শাহবাগকে দুষছেন যাঁরা

শাহবাগের গণজাগরণ
শাহবাগের গণজাগরণ

ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই—এই মাস ছয়েকে কত কিছু দেখল বাংলাদেশ! ফেব্রুয়ারির শুরুতে শাহবাগের গণজাগরণ শুরু হওয়ার পর মনে হয়েছিল, এটাই বুঝি আমাদের বাংলাদেশ, এর বাইরে আর কিছু নেই। হঠাৎ কোথা থেকে হেফাজতে ইসলাম আমাদের সেই ধারণায় প্রথমে ধাক্কা ও পরে সবই যেন উল্টে দিল। গত ৬ এপ্রিল শাপলা চত্বরে হেফাজতের মহাসমাবেশ আমাদের যে ধাক্কা দিয়েছিল, ৫ মে হেফাজতের ঢাকা অবরোধ শেষে এ নিয়ে তাণ্ডব ও ধ্বংসযজ্ঞ তা চরম জায়গায় নিয়ে গেল। দেশ কি তবে হেফাজতের হয়ে গেল—এমন ভাবনায় চলে গেল এপ্রিল-মে দুই মাস। জুনের শুরু থেকে এল নতুন ইস্যু—চার সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। ১৫ জুনের এই নির্বাচনের ফলাফল আবার এক ধাক্কা। চার-চারটিতে জয়ের আশা সম্ভবত বিএনপিও করেনি। এই জোয়ার আওয়ামী লীগের গাজীপুরেও সব উল্টে দিল ৬ জুলাই। জুন আর জুলাইয়ের শুরুতে বাংলাদেশ যেন হয়ে গেল বিএনপির বাংলাদেশ। জুলাইয়ের মাঝামাঝি প্রথমে জামায়াতের শীর্ষ নেতা গোলাম আযম ও দুই দিন পর আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের রায় আবার এক ভিন্ন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। আগস্টে পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে কে জানে!
এত কিছু দেখতে চাননি অনেকেই। সরকারের জনপ্রিয়তা কমার যে লক্ষণ দেখা গেল সিটি নির্বাচনগুলোতে, তার জন্য সরকারের নানা ব্যর্থতা ও দুর্নীতি এবং সেই সঙ্গে দম্ভপূর্ণ অবস্থানকে দুষছেন অনেকে। তবে সরকারের লোকজন তা খুব মানেন বলে মনে হয় না। নানা উন্নয়নমূলক কাজ করেও তাঁরা কেন জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারলেন না, সেটাই নাকি এখন তাঁদের গবেষণার বিষয়। এমন পরিস্থিতিতে অনেকে পুরো দায় চাপাচ্ছেন শাহবাগের গণজাগরণকে। শাহবাগ না হলে হেফাজত আসত না, আস্তিক-নাস্তিক এসব নিয়ে দেশে হানাহানি বিভক্তি সৃষ্টি হতো না। আওয়ামী লীগের নেতা ও সমর্থকদের অনেকেও এখন মনে করেন, শাহবাগ দলটির ক্ষতি করেছে। স্থানীয় নির্বাচনে একের পর এক হারের কারণ নাকি শাহবাগের গণজাগরণ আর এর প্রতিক্রিয়ায় হেফাজতের উত্থান।
শাহবাগ আন্দোলন নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কম হয়নি। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত এই আন্দোলন নানা দিকে বাঁকও নিয়েছে। শাহবাগের গণজাগরণ যখন তুঙ্গে, তখনো একদিকে ন্যায়বিচারের দাবি, আবার ফাঁসি ছাড়া কিছুই মানি না—এ ধরনের অবস্থান অনেকের মনেই প্রশ্ন তুলেছিল। শাহবাগে কত দিন টানা অবস্থান করা উচিত বা কখন এটা গুটিয়ে ফেলা উচিত—এসব নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হয়েছে প্রতিদিন। স্বতঃস্ফূর্ত লোকসমাগমের এই গণজাগরণকে রাজনীতি তার নিজের কাজে লাগাতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। রাজনৈতিকভাবে সরকারি দল এদিক থেকে এগিয়ে ছিল। যুদ্ধাপরাধ বা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে বিএনপি সব সময়ই অস্বস্তিতে থেকেছে। কিন্তু এর পরও শুরুতে শাহবাগের গণজাগরণের পক্ষে বিবৃতি না দিয়ে পারেনি দলটি। পরে শাহবাগের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ এবং রাজনৈতিক নানা হিসাব-নিকাশ যখন স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তখন এর সরাসরি বিরোধিতায় নামে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। এর সঙ্গে যুক্ত হয় আস্তিক-নাস্তিকের এক নোংরা প্রচার কৌশল, যার অনেকটাই সফল হয়েছে বলতে হবে। এখন পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে প্রধান বিরোধী দলের কাছে শাহবাগের গণজাগরণ হচ্ছে ‘ফ্যাসিবাদের’ প্রকাশ আর সরকারি দলের কাছে এক বড় আপদের নাম শাহবাগ।
যে চেতনার জায়গা থেকে শাহবাগের গণজাগরণ শুরু হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত দেশের প্রধান দল দুটির কাছে এভাবেই বিবেচিত হবে, এটাই তো স্বাভাবিক। ৫ ফেব্রুয়ারি বিকেলে শাহবাগে তরুণেরা জড়ো হয়েছিল কোন ক্ষোভ থেকে? মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় এর আগেও একটি রায় হয়েছিল। সে রায়ে পলাতক আবুল কালাম আযাদের ফাঁসির আদেশ হয়েছে। কাদের মোল্লার মতো রাজনীতিতে তিনি তেমন সক্রিয় ছিলেন না, বা তিনি এত গুরুত্বপূর্ণ নেতাও নন। দ্বিতীয় রায়ে ‘কসাই কাদের’ হিসেবে পরিচিত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লার যখন যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলো, তখন এক হতাশা ছড়িয়ে পড়েছিল তরুণদের মধ্যে। একই সঙ্গে সংশয়, রাজনৈতিক বিবেচনায় এই রায় হয়নি তো! এই রায় কি সরকারের সঙ্গে জামায়াতের আঁতাতের ফল? শাহবাগের শুরুটা হয়েছিল আসলে সরকারের প্রতি সন্দেহ আর অবিশ্বাস থেকে। আর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড নিয়ে অসন্তুষ্টির সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে ভবিষ্যতে কাদের মোল্লার মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির অবস্থানটি কোনো লুকানো বিষয় নয়। সামনে বিএনপি ক্ষমতায় এলে কাদের মোল্লারা ছাড়া পেয়ে যাবেন—এটাই স্বতঃসিদ্ধ মনে হয়েছে অনেকের কাছে। শাহবাগের শুরু হয়েছিল আসলে দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের প্রতি অনাস্থা থেকে।
শাহবাগে যে তরুণেরা উদ্যোগী হয়ে জড়ো হয়েছিলেন, তাঁরা কেউ মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি। আমাদের সমাজের অনেকেই যখন ভাবতে শুরু করেছিলেন যে মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্মের আয়ু কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ নিয়ে আবেগ কমে যাবে। শাহবাগ সেই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছে। দেখিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ এই প্রজন্মের কাছেও কতটা আবেগের, কতটা প্রাণের। মুক্তিযুদ্ধ ও এর চেতনা শুধু ক্ষমতাবলয়ের মধ্যে নয়, এর বাইরেও কতটা প্রবল। সাম্প্রতিক সময়ে আরব দুনিয়ার দেশে দেশে যে গণজাগরণ হয়েছে, তা হয়েছে সরকারের দুঃশাসন ও অন্যায়-নিপীড়নের বিরুদ্ধে। সেদিক থেকে এক অনন্য গণজাগরণের সূচনা করেছিল শাহবাগ। কোন দল বা সরকারের পক্ষে-বিপক্ষে নয়, একটি চেতনার পক্ষে।
নতুন প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে আগ্রহ তৈরি হয়েছে এবং যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রতি যে সমর্থন প্রকাশ পেয়েছে, তাকে নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসতে শুরু থেকেই শাহবাগের পক্ষে দাঁড়ানোর কৌশল নেয় আওয়ামী লীগ। শাহবাগের পক্ষে সরকারের সমর্থন ছিল প্রকাশ্য, কিন্তু আন্দোলনকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে বা নিজের পক্ষে কাজে লাগাতে নানা তৎপরতা ও সাহায্য-সহযোগিতা কোনো কিছুই শেষ পর্যন্ত গোপন থাকেনি। কিন্তু এটা মানতেই হবে যে শাহবাগের শুরুটা যেমন সরকার করেনি, তেমনি সরকারের সমর্থনও সেখানে লোকসমাগম বাড়াতে সাহায্য করেনি। জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণকে বরং নিজেদের পক্ষে নিতে চেয়েছে সরকার। কিন্তু সরকার যত শাহবাগে জড়িয়েছে, নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা
করেছে শাহবাগ ততই স্বতঃস্ফূর্ততা হারিয়েছে। শাহবাগ নিয়ে এমন কোনো মূল্যায়নে যায়নি সরকারি দল, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া এই দলটি এখন শাহবাগের গন্ধ গা থেকে ছাড়াতে পারলেই যেন বাঁচে।
শাহবাগের পক্ষে দাঁড়ানোর কোনো কারণ ছিল না বিএনপির। কিন্তু এর স্বতঃস্ফূর্ততার কাছে মাথা নোয়াতে হয়েছিল দেশের প্রধান বিরোধী দলটিকে। মানবতাবিরোধী বিচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া এই দলটিকেও শুরুতে শাহবাগের গুণগানই গাইতে হয়েছে। সরকার যখন শাহবাগের সঙ্গে নিজেদের একাকার করে ফেলেছে, তখন বিএনপির আর উল্টো পথ না ধরে উপায় কী! শাহবাগে তত দিনে ‘ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি’ শুনতে পেতে শুরু করেছে বিএনপি। হেফাজতের পাল্টা ‘জাগরণ’ তখন হয়ে ওঠে দলটির সহায়ক শক্তি।
শাহবাগ নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মতো বড় দুটি দলের যা করার কথা তারা তা-ই করেছে। যখন সুবিধা মনে হয়েছে তখন শাহবাগের সঙ্গে নিজেদের একাকার করেছে, সমর্থন পাওয়ার চেষ্টা করেছে। এখন যখন হিসাব মেলাতে ঝামেলা হচ্ছে, তখন শাহবাগের গন্ধ গা থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে, শাহবাগকে ফ্যাসিবাদ, নাস্তিকদের সমাবেশ বলে গালি দেওয়া হচ্ছে। রাজনীতিবিদেরা তা করছেন করুক। আগামী নির্বাচনও সেখানে জয়-পরাজয়ের হিসাব-নিকাশই এখন তাঁদের কাছে সবচেয়ে বড়। কিন্তু এর বাইরেও অনেকে রয়েছেন, যাঁরা দুষছেন শাহবাগকে। বলছেন, হেফাজতে ইসলামের উত্থান হয়েছে শাহবাগের কারণে। সমাজে বিভক্তি সৃষ্টির দায় নাকি শাহবাগের। তাদের উদ্দেশে বলি, শাহবাগ হেফাজতের উত্থান ঘটায়নি, হেফাজত এই সমাজেই ছিল, তবে শক্তি হিসেবে আমাদের অনেকেরই দৃষ্টি ও বিবেচনার বাইরে ছিল। শাহবাগের গণজাগরণ যেমন আলো জ্বালিয়েছে, তেমনি প্রদীপের নিচের অন্ধকারকেও দেখিয়েছে। শাহবাগের গণজাগরণ আমাদের চোখ খুলতে সাহায্য করেছে, অন্ধত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছে।
হেফাজত যদি আমাদের সমাজের জন্য সমস্যা হয়ে থাকে, তবে এই সমস্যা সামনে নিয়ে আসার কৃতিত্ব শাহবাগকে দিতে হবে। শাহবাগের গণজারণ সমাজে হেফাজতে ইসলামের মতো একটি শক্তি ও তাদের শক্তি-সামর্থ্যের বিষয়টি আমাদের সামনে স্পষ্ট করেছে। শাহবাগ না হলে হয়তো ভবিষ্যতে অন্য কোনো উপলক্ষে আমরা এই শক্তির অস্তিত্ব টের পেতাম। শাহবাগ আগেভাগেই তা আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। তলে তলে একটি সমাজ বিভক্ত হয়ে পড়লে পরিণতি কী হতে পারে, সাম্প্রতিক সময়ের মিসর তার বড় উদাহরণ। দেশ আর সমাজ নিয়ে আমাদের এখানে যাঁরা চিন্তাভাবনা করেন, গবেষণা করেন, নীতি-নির্ধারণী কাজে যা বিবেচনায় নেওয়া হয়, তাদের এখন হেফাজতের মতো একটি শক্তিকে বিবেচনায় নিয়েই কাজ করতে হবে। মিসরের মতো পরিস্থিতি নিশ্চয়ই আমরা এড়াতে চাই। শাহবাগ আমাদের সেই সময় ও সুযোগ করে দিয়েছে।
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
[email protected]