হিমুর হাতে একটি আকাশি-সাদা পতাকা

কোলাজ: একটু থামুন

মাজেদা খালার বাসায় দুপুরে যাওয়ার কথা।

উপস্থিত হলাম রাত আটটায়। কেউ অবাক হলো না। বাদল দরজা খুলেই উল্লসিত গলায় বলল, ‘হিমুদা এসেছ? থ্যাংকস! আমাকে কেমন দেখাচ্ছে?’

বাদল একটা কমলা মতোন টি-শার্টের সঙ্গে নীল-সাদা স্ট্রাইপের পাজামা পরেছে।

আমি চমকে যাওয়ার ভান করে বললাম, করেছিস কী, বাদল! তুই দেখি পুরোপুরি সাম্যবাদী হয়ে গেছিস। গাহি সাম্যের গান, যেখানে আসিয়া ঘুচিয়া গেছে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার ব্যবধান।

বাদল গদগদ হয়ে বলল, ‘টি-শার্টটা আর একটু হলুদ হলে ভালো হতো। আর বুকে এই টিনটিনের ছবিটা যদি না থাকত। পাজামার নীল স্ট্রাইপগুলো আর একটু যদি কম ডিপ হতো!’

যা করেছিস সেটাই হুলুস্থুল। পৃথিবীতে কোনো কিছুই হান্ড্রেড পার্সেন্ট নিখুঁত হওয়া উচিত না। ‘ওয়ান অব দ্য বেসিক রুলস অব দ্য ইউনিভার্স ইজ দ্যাট—নাথিং ইজ পারফেক্ট’ স্টিফেন হকিং বলেছেন।

বাদল খুশি খুশি গলায় বলল, ‘হিমুদা, আমি ফাইনালের সব প্রিপারেশন নিয়ে রেখেছি। খাওয়াদাওয়া শেষ করে আমার ঘরে চলে আসবে। একটা জোশ প্ল্যান আছে। আই নিড ইয়োর হেল্প। আজ থাকবে কিন্তু। বাই দ্য ওয়ে, হিমু ভাই, তুমি এমন ডার্ক হলুদ পাঞ্জাবি কোথায় পেলে?’

গাউছিয়ায়।

‘ফাইন দেখাচ্ছে। সন্ন্যাসী সন্ন্যাসী লাগছে। সন্ন্যাসী উপগুপ্ত, মথুরাপুরীর প্রাচীরের নিচে একদা ছিলেন সুপ্ত।’

বাদল শব্দ করে হেসে উঠল।

খালা গম্ভীর মুখে খাবার এগিয়ে দিচ্ছেন। দুপুরের খাবার গরম করে দেওয়া হচ্ছে। পোলাওয়ে টকটক গন্ধ। নষ্ট হয়ে গেছে কি না, কে জানে।

খালা বললেন, ‘রোস্ট আরেক পিস দেব?’

দাও।

‘এত খাবারদাবারের আয়োজন কী জন্য, একবার জিজ্ঞেস করলি না!’

খাবারদাবারের আয়োজন কী জন্য, তা আমি ভালো করেই জানি। তারপরও বললাম, কী জন্য?

‘আত্মীয়স্বজন যখন কোনো উপলক্ষে খেতে ডাকে, তখন জিজ্ঞেস করতে হয়, উপলক্ষটা কী?’

একটা ঝামেলায় আটকা পড়েছিলাম। উপলক্ষটা কী?

‘ব্রাজিল ফাইনালে উঠেছে।’

বাহ! কবে করল এই কাজ?

খালা মাংসের বাটিতে চামচ নাড়াচাড়া করতে করতে গম্ভীর হয়ে গেলেন।

শীতল গলায় বললেন, ‘আর্জেন্টিনাও উঠে গেছে আজকে।’

বাহ!

খালা রাগী গলায় বললেন, ‘ছোটলোকের মতো কথা বলবি না। আর্জেন্টিনার জেতায় বাহ আবার কী! খেলা পারে এরা? আছে এক মেসি মেসি রব। এতই তোমাদের মেসি, কই, কিছু তো জিততে পারলা না। কাপ না জিতলে মেসি ধুয়ে পানি খাব? তুই যাওয়ার আগে ওই আর্জেন্টাইন ভাঁড়টার সঙ্গে কথা বলে যাবি। ভাঁড়টারে বুঝায়ে যাবি, ব্রাজিল কত প্রকার ও কী কী।’

আমি বিনীত গলায় বললাম, এটা পাঞ্জাবি, খালু সাহেব। গাউছিয়া থেকে কিনেছি। কালারটা একটু বেশিই ডার্ক হয়ে গেছে। তবে বাদল বলেছে ফাইন লাগছে আমাকে। সন্ন্যাসী সন্ন্যাসী। আসলেই কি? আপনার কী মনে হয়?

খালুর ঘর অন্ধকার। জিরো পাওয়ারের একটা বাতি জ্বলছে। লক্ষণ সুবিধার না। খালার সঙ্গে তুমুল ঝগড়া হলেই এমন হয়। খালুর মেজাজ তখন সপ্তম চড়িয়ে অষ্টম-নবমে থাকে। এ রকম মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা খুব সাবধানে বলতে হয়।

খালু আসব?

‘হিমু! এসো। দরজা ভিড়িয়ে দাও। তোমার সঙ্গে খুব জরুরি কথা আছে। বসো, সামনের চেয়ারটায় বসো।’

আমি বসলাম।

‘তারপর বলো, কেমন আছ। ভালো?’

জি।

‘আর্জেন্টিনা ফাইনালে উঠেছে, শুনেছ বোধ হয়?’

জি।

‘ব্রাজিলও উঠেছে। থার্ড ক্লাস ফালতু একটা টিম ফাইনালে উঠেছে। মানা যায়?’

আমি চুপ করে রইলাম।

‘আর ওই বুদ্ধিবিবর্জিত মহিলা তাতেই আসমানে উঠে বসে আছে। কিছু বললেই কাপের খোঁটা দেয়। ব্লাডি ফুল! খেলাটেলা তো কিছুই বোঝে না। ওই মোটা বুদ্ধি দিয়ে কাপ ছাড়া আর কী চিনবে!’

খালু খানিকটা বিরতি নিয়ে হঠাৎ গলা চড়িয়ে বললেন, ‘হিমু!’

জি, খালু।

খালু কটমট করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হিমু, হোয়াট ইজ দিস?’

খালু সাহেব যে ‘দিস’কে ইঙ্গিত করে ‘হোয়াট’ বলছেন, সেটা আমার হলুদ পাঞ্জাবি।

আমি বিনীত গলায় বললাম, এটা পাঞ্জাবি, খালু সাহেব। গাউছিয়া থেকে কিনেছি। কালারটা একটু বেশিই ডার্ক হয়ে গেছে। তবে বাদল বলেছে ফাইন লাগছে আমাকে। সন্ন্যাসী সন্ন্যাসী। আসলেই কি? আপনার কী মনে হয়?

আমার মোবাইল টুং করে উঠল। রূপা পাঠিয়েছে। ওর প্রোফাইলে মেসির ছবি।

রূপা আমাকে একটা স্মার্টফোন কিনে দিয়েছে। সেখানে একটা ফেসবুক আইডি খুলে দিয়েছে। আইডি থেকে ওকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছি। এটাও রূপার বুদ্ধি। আমার ফ্রেন্ডলিস্টে রূপা ছাড়া আর কেউ নেই। রূপা কী যেন করে দিয়েছে, কেউ যাতে আমাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাতে না পারে—এমন কিছু।

‘তোমার একটা ছবি দাও তো। সেলফি। এখনই।’

টুংয়ে লিখেছে রূপা।

রূপার এটা নতুন অভ্যাস হয়েছে। কথা নাই, বার্তা নাই হঠাৎ করেই বলে, ‘কই আছ? একটা সেলফি দাও তো। দেখি তোমাকে।’

আমার হাতে একটা ছোট পতাকা। আর্জেন্টিনার। ভি চিহ্ন দেখিয়ে হাসি হাসি মুখে একটা সেলফি তুলে রূপাকে পাঠালাম।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রূপা টুং করল।

ফেসবুকে আসো।

রূপা কভার ফটো দিয়েছে আমার ছবি। হাতে আর্জেন্টিনার ছোট পতাকা। ক্যাপশন দিয়েছে, ‘হিমুর হাতে একটি আকাশি-সাদা পতাকা।’

আমার খুব ইচ্ছে করছে একটা লাভ রি–অ্যাক্ট দিই। কিন্তু পরক্ষণেই সামলে নিয়েছি। হিমুরা কখনো লাভ রি–অ্যাক্ট দেয় না।

(জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের হিমু চরিত্র অবলম্বনে)