দোলাচলে ব্রেক্সিট সমঝোতা

ব্রেক্সিট (ইইউ থেকে যুক্তরাজ্যের বিচ্ছেদ) কার্যকর করা নিয়ে চলমান আলোচনা এক নাটকীয় অবস্থায় উপনীত হয়েছে। হঠাৎ করেই সমঝোতার সফল সমাপ্তির প্রত্যাশার চেয়ে তা ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কার কথাই উচ্চারিত হচ্ছে বেশি। উভয় পক্ষ নিজ নিজ অবস্থানে শাণ দিয়ে কথার ধার দেখাচ্ছে। ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে যুক্তরাজ্যের বিচ্ছেদ কতটা নির্বিঘ্ন হবে, তা নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।

ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নির্ধারণে যুক্তরাজ্যের প্রকাশিত প্রস্তাব (শ্বেতপত্র) নিয়ে থেরেসা মের সরকারে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে গেল। এমন প্রস্তাব ইইউর কাছে মাথা নত করার শামিল আখ্যা দিয়ে প্রভাবশালী দুজন মন্ত্রী পদত্যাগ করলেন। অথচ ওই প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপনের আগেই তা গ্রহণ না করার ইঙ্গিত দিয়েছে ইইউ।

ইইউর পক্ষে সমঝোতাকারী মিশেল বার্নিয়ে গত শুক্রবার ব্রাসেলসে সদস্য দেশগুলোর ইইউ-বিষয়ক মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকে বলেন, একক বাজার-সুবিধা (সিঙ্গেল মার্কেট) ও শুল্ক জোট (কাস্টমস ইউনিয়ন) বিষয়ে ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সদস্য না হয়েও এসব ক্ষেত্রে সুবিধা ভোগ হবে ইইউর মূলনীতির পরিপন্থী।

বার্নিয়ের এমন মন্তব্যের বিষয়ে গত রোববার যুক্তরাজ্যের ব্রেক্সিট-বিষয়ক নবনিযুক্ত মন্ত্রী ডোমিনিক রাব বলেন, চুক্তি না হলে সম্ভাব্য পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রস্তুত হচ্ছে যুক্তরাজ্য। এ বিষয়ে নাগরিকদের করণীয় সম্পর্কে অবহিত করে দ্রুত চিঠি পাঠানো হবে বলেও জানান মন্ত্রী।

ডোমিনিক রাব বলেন, বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদিত না হলে ‘ডিভোর্স বিল’ হিসেবে পরিচিত ৩৯ বিলিয়ন পাউন্ড পরিশোধ করবে না যুক্তরাজ্য। তবে অক্টোবরের মধ্যেই একটি চুক্তি সম্পাদিত হবে বলে আশাবাদ তাঁর।

এর আগে গত শুক্রবার নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড সফরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে বলেন, প্রস্তাবে যেসব ছাড় দেওয়া হয়েছে, তার বাইরে নতুন কিছু আর ছাড় দেবে না যুক্তরাজ্য।

গতকাল সোমবার যুক্তরাজ্যের ডেইলি এক্সপ্রেস পত্রিকা বিশেষ সূত্রের বরাত দিয়ে জানায়, ইইউ নেতারা যুক্তরাজ্যের প্রস্তাব গ্রহণ না করার পক্ষে অটল রয়েছেন। চলমান সমঝোতা অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ২৯ মার্চ বিচ্ছেদ কার্যকর হওয়ার কথা। চুক্তি না হলে সমঝোতা চালিয়ে যাওয়ার জন্য নতুন করে ওই সময়সীমা বাড়াবে না ইইউ। যুক্তরাজ্যে যদি নতুন করে কোনো গণভোট হয় অথবা সরকার পরিবর্তনের মতো ঘটনা ঘটে, তবেই কেবল তারা বিচ্ছেদ বিলম্বিত করবে।

২০১৬ সালের গণভোটে যুক্তরাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটাররা ইইউ থেকে বিচ্ছেদের পক্ষে রায় দেয়। সেই রায় কার্যকর করা নিয়ে যুক্তরাজ্য সরকার ও সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা মতবিরোধ রয়েছে। ২০১৭ সালের মার্চে প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে বিচ্ছেদের আনুষ্ঠানিক আবেদন জানান। যেটাকে বলা হয় ইইউ সংবিধানের ‘আর্টিকেল ৫০’ সক্রিয় করা। এই আর্টিকেল সক্রিয় করার দুই বছরের মধ্যে বিচ্ছেদ সম্পন্ন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যুক্তরাজ্যের অনুরোধে ইইউর বাকি ২৭ সদস্য রাষ্ট্রের সমর্থনে এই বিচ্ছেদের সময়সীমা বিলম্বিত করা সম্ভব।

বিচ্ছেদসংক্রান্ত দেনা-পাওনার বিষয়ে সমঝোতা অনেকটা শেষের পথে। কিন্তু বিপত্তি দেখা দিয়েছে ভবিষ্যৎ বাণিজ্য সম্পর্ক কী হবে, তা নিয়ে। কেননা, ইইউ জোট ত্যাগ করলেও দেশের অর্থনীতির স্বার্থে এই জোটের মধ্যকার শুল্কমুক্ত বাণিজ্য-সুবিধা ধরে রাখতে মরিয়া যুক্তরাজ্য। এই সুবিধা ধরে রাখার বিনিময়ে যুক্তরাজ্য কতটুকু ছাড় দেবে, তা নিয়ে থেরেসা মে সরকারের মধ্যে তুমুল মতবিরোধ রয়েছে।

ইইউ জোটের মূলনীতি হলো সদস্য দেশগুলোয় জোটের নাগরিকদের অবাধ বিচরণ, পূর্ণাঙ্গ নাগরিক অধিকার নিশ্চিতকরণ, পণ্যসেবার শুল্কমুক্ত বাণিজ্য ও ইউরোপীয় আদালতের অধীনতা মেনে নেওয়া। এর একটি বাদ দিয়ে অন্যটি ধরে রাখার কোনো সুযোগ নেই। যুক্তরাজ্য ইইউ নাগরিকদের অবাধ বিচরণ চায় না। ইইউ আইনের অধীনতাও চায় না। কিন্তু পণ্য ও সেবার শুল্কমুক্ত বাণিজ্য-সুবিধা ধরে রাখতে চায়। এখানেই আসল বিপত্তি।

কারণ, এই সুবিধা বন্ধ হলে যুক্তরাজ্যে দ্রব্যমূল্য বেশ বাড়বে। বিনিয়োগ কমে যাবে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর অন্যত্র সরে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হবে। এতে দেশটির অর্থনীতির মারাত্মক ক্ষতি হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আবার ইইউ জোটভুক্ত স্বাধীন আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের অংশ নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের সীমান্ত ব্যবস্থাপনা নিয়েও তৈরি হবে বিরাট জটিলতা। আইরিশ স্বাধীনতাকামীদের সঙ্গে সম্পাদিত শান্তিচুক্তি অনুযায়ী এই সীমান্ত সব সময় উন্মুক্ত রাখবে বলে চুক্তিবদ্ধ যুক্তরাজ্য সরকার।