কিংবদন্তির কথা বলছি

বিশ্বের অনেক মানুষের মতোই নেলসন ম্যান্ডেলার কথা আমি জেনেছি দূর থেকে, তিনি যখন রোবেন দ্বীপে বন্দী ছিলেন। আমাদের অনেকের কাছে তিনি শুধু তখন একজন ব্যক্তি নন, তিনি এর চেয়েও বেশি কিছু—তিনি আমাদের কাছে পরিণত হয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকা তথা গোটা বিশ্বের সাম্য, ন্যায়বিচার এবং সব সংগ্রামের এক প্রতীকে। তাঁর আত্মত্যাগ এতটাই মহৎ, যা দুনিয়াজুড়ে সব মানুষের কাছে আহ্বান আর তাগিদ হয়ে কাজ করেছে মানবতার অগ্রগতির জন্য সম্ভব সবকিছু করার।
খুব বিনীতভাবে বলতে চাই, আমিও ওই আহ্বানে সাড়াদানকারীদেরই একজন। কলেজে পড়ার সময়ই মূলত প্রথম রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠেছিলাম, যোগ দিয়েছিলাম দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদ অবসানের আন্দোলনে। একজন তরুণ হিসেবে সে সময় আমি যেসব ব্যক্তিগত বাধার মুখোমুখি হয়েছি, তার কোনোটাই আফ্রিকায় প্রতিদিন বর্ণবাদী আচরণের শিকার হওয়া সেই সব মানুষের অভিজ্ঞতার তুলনায় কিছুই না। আমি ম্যান্ডেলার সেই সাহসিকতার কথা কল্পনা করতে পারি, যার কারণে তাঁকে বরণ করে নিতে হয়েছে দীর্ঘ কারাবাস। কিন্তু তাঁর ওই নজির আমাকে সজাগ করেছে বৃহত্তর এই জগৎকে এবং জীবনে যা কিছু ন্যায়সংগত, তার পক্ষে দাঁড়ানোর। তাঁর পছন্দের কথা থেকেই বলি, ম্যান্ডেলা খুব স্পষ্ট করেই বলেছেন, এই পৃথিবীকে যে রকম দেখছ, তোমাকে সেটাই মেনে নিতে হবে, এমন কোনো কথা নেই; আমাদের কাজ হবে, আমরা যে রকম পৃথিবী চাই, যে পৃথিবী আমাদের পছন্দ, তা খুঁজে নেওয়া।

বিগত বছরগুলোয় আমি গভীর এক শ্রদ্ধা ও বিনয় নিয়ে নেলসন ম্যান্ডেলাকে লক্ষ করে গেছি, অনুপ্রাণিত হয়েছি নতুন আশায়, ন্যায়বিচার ও সাম্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তাঁর জীবনে কত কষ্ট আর আত্মত্যাগ! সত্যিকার অর্থেই, তাঁর জীবন আমাদের সরাসরি দাঁড় করিয়ে দেয় এই জগৎকে, আমাদের জীবনকে প্রায় ক্লিষ্ট করা সব নৈরাশ্যবাদিতা ও আশাহীনতার বিরুদ্ধে।

কারাবন্দী একজন এখন এক মুক্ত মানুষ; এক স্বাধীন ব্যক্তি, যিনি একই সঙ্গে পরিণত হয়েছেন প্রবল আবেগময় এক ঐক্যে ও সম্মিলনের কণ্ঠস্বরে। একজন দলীয় নেতা থেকে তিনি হয়েছেন রাষ্ট্রপতি এবং গণতন্ত্র ও উন্নয়নকে নিয়ে গেছেন অনেক দূর। আনুষ্ঠানিক কার্যালয় ছেড়ে এসেও ম্যান্ডেলা নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন মানুষের সাম্য, সুযোগ ও মর্যাদা সমুন্নত রাখায়। তিনি নিজ দেশের পরিবর্তনের জন্য, এই বিশ্বের জন্য, এত কিছু করেছেন যে তাঁকে বাদ দিয়ে গত কয়েক যুগের পৃথিবীর ইতিহাস কল্পনা করাই কঠিন।

ক্যালিফোর্নিয়ায় কলেজছাত্র থাকা অবস্থায়ই আমি রাজনীতিতে প্রথম পা রেখেছিলাম, যুক্ত হয়েছিলাম রাজনীতি-আন্দোলনের সঙ্গে, আর এরও দুই দশক পর আমি এসে দাঁড়াই রোবেন দ্বীপে ম্যান্ডেলার একসময়কার এই কারাকক্ষে। আমি তখন সদ্য নির্বাচিত এক মার্কিন সিনেটর। কক্ষটিকে অনেক আগেই রূপান্তর করা হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে আত্মোৎসর্গকারী অসংখ্য মানুষের স্মৃতি জাদুঘরে। সেই কারাকক্ষে দাঁড়িয়ে নিজেকে আমি পেছনের সেই দিনগুলোতে ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম, এখানে প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলা ৪৬৬/৬৪ নম্বর কয়েদি—যখন তাঁর সংগ্রাম সফল হবে কি না, একেবারেই নিশ্চিত নয়। ম্যান্ডেলাকে আমি কল্পনা করার চেষ্টা করলাম: ইতিহাস বদলে দেওয়া এক কিংবদন্তির বীর তিনি—ম্যান্ডেলা নামের এক মানুষ, পরিবর্তনের জন্য যাঁর বিপুল আত্মত্যাগ।

মানুষ ম্যান্ডেলাকে বোঝার জন্য কনভারসেশন উইথ মাইসেলফ গ্রন্থটি একটি অসাধারণ কাজ। এই বই আমাদের জন্য তাঁর ব্যক্তিগত চিঠিপত্র, ভাষণ, সাক্ষাৎকার, বহু দশকের পুরোনো নানা দলিল-দস্তাবেজ সন্নিবেশ করে ম্যান্ডেলার যাপিত জীবনকে যাচাই করার সুযোগ করে দিয়েছে। দিনপঞ্জির আদলে কারাগারে অতিবাহিত তাঁর সেই নিরানন্দ মামুলি দিনের বিবরণ থেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এর সব উঠে এসেছে এ বইয়ে। এখানে তাঁকে পাই একজন পণ্ডিত ও রাজনীতিক হিসেবে, একজন সংসারী মানুষ ও বন্ধু হিসেবে; দেখি একজন দূরদর্শী ও বিচক্ষণ নেতা হিসেবে। ম্যান্ডেলা তাঁর আত্মজীবনীর নাম দিয়েছিলেন লং ওয়াক টু ফ্রিডম । আর এ গ্রন্থটি তাঁর সেই অভিযাত্রার ভিন্ন পদক্ষেপগুলোকে এবং ভিন্নতর পথপরিক্রমাকে নতুনভাবে আবিষ্কারে সুযোগ করে দিয়েছে।

আমাদের সামনে ফুটে ওঠা তাঁর এই পূর্ণাঙ্গ প্রতিকৃতি থেকে নেলসন ম্যান্ডেলাই আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, তিনি পরিপূর্ণ কোনো মানুষ নন। আমাদের সবার মতো তাঁরও ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে, খামতি আছে। কিন্তু তাঁর এসব ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকেই আমাদের প্রত্যেকের খুঁজে নেওয়া উচিত অনুপ্রেরণা। আমরা জানি, প্রতিনিয়তই আমাদের সবাইকে ছোটবড় নানা বাধার মুখে পড়তে হয়—এর কিছু ব্যক্তিগত কিছু রাজনৈতিক। এ ছাড়া জীবনের বিভিন্ন সময়ে মুখোমুখি হওয়া ভয়ভীতি-সন্দেহ কিংবা ফলাফল অনিশ্চিত জেনেও যে কাজ করে যাওয়া কিংবা অন্যদের ক্ষমা করার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা—এসব প্রতিকূলতাই জয় করা সম্ভব, যদি আমরা নিজেদের প্রতি সৎ থাকি। (সংক্ষেপিত)
অনুবাদ: শওকত হোসেন