ব্রেক্সিট বেদনায় অস্থির যুক্তরাজ্য

২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে দুজন ‘হেভিওয়েট’ মন্ত্রীর পদত্যাগের ঘটনা ব্রেক্সিট প্রশ্নে যুক্তরাজ্য সরকারের অস্থিরতার স্বরূপকে উন্মোচন করে দিয়েছে। সেই সঙ্গে এ ঘটনা প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মের নেতৃত্বের নড়বড়ে ভিতকে আরও ঝাঁকিয়ে দিল।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে যুক্তরাজ্যের বিচ্ছেদকে বলা হচ্ছে ব্রেক্সিট। সেই ব্রেক্সিটের দিনক্ষণ ঠিক হয়েছে মাত্র। ব্রেক্সিট-পরবর্তী বাণিজ্য ও অন্যান্য আদান-প্রদানের সম্পর্ক কেমন হবে—তা এখনো ঠিক হয়নি। ওই সম্পর্ক নির্ধারণে ইইউর সম্মতি হলো আসল এবং তা এখনো বহু দূরে। কিন্তু ভবিষ্যৎ সম্পর্কের প্রস্তাব তৈরি করতেই টালমাটাল যুক্তরাজ্য সরকার। যেন বিচ্ছেদ কার্যকর হওয়ার আগেই বেদনায় অস্থির হয়ে উঠেছে তারা।

ইইউর নীতি অনুযায়ী এর সদস্যভুক্ত দেশগুলো নিজেদের মধ্যে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য করে, সদস্যবহির্ভূত দেশের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে একক শুল্কনীতি মেনে চলে, সদস্য দেশগুলোর নাগরিকেরা জোটের যেকোনো দেশে অবাধে চলাচল করতে পারে এবং সব নাগরিক সুবিধা ভোগ করে। বিজ্ঞান, গবেষণা, কৃষি ও পরিবেশসহ নানা বিষয়ে সম্মিলিত উদ্যোগ ও সহযোগিতার নীতি মেনে চলে।

কিন্তু ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত গণভোটে যুক্তরাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটার ইইউ জোট ত্যাগ করার পক্ষে রায় দেয়। জোটভুক্ত অন্য দেশগুলো থেকে অবাধে লোক প্রবেশ করার কারণে যুক্তরাজ্যে অভিবাসীর সংখ্যা বেড়ে গেছে এবং দেশটির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও আবাসনসহ সব ক্ষেত্রেই চাপ পড়েছে। মূলত এসব কারণে ইউরোপিয়ানদের অবাধ প্রবেশ ঠেকাতে যুক্তরাজ্যের মানুষ বিচ্ছেদের পক্ষে রায় দিয়েছে।

এখন ওই রায় কার্যকর করতে গিয়ে মহা বিপাকে পড়েছে যুক্তরাজ্য। দুটি কারণে এই বিপদ। প্রথমত, বিচ্ছেদের পর যুক্তরাজ্য ইইউর একক বাজারের সুবিধা হারাবে। এতে দেশের অর্থনীতি ধসে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। দ্বিতীয়ত, চাইলেও একক বাজার থেকে যুক্তরাজ্য নিজেদের বিচ্ছিন্ন করতে পারছে না, কারণ স্বাধীন আয়ারল্যান্ড এবং যুক্তরাজ্যের অংশ উত্তর আয়ারল্যান্ডের মধ্যকার উন্মুক্ত সীমান্ত বজায় রাখার চুক্তি (গুড ফ্রাইডে ডিল)।

ওই চুক্তি অনুযায়ী স্বাধীন আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে উন্মুক্ত সীমান্ত বজায় রাখতে গেলে প্রকৃতপক্ষে ইইউর সঙ্গেই সীমানা উন্মুক্ত থেকে যায়। ফলে ব্রেক্সিট-পরবর্তী সময়ে এই সীমানার ব্যবস্থাপনা কী হবে—সে বিষয়ে কোনো সর্বসম্মত সমাধানে পৌঁছাতে পারেনি যুক্তরাজ্য।

ইইউ নাগরিকদের অবাধ প্রবেশ ঠেকাতে এবং ইইউ আদালতের অধীনতা ত্যাগের বিনিময়ে যুক্তরাজ্য অর্থনৈতিক স্বার্থের কতটুকু ছাড় দিতে প্রস্তুত, তা নিয়েই আসল মতবিরোধ। এই মতবিরোধ কেবল বিরোধী দলের সঙ্গে নয়, বরং সরকারি দলের এমপি ও মন্ত্রিপরিষদের মধ্যেও আছে; বিশেষ করে মন্ত্রীদের মতভিন্নতার কারণে যুক্তরাজ্য সরকার ব্রেক্সিট-পরবর্তী বাণিজ্য সম্পর্ক নিয়ে চূড়ান্ত কোনো প্রস্তাবই তুলে ধরতে পারেনি। সর্বশেষ গত শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে মন্ত্রীদের নিয়ে বিশেষ বৈঠক করেন এবং একটি সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে ঘোষণা করেন।

এর এক দিন পর রোববার রাতে সরকারের ওই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে পদত্যাগ করেন ব্রেক্সিট-বিষয়ক মন্ত্রী ডেভিড ডেভিস। এর ২৪ ঘণ্টার মাথায় আকস্মিকভাবে পদত্যাগের ঘোষণা দেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন। এই দুই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীই ইইউ থেকে বেরিয়ে আসার পক্ষে প্রচার চালিয়েছিলেন। তাঁরা অভিযোগ করেছেন, প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে কেবল নামমাত্র ব্রেক্সিট বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এতে যুক্তরাজ্য ইইউর শাসনাধীন একটি উপনিবেশে পরিণত হবে।
জবাবে প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে বলেছেন, পদত্যাগী মন্ত্রীদের মন্তব্য সরকারি সিদ্ধান্তের সঠিক ব্যাখ্যা নয়। তিনি অধিকতর অনুগত ডোমিনিক রাবকে ব্রেক্সিট-বিষয়ক মন্ত্রী এবং জেরেমি হান্টকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়ে দ্রুত মন্ত্রিসভার শূন্যতা পূরণ করেন।

গত সোমবার রাতে ক্ষমতাসীন এমপিদের বৈঠক করে থেরেসা মে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, সরকারের সিদ্ধান্তকে ঐক্যবদ্ধভাবে সমর্থন না দেওয়ার পরিণতি কারও জন্যই ভালো হবে না। এই বিভক্তি যদি সরকারের পতন ঘটনায়, তবে বামপন্থী জেরেমি করবিনের হাতে ক্ষমতা চলে যাবে, যা কনজারভেটিভ পার্টির কারও জন্যই ভালো হবে না।
বিবিসির রাজনীতিবিষয়ক সম্পাদক লরা কুয়েন্সবার্গ তাঁর এক বিশ্লেষণে বলেছেন, কনজারভেটিভ পার্টির ব্রেক্সিটপন্থীরা থেরেসা মের নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করেন কি না, সেটিই এখন দেখার। ব্রেক্সিটপন্থী কয়েকজন এমপির মতামত তুলে ধরে তিনি বলছেন, নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করার সম্ভাবনা কম। তবে ব্রেক্সিট বাস্তবায়নের যে রূপরেখা প্রধানমন্ত্রী মে নিয়েছেন, সেটি পরিত্যাগে সরকারকে বাধ্য করার চেষ্টা করবেন তাঁরা। আবার থেরেসা মের ওই সিদ্ধান্ত ইইউ সমর্থন করে কি না, সেটিও বড় ব্যাপার।
বিরোধীদলীয় নেতা জেরেমি করবিন বলেছেন, সরকার এত দিন ঐক্যের লেবাস ধরে ছিল। এখন প্রমাণিত হয়ে গেছে যে থেরেসা মের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তবে তিনি থেরেসা মের পদত্যাগ দাবি করেননি।
২০১৯ সালের ২৯ মার্চ ব্রেক্সিট কার্যকর হওয়ার দিনক্ষণ ঠিক করা আছে। সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ এমপি চান একটি উদার সম্পর্ক বজায় রেখে (সফট ব্রেক্সিট) বিচ্ছেদ কার্যকর হোক। ফলে এ সময়ে থেরেসা মেকে সরালে ব্রেক্সিটের ভবিষ্যৎ আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে এবং তা দেশের জন্য ভালো হবে না—এমনটি সব মহলই বুঝতে পারছে।
অন্যদিকে ইইউ সহজে যুক্তরাজ্যকে ছাড় দিতে চায় না। কারণ যুক্তরাজ্য যদি সহজে ছাড় পায় এবং সুবিধা বজায় রেখে বিচ্ছেদ কার্যকর করে, তা অন্যান্য দেশ থেকেও বিচ্ছেদের দাবিকে উৎসাহিত করা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে ইইউ জোটের অস্তিত্বই ঝুঁকিতে পড়বে।
সবদিক বিবেচনায় উভয়সংকটে যুক্তরাজ্য। একদিকে অভ্যন্তরীণ কোন্দল, আর লাভ-লোকসানের সমাধানহীন হিসাব। অন্যদিকে ব্রেক্সিট বাস্তবায়ন না করার বিপদ। কেননা ব্রেক্সিটের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না করার বিষয়টি যুক্তরাজ্যকে অত্যন্ত অসম্মানজনক পরিস্থিতিতে ফেলে দেবে।