প্রভাবশালী মার্কিন শিল্পী অ্যান্ডি ওয়ারহোলের জন্ম ১৯২৮ সালে। মারা যান ১৯৮৭ সালে। মৃত্যুর এত বছর পরও তিনি প্রাসঙ্গিক। আধুনিক শিল্পকলাচর্চায় ওয়ারহোল একটি বিশিষ্ট নাম, একটি বিশেষ ঘরানার অন্যতম পুরোধা। কিন্তু ষাটের দশকেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন না। খুব অল্প মানুষই তাঁকে চিনত। তাঁর জগদ্বিখ্যাত হওয়ার আগেই বাজারে চলে এসেছিল তুমুল আলোচিত ‘পপ আর্ট’। এই পপ আর্টে নতুন মাত্রা যোগ করার কাজে হাত দেন ওয়ারহোল। পপ আর্টই তাঁকে নিয়ে যায় অনন্য উচ্চতায়।
১৯৬২ সালের ৯ জুলাই। লস অ্যাঞ্জেলেসের ফেরাস গ্যালারিতে ওয়ারহোল তাঁর প্রথম একক চিত্রকর্ম প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। তাঁর বয়স তখন ৩৪ বছর। সেই প্রদর্শনীতে তিনি রাখেন ৩২টি চিত্রকর্ম। প্রতিটি চিত্রকর্মের বিষয় একই—ক্যাম্পবেলস স্যুপের কৌটা। একটি চিত্রকর্মের সঙ্গে অন্যটির পার্থক্য সামান্যই। ফ্লেভারের নাম ছাড়া বাকি সবকিছুই হুবহু এক। দেখলে মনে হবে, একটি আরেকটির প্রতিলিপি। স্যুপের ৩২টি স্বাদের ৩২টি চিত্রকর্ম!
এই প্রদর্শনী সে সময় সাড়া জাগাতে পারেনি। দর্শক বিস্মিত। এই চিত্রকর্ম গ্রহণ করতে তখন কত দ্বন্দ্ব, কত দ্বিধা! অনেক চিত্রসমালোচক ওয়ারহোলকে আক্রমণ করে বসলেন। একজন লিখলেন, ‘এই তরুণ শিল্পী হয় মাথামোটা বেকুব অথবা ঠান্ডা মাথার অতিচালাক।’ পত্রিকায় তাঁকে নিয়ে ব্যঙ্গচিত্রও বের হয়। যদিও ‘ক্যাম্পবেলস স্যুপ ক্যানস’ শিরোনামের ওই প্রদর্শনীই ওয়ারহোলের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এই কৌটার ছবি বিভিন্ন মাধ্যমে হু হু করে ছাপা হতে শুরু করে, পোশাক থেকে শুরু করে তৈজসপত্রে। ষাটের দশকের শেষের দিকে ক্যাম্পবেলস স্যুপ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানও ওয়ারহোলের ছবির জনপ্রিয়তা বেচতে শুরু করে।
পপ আর্ট এসে প্রথাগত চিত্রকলার জগৎটাকে ওলট–পালট করে দিয়েছিল। সেই অস্থিরতায় আরও এক মাত্রা যোগ করলেন অ্যান্ডি ওয়ারহোল। প্রতিকৃতি, ল্যান্ডস্কেপ, ফুল ও যুদ্ধের ছবি বাদ দিয়ে পপ শিল্পীরা বিজ্ঞাপন, সিনেমা, কমিক বই, কার্টুন, পণ্যের মোড়ক ইত্যাদি জনপ্রিয় বিষয় (পপুলার কালচার) থেকে উপাদান সংগ্রহ করতে শুরু করেন। তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য অ্যান্ডি ওয়ারহোল। পপ আর্টে তিনি রীতিমতো বিপ্লবী।
ব্যাপক উৎপাদন ও ভোগবাদ কীভাবে মার্কিন জীবন ও সংস্কৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে, পপ চিত্রকর্মের মাধ্যমে তা-ই শিল্পীরা ব্যঙ্গ ও বিদ্রূপাত্মকভাবে ফুটিয়ে তুলতে শুরু করেন। পঞ্চাশের দশকের বিমূর্ত শিল্পীরা নিজেদের সৃজনশীল ও ব্যক্তিবাদী প্রতিভা মনে করতেন। কিন্তু ষাটের দশকের পপ শিল্পীরা উল্টো পথে হাঁটলেন। যা দিয়ে চিত্রকর্ম চেনা যায়, সেসব চিহ্ন তাঁরা মুছে ফেলতে শুরু করলেন। যেমন তুলির আঁচড়। এ জন্য তাঁদের চিত্রকর্মগুলো দেখতে অনেকটা যান্ত্রিক মনে হয়।
ক্যাম্পবেলস স্যুপের কৌটাগুলো এই রীতিতেই আঁকা—স্ক্রিনপ্রিন্ট মাধ্যমে। কিন্তু ওয়ারহোল কেন এই কৌটাই বেছে নিয়েছিলেন? অনেক শিল্পসমালোচকের মতে, মূল কৌটার নকশার প্রতি আকর্ষণ ও স্মৃতি, এই দুই কারণে ওয়ারহোল এই স্যুপের কৌটাগুলো বেছে নিয়েছিলেন। জোসেফ আ ক্যাম্পবেল ১৮৬৯ সালে ‘ক্যাম্পবেল স্যুপ কোম্পানি’ প্রতিষ্ঠা করেন। মার্কিনদের জীবনযাপনে এই কোম্পানির প্রভাব দারুণ। ওয়ারহোল বলেছিলেন, ‘আমি এই স্যুপ খেতাম। টানা ২০ বছর প্রতিদিন এই স্যুপ ছিল আমার দুপুরের খাবার।’
এত কিছুর পর স্যুপের কৌটাগুলো আর ক্যাম্পবেলের কৌটা থাকেনি। সেই কৌটা এখন ওয়ারহোলের কৌটা হিসেবে পরিচিত, যা এখনো পপ আর্টের আদর্শ উদাহরণ হিসেবে বহাল। বিশ্বের নামীদামি জাদুঘরে এই ছবিগুলো প্রদর্শিত হয়। প্রথম প্রদর্শনীর সময়ই ওয়ারহোলকে ১ হাজার ডলার দিয়ে কৌটার ৩২টি চিত্রকর্ম কিনে নিয়েছিলেন ফেরাস গ্যালারির অন্যতম মালিক আরভিং ব্লাম। ১৯৯৬ সালে ব্লামের কাছ থেকে ছবিগুলো ১৫ মিলিয়ন ডলারে (১ কোটি ৫০ লাখ ডলার) কিনে নেয় নিউইয়র্কের মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট (মোমা)।
তথ্যসূত্র: হিস্ট্রি ডটকম