খুলনা ছাত্রলীগের শীর্ষ ১১ নেতা মাদক ব্যবসায় জড়িত

ছাত্রলীগের খুলনা মহানগর ও উপজেলা কমিটির অন্তত ১১ জন শীর্ষস্থানীয় নেতার বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার অভিযোগ উঠেছে সংগঠনের ভেতর থেকেই। তাঁদের সঙ্গে যুক্ত আছেন আরও নেতা-কর্মী।
শিক্ষা, শান্তি, প্রগতি ছাত্রলীগের মূল নীতি। কিন্তু খুলনা মহানগর, জেলা ও উপজেলার ছাত্রলীগের নেতাদের নামের সঙ্গে আলোচিত হয় মাদক ব্যবসা, ঠিকাদারি, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, লুট—এই কটি শব্দ।
কেবল পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা কিংবা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নয়, ছাত্রলীগের বিবদমান নেতারাই পরস্পরের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ তুলছেন, সংবাদ সম্মেলনও করছেন।
সংগঠনের বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খুলনা আওয়ামী লীগের নেতাদের দ্বন্দ্বের কারণে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরাও নানা দল-উপদলে বিভক্ত। ফলে সংগঠনে কোনো শৃঙ্খলা নেই। কেউ কারও কথা শুনছেন না।
আধিপত্য বিস্তার নিয়ে উপদলীয় সংঘর্ষ হচ্ছে। গত শনিবারও মাদক ব্যবসা ও কলেজে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেই খুলনার আযম খান সরকারি কমার্স কলেজে ছাত্রলীগের দুই পক্ষে সংঘর্ষ হয়েছে।
কেবল মহানগর নয়, খুলনার ৩১টি ওয়ার্ড, পাঁচটি উপজেলা ও ১৩টি কলেজ কমিটির নেতাদের বেশির ভাগেরই ছাত্রত্ব নেই। মূলত এই নেতাদের বিরুদ্ধেই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ।
জানতে চাইলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি এইচ এম বদিউজ্জামান গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘খুলনা মহানগর ও জেলার নেতারা সংগঠন গোছাতে পারেননি। আমরা খুব শিগগির প্রকৃত ছাত্রদের নিয়ে এখানে নতুন কমিটি করে দেব।’
মাদক ব্যবসা ও চাঁদাবাজি: খুলনা মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি দেবদুলাল বাড়ৈ ও সাধারণ সম্পাদক শাহ জামাল দুজনেই ব্যবসা করেন। দেবদুলালের ডুমুরিয়ায় একটি ইটভাটা রয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে খুলনার সিটি কলেজে মাদক ব্যবসা এবং সহসভাপতি সুজন হাজরার বিরুদ্ধে কমার্স কলেজে মাদক ব্যবসার অভিযোগ আছে। সংবাদ সম্মেলনে করে ছাত্রলীগে তাঁদের প্রতিপক্ষের নেতারাও এ অভিযোগ করেছেন। একই তথ্য পাওয়া গেছে একটি গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রেও। যদিও তাঁরা দুজনই এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
দলীয় সূত্র জানাচ্ছে, মহানগর ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক বদিউজ্জামান ওরফে মনাও মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। মাদক মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে তিনি কারাভোগ করেছেন তিন মাস। সিটি কলেজ এলাকায় চাঁদাবাজির অভিযোগও আছে তাঁর বিরুদ্ধে।
যশোরে মোটরসাইকেল ছিনতাই করতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে দুই মাস জেল খেটেছেন মহানগর কমিটির যুগ্ম সম্পাদক চয়ন মণ্ডল। শহরের ইস্টার্ন গেট এলাকায় চাঁদাবাজি করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন ক্রীড়া সম্পাদক জাফরিন আহমেদ। শিক্ষা ও পাঠচক্রবিষয়ক সম্পাদক মোরশেদ হোসেন ও ইমরান হোসেন পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলেন ফেনসিডিল সেবন করতে গিয়ে।
একটি গোয়েন্দা সংস্থার স্থানীয় সূত্র জানায়, নগরের ২২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মইনুল ইসলাম ওরফে জিলেট সুজন ছাত্রলীগের নেতাদের নিয়ে মাদক ব্যবসা করেন।
মইনুল ইসলাম বলেন, ‘ছাত্রলীগের যে অংশ এই অভিযোগ করেছে, তারা আমাকে হেয় করার জন্যই তা করেছে। কেউ যদি প্রমাণ করতে পারে আমি এসবের সঙ্গে জড়িত, তাহলে রাজনীতি ছেড়ে দেব।’
মহানগর ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হোসেনুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘নগর ছাত্রলীগের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির সভাপতি, সহসভাপতি সবুজ হাজরা ও সাধারণ সম্পাদক ছাত্রলীগকে কলুষিত করেছেন। খুলনার কলেজগুলোকে তাঁরা মাদকের আখড়ায় পরিণত করেছেন। এটা শহরের সবাই জানে। ছাত্রলীগের সাধারণ কর্মীরা তাঁদের হাত থেকে সংগঠনের রেহাই চান।’
তবে দেবদুলাল বাড়ৈ ও সাধারণ সম্পাদক শাহ জামাল দুজনই এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। দেবদুলাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি একসময় ব্যবসা করলেও এখন করি না। আর আমার ঠিকাদারি লাইসেন্স চার বছর ধরে নবায়ন করা হয়নি।’ মহানগর কমিটির অন্য নেতাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মনা, চয়নসহ যাদের বিরুদ্ধে যখন যে অভিযোগ উঠেছিল, আমরা তাঁর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছি।’
দেবদুলাল পাল্টা অভিযোগ তুলে বলেন, ছাত্রলীগের মহানগরের যুগ্ম সম্পাদক হোসেনুজ্জামান সাংসদ মিজানুর রহমানের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা। তিনি সাতক্ষীরার চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী। সাংগঠনিক সম্পাদক দেবাশীষ রায় একটি ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করছেন।
তবে হোসেনুজ্জামান এ অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন।
ফুলতলা উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আশরাফুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক রুবেল চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। ফেনসিডিল সেবন করতে গিয়ে রুবেল গত বছর নওয়াপাড়া থানা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। রুবেলের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগ আছে।
২০১২ সালের নভেম্বরে মহাজোটের শরিক দল জাতীয় পার্টির খুলনা জেলার ফুলতলা উপজেলার পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করা হয়, ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী বাহিনীর কাছে ফুলতলাবাসী জিম্মি হয়ে পড়েছে। দাকোপ উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সৌম্য বিশ্বাসের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসার অভিযোগ তুলেছেন সেখানকার ছাত্রলীগের কর্মীরা। সাধারণ সম্পাদক রতন মণ্ডলের বিরুদ্ধে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে টাকা আদায়ের অভিযোগ আছে। তবে দুজনেই এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মুশফিকুর জানিয়েছেন, নানা অভিযোগের কারণে সৌম্য বিশ্বাসকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
কয়রা উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি বাহারুল ইসলাম সুন্দরবন এলাকায় চোরাই কাঠ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তাঁর বিরুদ্ধে সাংবাদিক ও সরকারি কর্মকর্তাকে পেটানোর অভিযোগ আছে। সাধারণ সম্পাদক মাছুমের বিরুদ্ধেও মাদক ব্যবসার অভিযোগ আছে।
তেরখাদা উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি জাহিদ ফকিরের ছাত্রত্ব নেই। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, সরকারি জমি দখলের প্রতিবাদ করায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে মারধর করেন তিনি। এই উপজেলায় অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ছাত্রলীগ নেতা এমরান হোসেন নিহত হন। এ ক্ষেত্রেও অভিযোগের আঙুল জাহিদ ফকিরের দিকে।
ডুমুরিয়া উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মেহেদি হাসান রাজা ও সাধারণ সম্পাদক সরদার কবিরুল ইসলামের বিরুদ্ধেও মাদক ব্যবসার অভিযোগ আছে। এই দুই নেতা আবার পরস্পরের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ করেছেন।
জেলা ছাত্রলীগের নেতারা জানিয়েছেন, চুকনগর বাজারে এক ব্যবসায়ীর মাছ ছিনতাইয়ের অভিযোগে সরদার কবিরুল ইসলামকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হলেও পরে প্রত্যাহার করা হয়। রূপসা উপজেলা কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক বাবুর বিরুদ্ধেও চাঁদাবাজির অভিযোগ আছে।
সাইব্যার ক্যাফেতে অস্ত্র: খুলনা মহানগর ছাত্রলীগের সদস্য শফিকুল ইসলামের মালিকানাধীন আরএসএস সাইবার ক্যাফে থেকে গত বছরের আগস্টে পাঁচটি গুলি, একটি বিদেশি রিভলবার ও ছয়টি চাপাতি উদ্ধার করে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ। এ ঘটনায় শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা হয়। ঘটনার পর থেকে শফিকুল পলাতক। অস্ত্রগুলো মহানগর ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আলীমুল জিয়া দলীয় কাজে ব্যবহার করতেন বলে তখন জানা যায়।
আলীমুল জিয়া প্রথম আলোকে বলেন, তিনি অস্ত্র ব্যবহার করেন না। ৬ নম্বর ওয়ার্ডের এক নেতার নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ও-ই অস্ত্রটি ব্যবহার করত।’
জেলা কমিটির নেতারা ব্যবসয়ী: ছাত্রলীগের জেলা কমিটির সভাপতি আরাফাত হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক মুশফিকুর রহমান, সহসভাপতি আমিনুর রহমান ও তাজমুল হক ঠিকাদার। জেলা কমিটির সাবেক সভাপতি আবু হানিফও পেশায় ঠিকাদার। বর্তমানে তিনি আওয়ামী লীগের উপকমিটির সদস্য। জেলা কমিটির সহসভাপতি তানভীর হোসেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করেন। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুর রহমানের ছাত্রত্ব নেই। সাংগঠনিক সম্পাদক মেসবাহ মল্লিকও ব্যবসা করেন।
সংগঠনের নেতাদের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি বদিউজ্জামান বলেন, ‘কেউ কোনো অপরাধ করে থাকলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বলব তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন। আমরা সহায়তা করব।’
ভর্তি-বাণিজ্য, টিআরের চাল বিক্রি, টেন্ডারবাজি: খুলনার সরকারি আযম খান কমার্স কলেজে অনার্সে ভর্তি করার কথা বলে খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা উপজেলা ছাত্রলীগের সদস্যসচিব মসিউর রহমান একই উপজেলার হাটবাটি গ্রামের মুরছালিন গোলদার ও রনির কাছ থেকে গত বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০ হাজার টাকা নেন। কিন্তু ওই দুই ছাত্রকে ভর্তি করাতে না পারলে তাঁরা ছাত্রলীগের নেতাদের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন।
এই মসিউর রহমানের বিরুদ্ধে বারোভূঁইয়া দক্ষিণপাড়া বাইতুল মোকাদ্দাস জামে মসজিদের জন্য বরাদ্দকৃত টিআর চাল উত্তোলন করে আত্মসাৎ করার অভিযোগ করেছেন মসজিদ কমিটির নেতারা। বিচার চেয়ে মসজিদ কমিটির জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সম্পাদককে লিখিত অভিযোগ দিয়েছে।
মসিউর ও বাটিয়াঘাটা উপজেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক অরিন্দম গোলদারের বিরুদ্ধে টেন্ডারবাজির অভিযোগও আছে। ২০১২ সালের জুনে এক কোটি ৫৮ লাখ টাকার স্কুল ভবনের নির্মাণকাজের একটি দরপত্রে তাঁরা বাধা দিলে যুবলীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। পরদিন ছাত্রলীগের এই উপজেলার আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। কিন্তু জেলা কমিটির সভাপতি পরদিন সেই কমিটি বহাল করেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে খুলনা জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মুসফিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মসিউরের বিরুদ্ধে ছাত্র ভর্তির নামে টাকা নেওয়ার এবং মসজিদের চাল আত্মসাতের অভিযোগ আমরা পেয়েছি। এ ছাড়া টেন্ডারবাজির কারণে আমরা ওই কমিটি বাতিলও করেছিলাম।’