ট্রাম্প ধ্বংস করে দিলেন লায়লার স্বপ্ন?

লায়লা দানেশভার। ছবি এএফপি
লায়লা দানেশভার। ছবি এএফপি

পুরুষতান্ত্রিক ইরানে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রথম নারী মালিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে রীতিমতো লড়াই করতে হয়েছে তাঁকে। ইউরোপীয় বিনিয়োগকারীদের সহযোগিতায় একটু একটু করে সাফল্যের চূড়ায় উঠছিলেন তিনি। তবে পৃথিবীতে টিকে থাকা যে আসলেই কঠিন, এই চরম সত্য তাঁকে বোঝাতে শুরু করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। স্বপ্নের চূড়া থেকে তাঁকে সমতল এই পৃথিবীতে নামিয়ে এনেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।

বলছি লায়লা দানেশভারের কথা। ইরানের মতো একটি কট্টরপন্থী দেশে একজন নারী হিসেবে নিজের অবস্থান তৈরি করে নিতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে তাঁকে। তবে যন্ত্র প্রকৌশলী হিসেবে নিজের অবস্থান তিনি শক্তভাবেই তৈরি করতে পেরেছেন। বার্তা সংস্থা এএফপির এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে তাঁর এই স্বপ্নপূরণের গল্প।

ছোটবেলা থেকে কাজ করার তীব্র আগ্রহ ছিল লায়লা দানেশভারের। বাবার গাড়ির ওয়ার্কশপের মেঝেতে বসে ছোট্ট মেয়েটি সব সময় কাজ চাইত। ‘বাবা একজন মিস্ত্রি ছিলেন, আমি যখন তাঁর সঙ্গে গ্যারেজে যেতাম আমার অসম্ভব মজা লাগত’—এভাবে শুরুর বিষয়ে বলছিলেন লায়লা।

লায়লার আগ্রহ যন্ত্র নিয়ে থাকলেও সে সময়ে যন্ত্র প্রকৌশলী নিয়ে পড়াশোনার কোনো সুযোগ ছিল না। এ জন্য ভারতে পড়তে যান তিনি। মজার বিষয় হচ্ছে তাঁর বছরে ১৩৯ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে তিনিই ছিলেন একমাত্র নারী। ওই দিনগুলো বেশ কঠিন ছিল বলে মন্তব্য করেন লায়লা। তবে সব বাধায় উতরে গেছেন তিনি। ৩৭ বছরের লায়লা এখন ইরানে নিজের প্রতিষ্ঠান চালান। হাসপাতালের জন্য এবং বয়স্কদের চলাচলের সরঞ্জাম তৈরি করেন তিনি।

নিজের কারখানায় কাজ করছেন লায়লা দানেশভার। ছবি: এএফপি
নিজের কারখানায় কাজ করছেন লায়লা দানেশভার। ছবি: এএফপি

কাজের সূত্রে একসময় ইউরোপে যান তিনি। সেখানকার সমাজব্যবস্থা তাঁকে মুগ্ধ করে। ‘আমি ইউরোপে গিয়েছিলাম, দেখেছিলাম প্রতিবন্ধী মানুষেরাও কত সুখী, কত স্বাধীনভাবে চলাচল করতে পারছেন। আমার মনে হয়েছিল আমাদের দেশেও তো এসব সরঞ্জাম থাকতে পারে। ওগুলো তৈরি করা আমার কাছে খুব বেশি জটিল মনে হয়নি। আমি একজন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। আমি এগুলো তৈরি করতে পারব’—এমন ভাবনা আসে তাঁর মনে।

ইরানের ওপর দীর্ঘ এক দশক ধরে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা উঠে যায় ২০১৬ সালের ১৭ জুলাই। ইরানের বিতর্কিত পরমাণু কর্মসূচিকে ঘিরে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে জারি করা হয়েছিল ওই সব অবরোধ। এরপর বড় একটি সুযোগ আসে লায়লার কোম্পানি কেটিএমএর। বিশ্ববিখ্যাত ব্র্যান্ড লর্ডের অধীনে বিক্রির সুযোগ পায় তারা।

অবরোধ তুলে নেওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে সুইডেনের অ্যানা রাসবার্গ নামের এক বিনিয়োগকারী লায়লার কোম্পানির ২৫ শতাংশ কিনে নিতে সম্মত হন। এতে প্রয়োজনীয় ব্যবসায়িক মূলধন আনা সম্ভব হয়। অ্যানা বলেন, ‘ভালো মানের পণ্যের জন্য লায়লার কোম্পানির বেশ সুনাম রয়েছে, যা আসলে ইউরোপে অজানা ছিল। কিন্তু আমি এই ব্যবসাকে এগিয়ে নিতে চাচ্ছিলাম। মানুষ বলতে শুরু করে আমরা খুবই ভালো করছি। দুজন দুজনের জ্ঞানকে সম্মান করি। তিনি একজন প্রকৌশলী আর আমি পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী।’

এরপরও কি প্রতিকূলতা পিছু ছাড়ে? একজন নারী হয়ে এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার বিষয়টি অনেকেই মেনে নিতে পারছিলেন না। তবে সব বাধা পেরিয়ে এগিয়েই চলছিলেন লায়লা। এভাবেই সবকিছুই ঠিকঠাকমতো চলছিল। কম উৎপাদন খরচে পণ্য তৈরি করত লায়লার কোম্পানি। এ জন্য যেকোনো দেশে তাঁরা স্বল্প মূল্যে পণ্য সরবরাহের প্রস্তাব দিতে পারতেন। একসময় বিষয়টি মনোযোগ কাড়ে কাতারের হাসপাতালগুলোর। তারা পণ্য নেওয়া শুরু করে।

নিজের কারখানায় কাজ করছেন লায়লা দানেশভার। ছবি: এএফপি
নিজের কারখানায় কাজ করছেন লায়লা দানেশভার। ছবি: এএফপি

তবে লায়লার এগিয়ে যাওয়ার এই স্বপ্ন মিইয়ে দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইউরোপীয় মিত্রদের অনুরোধ উপেক্ষা করে ইরানের সঙ্গে করা পরমাণু চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন তিনি। ইরানের সঙ্গে ২০১৫ সালে করা এই চুক্তিকে তিনি ‘জঘন্য’ ও ‘ত্রুটিপূর্ণ’ বলে মন্তব্য করেন। তবে এই প্রত্যাহারের আগেও নানা হুমকিধমকি দিয়ে আসছিলেন ট্রাম্প, যা দেশটির বাণিজ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে শুরু করে। প্রয়োজনীয় কাঁচামাল বিশেষ করে স্টেইনলেস স্টিল আমদানি কঠিন হয়ে পড়ে।

লায়লা বলেন, আমরা ইতিমধ্যে কাঁচামাল সংগ্রহ করতে গিয়ে বিপাকে পড়ছি। এখন বিষয়টি অসম্ভব হয়ে পড়ল। এখন হয় আমাদের কারখানা বন্ধ করে দিতে হবে, নতুবা অনেক বেশি খরচে উৎপাদন চালিয়ে যেতে হবে। গত মাসে আমারদের চার-পাঁচজন কর্মী চলে গেছেন। কারণ আমরা বেতন দিতে পারছিলাম না। এতে আমার হৃদয় ভেঙে গেছে।’

তবে অদম্য লায়লা থেমে থাকার মানুষ নন। তিনি বলেন, ‘প্রায় ১ কোটি বৃদ্ধ ও যুদ্ধাহত মানুষ রয়েছে ইরানে। তাই ট্রাম্প থাকুক বা থাকুক আমাদের ব্যবসার সুযোগ রয়েছে।’

তবে অনেকেই মনে করছেন, অবরোধ দিয়ে ইরানের অর্থনীতি ধ্বংস করার যে পরিকল্পনা নিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট, এতে হয়তো ব্যবসা টিকিয়ে রাখা নিয়ে সংশয় তৈরি হতে পারে। তবে অ্যানার মতো বিনিয়োগকারী যে আর আগ্রহী হবেন না, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

তেহরানের বিতর্কিত পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে সমঝোতার লক্ষ্যে টানা তিন বছর ধরে জটিল ও অনিশ্চয়তায় ভরা আলোচনার পর ২০১৫ সালের জুলাইয়ে ইরান ও ছয় জাতির (জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী পাঁচ সদস্য রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য এবং জার্মানি) মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় পরমাণু চুক্তি। চুক্তিটির আওতায় ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচি উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে আনতে সম্মত হয়। বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র, ইইউসহ পাশ্চাত্য তেহরানের ওপর আরোপিত অবরোধগুলো ধাপে ধাপে প্রত্যাহার করে নিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। তবে চলতি মাসে এই চুক্তি থেকে সরে আসার ঘোষণা দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।