কোন ঘুঁটি চালছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী?

পাকিস্তানের ইসলামাবাদে তেহরিক-ই-লাব্বাইকের নেতা-কর্মীরা সহিংস কর্মকাণ্ড চালায়। ছবি: রয়টার্স
পাকিস্তানের ইসলামাবাদে তেহরিক-ই-লাব্বাইকের নেতা-কর্মীরা সহিংস কর্মকাণ্ড চালায়। ছবি: রয়টার্স

পাকিস্তানের ধর্মভিত্তিক ছোট একটি দল তেহরিক-ই-লাব্বাইক। অপরিচিত কট্টরপন্থী দলটির নাম তেমন কেউ জানত না। টানা প্রায় তিন সপ্তাহের বিক্ষোভ-সহিংসতায় নামটা এখন শুধু দেশে নয়, বিদেশেও নাম ছড়িয়েছে। ছোট এই দল এত জোর পাচ্ছে কোথায়? কেই–বা দিচ্ছে আশকারা?

ঘটনার শুরু নির্বাচনী আইন সংশোধনের সময় জনপ্রতিনিধিদের শপথের একটি অংশে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-র নাম উল্লেখ না করা থেকে। ঘটনাটি নজরে আসার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমা চান তৎকালীন আইনমন্ত্রী জাহিদ হামিদ। 

কে শোনে তাঁর কথা? সতেজ তোপ তখন বেগবান। এএফপির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ধর্মীয় অবমাননার (ব্লাসফেমি) অভিযোগে আইনমন্ত্রীর পদ থেকে জাহিদ হামিদের অপসারণ চেয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন তেহরিক-ই-লাব্বাইকের নেতা-কর্মীরা। গত ৬ নভেম্বর দলটির হাজার দুয়েক নেতা-কর্মী এই দাবিতে রাজধানী ইসলামাবাদের সড়কে অবস্থান নেন। চলে সংঘর্ষ, ঘটে রক্তপাত। অন্যতম শহর রাওয়ালপিন্ডিতেও এই সহিংস বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। বছর দুই আগে প্রতিষ্ঠিত দলটির সঙ্গে যোগ দেয় আরও কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দল। ইসলামাবাদ থেকে বিক্ষোভকারীদের হটাতে কঠোর অবস্থানে যায় নিরাপত্তা বাহিনী। তারা ধর্মীয় কট্টরপন্থীদের হটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে সংঘর্ষ বাধে। এতে কমপক্ষে ছয়জন নিহত হয়। আহত হয় অন্তত ২০০ জন। দেড় শতাধিক ব্যক্তিকে আটক করা হয়। কিন্তু পিছু হটেনি বিক্ষোভকারীরা। বরং বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে অন্য বড় শহর করাচি, লাহোর ও পেশোয়ারে। পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে সহিংস কর্মকাণ্ড।

পাকিস্তানের আদালত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারকে নির্দেশ দেন। সরকার তখন সেনা তলব করে। ইসলামাবাদ ও রাওয়ালপিন্ডি ১৯ দিন ধরে অচল হয়ে থাকলেও সরকারের নির্দেশ পেয়ে মাঠে নামেনি সেনাবাহিনী। দেশটির ঐতিহ্যবাহী ইংরেজি দৈনিক ডন অনলাইনে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, নির্দেশ পালন না করে সেনাবাহিনী উল্টো জানায় যে তারা সরকারকে সাহায্য করতে ‘পুরোপুরি প্রস্তুত’। তবে এর আগে আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী সেনা মোতায়েনের বিষয়টি তাদের কাছে পরিষ্কার করতে হবে।

এরপর পাকিস্তানের সেনাপ্রধান কামার জাভেদ বাজওয়া প্রধানমন্ত্রী শহীদ খাকান আব্বাসি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আহসান ইকবাল ও আইএসআইয়ের মহাপরিচালক নাভিদ মুখতারের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেই বৈঠকে সেনাপ্রধান জানিয়ে দেন, বিক্ষোভকারীদের সরাতে বলপ্রয়োগ করতে চান না তাঁরা। বরং রাজনৈতিক সমঝোতার চেষ্টা করার কথা বলে রাজনীতিবিদদের কোর্টে বল ঠেলে দেন। বিষয়টি নিয়ে বিরক্ত রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহিদ হোসেইন বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, সেনাবাহিনীর কাজ সরকারের নির্দেশ পালন করা। কিন্তু তারা সেটা না করে উল্টো সরকারকে পরামর্শ দিচ্ছে, কী করা উচিত আর কী করা উচিত না।

এই বৈঠকের পরের দিন ২৭ নভেম্বর ধর্মীয় কট্টরপন্থীদের দাবি অনুযায়ী আইনমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন জাহিদ হামিদ। তবে পদত্যাগপত্রে উল্লেখ করেন, ব্যক্তিগত কারণে তিনি পদ ছাড়লেন। পাকিস্তানের ৭০ বছরের ইতিহাসে রাজনীতিকদের তুলনায় যে সেনারা শক্তিশালী, সেটাই আবার প্রমাণিত হলো। এই পদত্যাগের পর পরিস্থিতি বদলে যায়। বিক্ষোভকারীরা ঘরে ফিরতে শুরু করে। এখানেই ঘটনার শেষ হতে পারত। তবে সেটা হয়নি।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভিডিও প্রকাশ পায়, যাতে দেখা যায়, পাকিস্তানের একজন জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তা ইসলামাবাদে বিক্ষোভকারীদের মধ্যে খামে করে অর্থ বিতরণ করছেন। ধর্মীয় কট্টরপন্থীদের প্রতি দেশটির সেনাবাহিনীর পক্ষপাতের কথা অজানা নয়। তাই এই ভিডিওকে কেন্দ্র নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে।

ইসলামাবাদে বিক্ষোভকালে পুড়িয়ে দেওয়া একটি প্রিজন ভ্যান সরিয়ে নেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ছবি: রয়টার্স
ইসলামাবাদে বিক্ষোভকালে পুড়িয়ে দেওয়া একটি প্রিজন ভ্যান সরিয়ে নেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ছবি: রয়টার্স

এই ভিডিওর বরাত দিয়ে বিবিসি অনলাইনে লেখা হয়েছে, পাঞ্জাব রেঞ্জারসের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজহার নাভিদ হায়াত এক হাজার রুপি করে বিক্ষোভকারীদের মধ্যে বিতরণ করেন। এ সময় তিনি এক বিক্ষোভকারীকে বলেন, ‘এটা আমাদের তরফ থেকে আপনাদের জন্য উপহার। আমরা কি আপনাদের সঙ্গে নেই?’ আরেকজনের হাতে অর্থ তুলে দেওয়ার সময় এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, ‘যাদের আটক করা হয়েছে, তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে।’ সবাইকে দেওয়ার জন্য ব্যাগে করে টাকা নিয়ে আসা হয়েছে বলে ওই ভিডিওতে তাঁকে বলতে শোনা যায়।

কে এই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেছেন, তা স্পষ্ট নয়। তবে সেনাবাহিনীবিরোধী মনোভাব পোষণ করেন—এমন সাংবাদিক ও নাগরিকদের এই ভিডিও শেয়ার করতে দেখা যাচ্ছে। তাহা সিদ্দিকি নামের এক সাংবাদিক লিখেছেন, ‘তারা তো এমনই। তাই এই ভিডিও দেখে আমি বিস্মিত হইনি।’ ওমর আর কুরাইশি নামের এক টেলিভিশন সাংবাদিক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘জনগণের অর্থের কী যে ভালো ব্যবহার!’

মজার ব্যাপার হলো, এই ঘটনায় সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে বিভক্ত হয়ে গেছে আদালত। অচলাবস্থা নিরসনে সেনাবাহিনী সমঝোতাকারীর ভূমিকা পালন করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন ইসলামাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি শওকত আজিজ সিদ্দিকি। তিনি বলেছেন, ‘সমঝোতাকারীর ভূমিকা নেওয়ার সেনাবাহিনী কে? আইনের কোথায় একজন মেজর জেনারেলকে এই এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে?’ তবে লাহোর হাইকোর্টের বিচারপতি কাজী মুহাম্মদ আমিন আহমেদ সেনাদের ভূমিকার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলেন, পাকিস্তানকে বড় ধরনের বিপর্যয় থেকে বাঁচিয়েছে সেনাবাহিনী।

নিন্দুকেরা বলে, পাকিস্তানে রাজনৈতিক সরকার থাকলেও দেশ পরিচালনায় কলকাঠি নাড়ে সেনাবাহিনী। ধর্মীয় কট্টরপন্থীদের সাম্প্রতিক এই ঘটনায় বিষয়টি যেন আবার প্রমাণিত হলো। তাদের কাছ থেকে সবুজ সংকেত না পেলে নিশ্চয় ছোট একটি ধর্মীয় সংগঠনের পক্ষে টানা এত দিন সহিংস অবস্থান চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হতো না। অবশ্য এসব অভিযোগের ব্যাপারে সেনাবাহিনীর তরফ থেকে কোনো বিবৃতি দেওয়া হয়নি। তাদের এই নীরব থাকা যেন এমন এক পরিস্থিতিকে তুলে ধরছে, যেখানে মারকুটে ঘুঁটি হাতে দুর্দান্ত চাল দেওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে তারা।