কফি আনান সুন্দর পৃথিবী গড়তে অক্লান্ত চেষ্টা করে গেছেন

কফি আনান। রয়টার্স ফাইল ছবি
কফি আনান। রয়টার্স ফাইল ছবি

মানবতার পক্ষে ছিলেন তিনি। ইরাক যুদ্ধ আর নাইন-ইলেভেনের উত্তাপে বিভক্ত বিশ্বে তাঁর নেতৃত্বেই জাতিসংঘ বৈশ্বিক রাজনীতিতে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। শেষ জীবনে তিনি রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করার পক্ষেও সোচ্চার ছিলেন।

এই বিশ্বনাগরিকের নাম কফি আনান, যিনি গতকাল শনিবার শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি আফ্রিকা, এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত নিরসনে কাজ করেছেন। আফ্রিকার সাব-সাহারা অঞ্চল থেকে জাতিসংঘের প্রথম মহাসচিব তিনি। তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন বিশ্বনেতারা।

জাতিসংঘের বর্তমান মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, আনান ছিলেন ‘উৎকৃষ্ট পথপ্রদর্শক’। এক বিবৃতিতে তিনি লিখেছেন, ‘বিভিন্ন দিক দিয়ে কফি আনান জাতিসংঘের সঙ্গে ছিলেন। নতুন শতাব্দীতে সংস্থাটিকে সুমহান মর্যাদা ও দৃঢ়তার সঙ্গে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তিনি পথ দেখিয়ে গেছেন।’

শোক জানিয়েছেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাষ্ট্রপতি তাঁর শোকবার্তায় বলেন, শান্তি, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় কফি আনানের অসামান্য অবদানের জন্য বিশ্ববাসী তাঁর কথা মনে রাখবে। আর প্রধানমন্ত্রী তাঁর শোকবার্তায় বলেন, মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রতি সমর্থনের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবেন কফি আনান। তিনি অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে রাখাইন রাজ্যের ওপর পরামর্শক কমিশনের দুরূহ কাজটি গ্রহণ করেছিলেন।

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার জেউদ রা’আদ আল হুসেইন এক টুইটে লিখেছেন, ‘কফি আনানের মৃত্যুতে আমি শোকাহত। মানবতা ও উদারতার জন্য কফি ছিলেন অনন্য। বর্তমান পৃথিবীতে অনেক নেতা থাকলেও এমন নেতার মৃত্যু বিশ্বের জন্য বেদনাদায়ক। তিনি ছিলেন হাজারো মানুষের বন্ধু, ছিলেন লাখো মানুষের নেতা।’

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, ‘দীর্ঘ সময় পর তিনি সব বাধা ভেঙে দিয়েছিলেন। কফি আনান সুন্দর পৃথিবী গড়তে আজীবন চেষ্টা করে গেছেন।’ 

ভ্লাদিমির পুতিন আনানের স্মরণে বলেছেন, ‘রাশিয়ার মানুষের হৃদয়ে তিনি চিরদিন থাকবেন।’

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, ‘বিশ্ব শুধু এক মহান আফ্রিকান কূটনীতিক ও মানবদরদিকেই হারায়নি, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার এক রক্ষককেও হারিয়েছে।’

ন্যাটোর প্রধান জেন্স স্টলটেনবার্গ ব্যক্তিগত টুইটে লিখেন, ‘কফি আনান মারা গেছেন, এটা শুনতে পাওয়া অত্যন্ত শোকের ব্যাপার। তাঁর সৌহার্দ্যকে কখনোই দুর্বলতা হিসেবে ভাবা উচিত হবে না। আনান দেখিয়ে গেছেন, একই সময়ে মহান মানবিক ও শক্তিশালী নেতা হওয়া যায়। জাতিসংঘ ও বিশ্ব তাদের এক অনন্য সম্পদকে হারাল।’

কফি আনানের সঙ্গে তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী ন্যানে। এএফপি ফাইল ছবি
কফি আনানের সঙ্গে তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী ন্যানে। এএফপি ফাইল ছবি

কফি আনানের মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ থেরেসা মে বলেন, ‘কফি আনানের মৃত্যুসংবাদ শুনে খুবই কষ্ট পাচ্ছি। তিনি জাতিসংঘের এক মহান নেতা ও সংস্কারক ছিলেন। তিনি যে পৃথিবীতে জন্মেছিলেন, সেই পৃথিবীকে আরও সুন্দর অবস্থায় রেখে যেতে আজীবন অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন। তাঁর পরিবারের প্রতি আমার সমবেদনা রইল।’

ঘানার প্রেসিডেন্ট নানা আকুফো-আডো দেশটিতে সাত দিনের জাতীয় শোক ঘোষণা করেছেন। আনানকে স্মরণ করে তিনি লিখেছেন, ‘তিনি ছিলেন আমাদের একজন মহান স্বদেশি।’

তবে আনান সমালোচনার হাত থেকে রেহাই পাননি। ১৯৯০-এর দশকে রুয়ান্ডার গণহত্যা ঠেকাতে জাতিসংঘের ব্যর্থতার জন্য তাঁকে দায়ী করা হয়। কারণ, তিনি ছিলেন জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের প্রধান।

২০০৩ সালের পর তিনি ইরাক যুদ্ধ নিয়ে আমেরিকা ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে তাঁর মতের অমিল দেখা দিয়েছিল। তাঁর মতে, ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন এ অভিযান ছিল অবৈধ। কিন্তু অতীতের এসব বিরোধিতা থাকা সত্ত্বেও সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ আনানের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে বলেছেন, ‘আনান জাতিসংঘের এক অক্লান্ত নেতা ছিলেন। পুরো বিশ্ব তাঁর অভিজ্ঞ মতামত থেকে বঞ্চিত হবে।’

সুইজারল্যান্ডের বার্নে একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ঘানার নাগরিক কফি আনান। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। জীবনের শেষ মুহূর্তে আনানের পাশে ছিলেন তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী ন্যানে ও তিন সন্তান আমা, কোজো ও নিনা।

ঘানার দক্ষিণাঞ্চলীয় কুমাসি এলাকায় জন্ম কফি আনানের। কুমাসিতেই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পড়ে বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যান আনান। মিনেসোটায় ম্যাকএলেস্টার কলেজে অর্থনীতিতে এবং ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে ব্যবস্থাপনায় ডিগ্রি নিয়েছেন তিনি। জেনেভায়ও পড়ালেখা করেছেন।

১৯৬৫ সালে নাইজেরিয়ার তিতি আলাকিজাকে বিয়ে করেন আনান। এই দম্পতির আমা নামের একটি মেয়ে ও কোজো নামে একটি ছেলেসন্তান রয়েছে। সত্তরের দশকে আনান ও আলাকিজার বিচ্ছেদ হয়ে যায়। এরপর ১৯৮৪ সালে জাতিসংঘে সুইডিশ আইনজীবী ন্যানে লেগারগ্রেনকে বিয়ে করেন আনান।

জাতিসংঘের সঙ্গে চার দশক কাজ করেছেন কফি আনান। বিশ্ব সংস্থাটির কর্মীদের মধ্যে তিনিই প্রথম মহাসচিব হয়েছিলেন। শুধু তা-ই নয়, জাতিসংঘের প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ মহাসচিবও তিনি। ১৯৯৭ সালে মহাসচিবের দায়িত্ব নেওয়ার পর কফি আনান জাতিসংঘের সংস্কার এবং মানবাধিকারকে অগ্রাধিকার দিতে উদ্যোগী হন। এর স্বীকৃতি হিসেবে ২০০১ সালে তাঁকে ও জাতিসংঘকে যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। ওই বছরই তিনি বাংলাদেশ সফর করেন। আত্মজীবনী ‘ইন্টারভেনশনস: আ লাইফ ইন ওয়ার অ্যান্ড পিস’-এ কফি আনান লিখেছেন, জাতিসংঘকে এমনভাবে তিনি গড়তে চেয়েছিলেন, যাতে বিশ্ব সংস্থাটি কেবল সদস্যরাষ্ট্রগুলোর নয়, জনগণের স্বার্থ দেখবে।

২০০৬ সাল পর্যন্ত দুই মেয়াদে জাতিসংঘের মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন কফি আনান। এরপর তিনি সুইজারল্যান্ডে বসবাস শুরু করেন।

কফি আনান মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার নিশ্চিতের পক্ষে ছিলেন। কফি আনান ফাউন্ডেশন ও মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলরের কার্যালয় ২০১৬ সালে কফি আনানের নেতৃত্বে রাখাইন রাজ্যবিষয়ক পরামর্শক কমিশন গঠন করে। এই কমিশন প্রায় এক বছর কাজ করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়, যাতে রাখাইন সংঘাত বন্ধে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার সুপারিশ করা হয়।