যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা থেরানোসের বোর্ড সদস্য হিসেবে যোগ দিতে শুরু করেন। এসব বোর্ড সদস্যদের মধ্যে ছিলেন সাবেক দুজন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী—জর্জ শ্যুলজ ও হেনরি কিসিঞ্জার।

২০১২

কোম্পানিটি ক্যালিফোর্নিয়ার পালো আল্টোতে সদর দপ্তর স্থানান্তর করে।

ক্যালিফোর্নিয়ার পালো আল্টোর সদর দপ্তরে
ছবি: এইচবিও

২০১৩

থেরানোস তাদের প্রযুক্তির প্রচার শুরু করে। পণ্যের প্রচারে তারা দাবি করেছিল, এই প্রযুক্তির মাধ্যমে মাত্র কয়েক ফোঁটা রক্তের মাধ্যমেই রোগ নির্ণয় সম্ভব হবে। তারা এই পণ্যের নাম দিয়েছিল ‘এডিসন’। ফার্মেসি গ্রুপ ওয়ালগ্রিনস বুটস অ্যালায়েন্সের সঙ্গে অংশীদারত্বের চুক্তিও হয়েছিল তখন।

২০১৪

থেরানোস আরও ৪০০ মিলিয়ন ডলার তহবিল সংগ্রহ করে এবং কোম্পানির বাজারমূল্য বেড়ে গিয়ে হয় প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলার। ফোর্বস ম্যাগাজিনের বিলিয়নিয়ারের তালিকায় নাম ওঠে হোমসের।

অভিযোগের তীর যখন এলিজাবেথের দিকে
ছবি: রয়টার্স

২০১৫ (ফেব্রুয়ারি)

জার্নাল অব দ্য আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনে প্রকাশিত এক আর্টিকেলে থেরানোসের সমালোচনা করে বলা হয়, কেন প্রতিষ্ঠানটি এখনো কোনো পিয়ার রিভিউড (যথাযথ বিশেষজ্ঞদের দ্বারা বারবার যাচাইবাছাই করা) জার্নালে কোনো গবেষণাপত্র প্রকাশ করেনি।

থেরানোসের কর্মীরাই তাঁদের পরীক্ষার নির্ভুলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন
ছবি: রয়টার্স

২০১৫ (জুলাই)

হারপিস সিমপ্লেক্স ওয়ান ভাইরাস শনাক্ত করার এক পরীক্ষা উদ্ভাবনের জন্য থেরানোস পেয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের (এফডিএ) অনুমতি।

২০১৫ (অক্টোবর)

ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এক প্রতিবেদনে জানায়, থেরানোস তাদের পরীক্ষাগুলো সীমাবদ্ধ করে রাখছে এবং প্রতিষ্ঠানের কর্মীরাই এসব পরীক্ষার নির্ভুলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। এর কিছু দিন পরই এফডিএ জানায়, থেরানোস অননুমোদিত যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চালাচ্ছে।

যখন তিনি থেরানোসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা
ছবি: রয়টার্স

২০১৬ (জানুয়ারি)

ইউএস সেন্টারস ফর মেডিসিন অ্যান্ড মেডিকেইড সার্ভিসেস (সিএমএস) জানায়, থেরানোস রোগীদের স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। সিএমএস বলে, এক পরিদর্শনে তারা দেখেছে, থেরানোস নিজেদের পরীক্ষাগারে গুণগত মান ঠিক রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে।

২০১৬ (জুন)

থেরানোসের সঙ্গে সম্পর্ক শেষ করে ওয়ালগ্রিনস।

২০১৫ সালের ২০ আগস্টের টুইটে যা লিখেছিলেন
ছবি: সংগৃহীত

২০১৬ (অক্টোবর)

অন্যতম বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান পার্টনার ফান্ড ম্যানেজমেন্ট থেরানোসের বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা করে। মামলায় বলা হয়, বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে থেরানোস তাদের প্রযুক্তি সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দিয়েছিল। এই মামলা পরে মীমাংসাও করা হয়েছিল।

২০১৭ (এপ্রিল)

থেরানোস ইউএস সেন্টারস ফর মেডিসিন অ্যান্ড মেডিকেইড সার্ভিসেসের (সিএমএস) সঙ্গে এক চুক্তি করে। যাতে তারা পরবর্তী দুই বছর কোনোরকম পরীক্ষা চালানো থেকে বিরত থাকার অঙ্গীকার করেছিল।

২০১৮ (মার্চ)

মার্কিন সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন থেরানোস, এলিজাবেথ হোমস ও রমেশ বালওয়ানির বিরুদ্ধে জামানত জালিয়াতির অভিযোগ আনে। কোম্পানিতে এলিজাবেথের অংশীদারত্ব এবং নিয়ন্ত্রণও কেড়ে নেয়।

২০১৯ সালের ১৭ জুলাই শুনানির পর স্যান জোসের আদালত ভবন থেকে বেরিয়ে আসছেন এলিজাবেথ
ছবি: রয়টার্স

২০১৮ (জুন)

এলিজাবেথ হোমস ও রমেশ বালওয়ানিকে ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। দুজনই নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন।

২০১৮ (সেপ্টেম্বর)

থেরানোস নিজেদের বিলীন হওয়ার ঘোষণা দেয়।

২০২১ (মার্চ)

এলিজাবেথ হোমস জানান, তিনি মা হতে চলেছেন।

২০২১ (আগস্ট)

এলিজাবেথ হোমস মা হন। আদালতকে তিনি জানান, অপরাধ করার সময় তিনি রমেশ বালওয়ানির নিয়ন্ত্রণে ছিলেন। এবং বালওয়ানি তাঁর ওপর অত্যাচারও চালিয়েছিলেন। বালওয়ানি অবশ্য সব অভিযোগ অস্বীকার করেন।

এলিজাবেথ নিজের দোষ স্বীকার করেননি
ছবি: রয়টার্স

২০২১ (সেপ্টেম্বর)

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার সান জোসে শহরে এলিজাবেথ হোমসের বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়।

২০২১ (নভেম্বর)

এলিজাবেথ হোমস আত্মপক্ষ সমর্থন করে সাক্ষ্য দেন। বিনিয়োগকারী এবং রোগীদের বিভ্রান্ত করার কথাও অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, বিনিয়োগকারীদের দেওয়া আর্থিক মডেলগুলো পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন বালওয়ানি।

৪ জানুয়ারি রায় শোনার পর বর্তমান সঙ্গী বিলি ইভানস ও মা–বাবার সঙ্গে আদালত ভবন থেকে বেরিয়ে আসছেন এলিজাবেথ (বাঁ থেকে দ্বিতীয়)
ছবি: এএফপি

২০২২ (জানুয়ারি)

প্রতারণার মামলায় যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার একটি আদালতে এলিজাবেথ হোমসকে দোষী সাব্যস্ত করেছেন। এলিজাবেথ দাবি করতেন, থেরানোসের রক্ত পরীক্ষার যন্ত্রগুলো শত শত রোগ নির্ণয়ে সক্ষম, কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। যা হোক, ৪ জানুয়ারির রায়টি ছিল বহুল প্রতীক্ষিত। এই মামলা ছিল অত্যন্ত জটিল। কারণ, এসব প্রতারণার মামলা প্রমাণ করা ভীষণ জটিল এবং কষ্টসাধ্য। বিচারকদের শত শত প্রমাণ যাচাই–বাছাই করতে হয়েছে। শুনতে হয়েছে কয়েক ডজন ভুক্তভোগীর বক্তব্য। অবশেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত মামলার বিচারকাজ শেষ হলো। বিচারকেরা এখনো সাজা ঘোষণা করেননি। আগামী সপ্তাহে এ মামলার আরেকটি শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে। হোমস নিজে অবশ্য সব সময়ই তাঁর বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন।

আল–জাজিরা অবলম্বনে মিজানুর রহমান