সবার অজান্তে মন্ত্রীর চেয়ে বেশি আয় করছেন একজন রিকশাচালক

গতকাল রোববার সুনামগঞ্জে জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন, ‘...ইতিমধ্যে আমাদের মাথাপিছু আয়ও বেড়েছে। আড়াই হাজার ডলার ছাড়িয়ে যাচ্ছে। শনৈঃশনৈঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে, রাত পোহালেই আয় বাড়ছে বাংলাদেশের, আমরা টেরই পাচ্ছি না। আমরা অজান্তেই বড়লোক হয়ে যাচ্ছি।’ সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সম্মেলনকক্ষে পরিকল্পনামন্ত্রী সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘তবে বড়লোকের বড়লোকি কিছু রোগও হয়, সেই রোগ থেকে যেন আমরা মুক্ত থাকি।’ করোনার সময়েও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী আরও বলেন, ‘যদিও সরকারিভাবে এটা আমি প্রকাশ করিনি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশে আসার পরে তাঁর সঙ্গে কথা বলে তাঁর অনুমতি নিয়ে এটা আমরা ঢাকঢোল পিটিয়ে বলে দেব। কারণ, এটা ভালো কাজ।’ পরিকল্পনামন্ত্রী মহোদয়ের এই তিন বাণী নিয়ে আমরা হাজির হয়েছিলাম তিন ব্যক্তির কাছে। চলুন, দেখা যাক, তারা কী বললেন...

মন্ত্রীর চেয়ে বেশি আয় করছেন রিকশাচালক

ঢাকার মিরপুরে ৪ বছর ধরে রিকশা চালান মজনু মিয়া। গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার দৌলতপুরে। ঢাকায় থাকেন রিকশা গ্যারাজেই। গ্রামের বাড়িতে আছেন বৃদ্ধা মা, স্ত্রী ও দুই সন্তান। পরিকল্পনামন্ত্রীর প্রথম বাণীটি (‘...ইতিমধ্যে আমাদের মাথাপিছু আয়ও বেড়েছে। আড়াই হাজার ডলার ছাড়িয়ে যাচ্ছে। শনৈঃশনৈঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে, রাত পোহালেই আয় বাড়ছে বাংলাদেশের, আমরা টেরই পাচ্ছি না। আমরা অজান্তেই বড়লোক হয়ে যাচ্ছি।’) শোনানোর পর তিনি বলেন, ‘স্যারের (পরিকল্পনামন্ত্রী) কথা তো ঠিকই আছে।’ এতটুকু বলেই মজনু মিয়া রিকশার যাত্রী–আসনে পা তুলে লুঙ্গির কোঁচড় থেকে একটি বার ফোন বের করে কী যেন দেখেটেখে বলেন, ‘আমার অ্যাকাউন্টে আইজকা কত ট্যাকা জমা হইছে, জানেন?’

‘একটু থামুন’–এর এই প্রতিবেদক নিজের অজ্ঞতার কথা জানালে মজনু মিয়া বলেন, ‘দুপুর পর্যন্ত জমা হইছে ৩০০ ডলার। ৩০০ ডলার মানে বাংলা ট্যাকায় কত?’

হিসাব করে দেখা গেল বর্তমান বাজারমূল্যে তা প্রায় ২৬ হাজার টাকা। মজনু মিয়াকে তা বলার পর তিনি বলেন, ‘এখন বাজে কয়টা?’ ঘড়িতে তখন বেলা দুইটা। মজনু মিয়া বলেন, ‘সকাল আটটায় বাইরাইছি। দুইটা বাজতে না বাজতে ২৬ হাজারের খ্যাপ মারছি। বিকাল হইলে অ্যাকাউন্টে কত জমা হইব, বুঝছেন?’

এই প্রতিবেদক মিনমিন করে বলেন, ‘৫০ হাজার তো হবেই, নাকি?’

রোজ তিনবেলা এরকম সোনার ডিম দিয়ে ভাত খাচ্ছেন রিকশাচালক মজনু মিয়া
ছবি: পেক্সেলস

মজুন মিয়া খানিকটা চটে গেলেন, ‘৫০ হাজার হইব মানে, ৫০ হাজার ক্রস করব। এহন কন, পরিকল্পনামন্ত্রী কয় পয়সা বেতন পায়? দিনরাত খাটনি কইরাও মাসে তো মনে হয় ৫০ হাজার ট্যাকা চোখে দেখে না। তাইলে এহন কন, আমি রিশকাঅলা মজনু মিয়া মন্ত্রীর চাইতে বেশি কামাই করি কি না? আর কইলেন, রাইত পোআইলে আয় বাড়তাছে। কথা হান্ডেড পারসেন ঠিক। রাইতটা পার হইলেই দেখি বালিশের তলে ক্যামনে ক্যামনে জানি তিন–চাইরটা কইরা সোনার ডিম পইড়া থাকে...’

মজনু মিয়া কথা শেষ করতে পারেন না, পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আরেক রিকশাচালক মজনু মিয়ার উদ্দেশে বলেন, ‘কী রে, ভাত খাইবি না?’

রিকশাচালকের দিকে তাকিয়ে মজনু মিয়া বলেন, ‘হ, আইতাছি,’ তারপর আবার এই প্রতিবেদকের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘থাকেন বাই, সোনার ডিম দিয়া ভাত খাইয়া আসি। ভিজিটিন কাড পকেটে থাকে না, নাইলে একখান দিয়া দিতাম।’

হাসপাতালে বড়লোকি রোগে আক্রান্তদের ঢল

ঢাকার এক সরকারি হাসপাতালের বহির্বিভাগে সারি সারি মানুষ। দীর্ঘ ওই সারির দিকে তাকিয়ে অদূরেই মাথায় হাত দিয়ে বসে ছিলেন মাঝবয়সী এক ব্যক্তি। দেখে মনে হলো, তিনি অসুস্থ। কথা বলা যাবে কি না জানতে চাইলে বলেন, ‘কথা কম বলা ভালো। তারপরও কী কইবেন, কন। পিঠের ব্যথায় সোজা হয়া খাড়াইতে পারি না।’

পরিকল্পনামন্ত্রী প্রথম ও দ্বিতীয় বাণী (‘তবে বড়লোকের বড়লোকি কিছু রোগও হয়, সেই রোগ থেকে যেন আমরা মুক্ত থাকি।’) শোনানোর পর মন্তব্য জানতে চাইলে ইদ্রিস মণ্ডল নামের ওই ব্যক্তি বলেন, ‘মিনিশটার সাব তো আমার রোগ ধইরা ফালাইছেন, তারে একটা পদক দেওয়া দরকার। আমি কাজ করি রায়েরবাজারের এক মুদিদোকানে। কিন্তু মনে করেন, সকাল–বিকাল ফাইভ স্টার হোটেলে চা–কফি খাইতে মন চায়। ৩০ হাজার টাকা দামের বালিশে ঘুমাইতে মন চায়। এখন আপনিই বলেন, বড়লোকি রোগের লক্ষণ আছে কি না?’

৩০ হাজার টাকা দামের কিছু বালিশ কিনতে দরপত্র আহ্বান করার কথা ভাবছেন ইদ্রিস মণ্ডল
ছবি: পেক্সেলস

এই প্রতিবেদক ‘হ্যাঁ’ বললে ইদ্রিস মণ্ডল মুখ বাঁকা করে হাসেন। হাসতে গিয়ে হয়তো তাঁর পিঠে টান পড়ে গিয়েছিল, তাই চোখমুখ কুঞ্চিত করে খানিকটা সময় নিয়ে বলেন, ‘আমার তো মনে হয়, ওই যে লোকজন সব লাইনে খাড়ায়া আছে, তাদেরও একই রোগে ধরছে। আপনারও এই সব লক্ষণ আছে নাকি?’

আমতা আমতা করে ‘হ্যাঁ–না’ করতেই ইদ্রিস মণ্ডল বলেন, ‘সত্য কথা বলেন না ক্যান? এই দেশে কোনো গরিব আছে নাকি? আপনিও তো মিয়া বড়লোক। লক্ষণ দেখা দেওয়ার আগেই ওই লাইনে গিয়া খাড়ান।’

ঢোল বিক্রি করে কুলাতে পারছেন না বিক্রেতারা

অনুকূল চন্দ্র দাসরা (ছদ্মনাম) পুরান ঢাকার শাঁখারী বাজারে বাদ্যযন্ত্র বিক্রি করছেন কয়েক প্রজন্ম ধরে। গতকাল বিকেলে তাঁর দোকানে গেলে হাসি হাসি মুখে তাকালেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিছু লাগবে?’

সময় নষ্ট না করে পরিচয়পর্ব সেরেই এই প্রতিবেদক আসল কথাটি পেড়ে ফেলেন। পরিকল্পনামন্ত্রীর তৃতীয় বাণীটি (‘যদিও সরকারিভাবে এটা আমি প্রকাশ করিনি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশে আসার পরে তাঁর সঙ্গে কথা বলে তাঁর অনুমতি নিয়ে এটা আমরা ঢাকঢোল পিটিয়ে বলে দেব। কারণ, এটা ভালো কাজ।’) শোনানোর পর অনুকূল চন্দ্র দাসের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বিস্মিত হয়ে বলেন, ‘এই কারণেই তো বলি, সব ঢোল বিক্রি হয়ে গেল কীভাবে!’

ভালো খবর ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ঢোলের ব্যাপক চাহিদায় বাজারে চরম সংকট দেখা দিয়েছে
কোলাজ: একটু থামুন

বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কয়দিন আগেই তো বড় বড় পালাপার্বণ শেষ হয়ে গেল। কিন্তু আজকে হঠাৎ খেয়াল করলাম, কিছুক্ষণ পরপর মানুষ এসে ঢোল কিনতে চায়। যে কয়টা ছিল, সবই তো বেচে দিলাম। আশপাশের দোকানগুলোরও সব ঢোল শেষ। খুব ভালো লাগছে যে এমন মহতী উদ্যোগের জন্য আমাদের ঢোলগুলো কাজে লাগবে। তো আপনারও কি একটা ঢোল লাগবে? এখনই সাপ্লাই দিতে না পারলেও আমরা কিন্তু অর্ডার নিচ্ছি, দাদা! দেশের মানুষ এভাবে রাতারাতি বড়লোক হয়ে যাচ্ছে, ঢোল দিয়ে তো আমরা কুলাতে পারব না মনে হচ্ছে!’

আরও পড়ুন