ভারত-পাকিস্তান ভাগ ও একটি প্রেমের গল্প

ভগবান সিং মাইনি ও প্রিতম কাউর। ছবি: সংগৃহীত
ভগবান সিং মাইনি ও প্রিতম কাউর। ছবি: সংগৃহীত

অসাধারণ একটি গল্পের উপাদান দুটি সাধারণ জিনিস—এমব্রয়ডারি করা একটি ঐতিহ্যবাহী শীতের পোশাক এবং ম্যাটমেটে বাদামি রঙের চামড়ার ব্রিফকেস। এগুলোর মালিক একজন পুরুষ ও একজন নারী। তাঁরা থাকতেন ঔপনিবেশিক ও অবিভক্ত ভারতের পাঞ্জাবে। মা-বাবার মাধ্যমেই তাঁদের নিজেদের মধ্য পরিচয় ঘটে। তাঁদের মন দেওয়া-নেওয়া শুরু ১৯৪৭ সালে। দেশ বিভাগের সেই অগ্নিগর্ভ সময়টায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বা দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। কিন্তু মাঝখানে নানা বিপত্তিতে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় তাঁদের। পরে শরণার্থী হিসেবে দাঁড়িয়ে থেকে দুজনে দেখা হয়।

ভারত ও পাকিস্তান ভাগ হওয়ার পর এভাবেই মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে নিজ নিজ গন্তব্যে গেছে। ছবি: সংগৃহীত
ভারত ও পাকিস্তান ভাগ হওয়ার পর এভাবেই মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে নিজ নিজ গন্তব্যে গেছে। ছবি: সংগৃহীত

রক্তাক্ত, সহিংসতার পর উপমহাদেশে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম। সেই সময় সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সূত্রপাত হয়, যার ফলে ১০ লাখের বেশি মানুষ মারা যায় এবং কয়েক কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। ভাগ হয় পাঞ্জাব। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঞ্জাবের পশ্চিমাঞ্চল পাকিস্তানের অংশে পড়ে আর হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্বাঞ্চল ভারতের অংশে। নতুন প্রেমে পড়া ৩০ বছর বয়সী ভগবান সিং মাইনি নামের ওই পুরুষ ও ২২ বছর বয়সী প্রিতম কাউর নামের নারী ছিলেন শিখ। এখন যেটি পাকিস্তানের পাঞ্জাব, সেখানে ছিল তাঁদের বাস।

এমব্রয়ডারি করা একটি ঐতিহ্যবাহী পোশাক এবং চামড়ার ব্রিফকেস। ছবি: সংগৃহীত
এমব্রয়ডারি করা একটি ঐতিহ্যবাহী পোশাক এবং চামড়ার ব্রিফকেস। ছবি: সংগৃহীত

দেশ বিভাগের সেই দাঙ্গায় ভগবান সিংয়ের তিন ভাইকে হত্যা করা হয়। তিনি তাঁর সার্টিফিকেট ও সম্পত্তির দলিল ওই ব্রিফকেসে নিয়ে মিয়ানওয়ালির বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান। এদিকে আড়াই শ কিলোমিটারের বেশি দূরে গুজরানওয়ালায় ঘরবাড়িহারা প্রিতমের পরিবার তাঁকে অমৃতসরগামী একটি ট্রেনে উঠিয়ে দেয়। দুই বছর বয়সী ভাইকে কোলে নিয়ে এবং শীতের ওই পোশাকটি একটি ব্যাগে ভরে প্রিতম সহিংসতাপূর্ণ সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে পৌঁছান। দেশভাগের ফলে ভারত ও পাকিস্তানের সীমান্ত পাড়ি দেওয়া কোটি মানুষের মধ্যে ছিলেন তাঁরা দুজনও। একদিন অমৃতসরের একটি শরণার্থীশিবিরে ঘটে যায় আশ্চর্য এক ঘটনা। খাবারের জন্য অপেক্ষায় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় আবার তাঁদের দেখা হয়। তাঁরা তাঁদের দুঃখের কাহিনিগুলো বলেন। দুটি মানুষ বিস্মিত হন এই ভেবে যে ভাগ্য তাঁদের আবারও একত্রিত করেছে। ১৯৪৮ সালের মার্চে তাঁরা বিয়ে করেন। বিয়ের অনুষ্ঠানে প্রিতম তাঁর সেই প্রিয় শীতের পোশাকটি পরেছিলেন। বিয়ের পর ভগবান সিং শুরু করেন নতুন জীবন। তাঁর ব্রিফকেসে আনা সার্টিফিকেট এবং দলিলাদি বের করেন ভগবান। কাজ শুরু করেন পাঞ্জাবের বিচার বিভাগে। ক্ষতিপূরণ হিসেবে পান ছোট্ট একটি বাসা। তাঁদের দুই সন্তানই সরকারি চাকরিতে ছিলেন। ৩০ বছর আগে মারা গেছেন ভগবান সিং। আর স্ত্রী ২০০২ সালে মারা যান। গত বছরের ৩০ অক্টোবর অমৃতসরে ভারত সরকার একটি দেশ বিভাগ জাদুঘর উদ্বোধন করে। ভগবান সিং ও প্রিতমের পরিবার তাঁদের ব্রিফকেস ও শীতের পোশাকটি জাদুঘরে প্রদর্শনীর জন্য দিয়েছেন।

ভগবান সিংয়ের ছেলের বউ মাইনি বলছিলেন, ‘নিজেদের বিয়োগান্ত ঘটনার কথা তাঁরা বিনিময় করেছেন। এটা এমন এক ব্যাপার যে নিয়তি তাঁদের একসঙ্গে আরও একবার আনল। যে কারণেই হোক, পরিবারছাড়া হয়েও একসময়ে আবার তাঁদের দেখা হয়।’

মাইনি বলেছেন, ‘যে জীবন তাঁরা হারিয়ে ফেলেছিলেন, তা আবার একসঙ্গে পাওয়ার সাক্ষ্য হয়ে আছে জ্যাকেট ও ব্রিফকেস।’ ওই জ্যাকেট ও ব্রিফকেস এখন দেশভাগের স্মৃতি নিয়ে তৈরি ভারতের জাদুঘরের সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু।’

আগামী বছরের শুরুর দিকে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জাদুঘরে রাখা ছবি, চিঠিপত্র, অডিও রেকর্ডিং, অফিশিয়াল নথি, মানচিত্র, সংবাদপত্রের কাটিংসহ দেশভাগের স্মৃতিজড়িত নানা বস্তু ও জিনিসপত্র সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।

দেশভাগ নিয়ে ১৭ হাজার বর্গফুটের দোতলার ওই জাদুঘরের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মল্লিকা আহলুওয়ালিয়া বলেছেন, ‘এই জাদুঘরটি দেশভাগের স্মৃতি নিয়ে তৈরি। এটি দেশভাগের বিষয় নিয়ে সবচেয়ে ব্যাপক এবং বিশ্বের এ ধরনের একমাত্র জাদুঘর।’ বিবিসি অবলম্বনে রাশেদুল আলম রাসেল।

দেশভাগ নিয়ে এই সময়ের পত্রিকায় প্রকাশিত খবর। ছবি: সংগৃহীত
দেশভাগ নিয়ে এই সময়ের পত্রিকায় প্রকাশিত খবর। ছবি: সংগৃহীত