কেরালায় বন্যা-বিপর্যয়ের পেছনে

কেরালা রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনো পানিবন্দী হয়ে আছে মানুষ। তাঁদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাচ্ছেন উদ্ধারকারী দলের সদস্যরা। ভারত, ১৯ আগস্ট। ছবি: এএফপি
কেরালা রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনো পানিবন্দী হয়ে আছে মানুষ। তাঁদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাচ্ছেন উদ্ধারকারী দলের সদস্যরা। ভারত, ১৯ আগস্ট। ছবি: এএফপি

লোক হাসিয়েছেন ভারতের রিজার্ভ ব্যাংকের সদ্য নিযুক্ত পরিচালক স্বামীনাথন গুরুমূর্তি। মনে যে সংশয় খোঁচা মারছে, তা তিনি প্রকাশ করে দিয়েছেন। বলেছেন, শবরীমালা মন্দিরে নারী প্রবেশের অনুমতি দেওয়া নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের ভাবনাচিন্তায় দেবতা রুষ্ট হয়েছেন কি না তা ভেবে দেখা দরকার!

শবরীমালা মন্দিরে দশ থেকে পঞ্চাশ বছরের নারীদের ঢোকা নিষিদ্ধ। দীর্ঘদিনের এই প্রথা তুলে দেওয়ার দাবিতে সুপ্রিম কোর্টে মামলা চলছে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের (আরএসএস) আদর্শে লালিত গুরুমূর্তির মনে হয়েছে, এই বেয়াদপির সঙ্গে কেরালার বন্যা-বিপর্যয়ের যোগ থাকলেও থাকতে পারে। সুপ্রিম কোর্ট মহামান্য বিচারপতিরা বরং বিষয়টা বিবেচনা করে দেখুন।

লাইফ জ্যাকেট পরিয়ে শিশুটিকে উদ্ধার করে নিয়ে যাচ্ছেন ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মী। ত্রিশুর, কেরালা, ভারত, ১৯ আগস্ট। ছবি: এএফপি
লাইফ জ্যাকেট পরিয়ে শিশুটিকে উদ্ধার করে নিয়ে যাচ্ছেন ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মী। ত্রিশুর, কেরালা, ভারত, ১৯ আগস্ট। ছবি: এএফপি

গুরুমূর্তির মনে এমন ধরনের আজগুবি ভাবনার উদয়ের কারণ এটাই যে কেরালায় এমন বন্যা বিপর্যয় স্মরণাতীতকালে দেখা যায়নি। ভারতে বর্ষা প্রথমেই আছড়ে পড়ে কেরালায়। তারপর ধীরে ধীরে ছেয়ে যায় গোটা দেশে। কেরালায় ফি বর্ষায় ভারী থেকে প্রবল, এমনকি লাগাতার ঝমঝমে বৃষ্টি হয়। কখনো কখনো জনজীবনও স্তব্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এবারের মতো বন্যা, এত প্রাণ এবং সম্পত্তিহানি, এমন হাহাকার কখনো হয়নি। আগস্ট মাসে মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে অবিরাম বৃষ্টিই এর একমাত্র কারণ নয়। এই বিপর্যয়ের পেছনে রয়েছে পশ্চিমঘাট পর্বতমালার পাদদেশে নির্বিচার নগরায়ণ, বাঁধ ব্যবস্থাপনায় অবহেলা, রাজ্যের নদীগুলোর দুধার বেদখল হয়ে যাওয়া এবং পূর্বাভাস জানানোর অক্ষমতা।

তিন শর বেশি প্রাণহানি এবং লক্ষাধিক মানুষের ভিটেমাটি ছাড়া হওয়ার পেছনে প্রধান কারণ অবশ্যই অবিরাম বৃষ্টি। গোটা রাজ্যে এই বছর স্বাভাবিকের তুলনায় ১৬৪ মিলিমিটার (৪২ শতাংশ) বেশি বৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু ৯ থেকে ১৬ আগস্ট, শুধু এই সাত দিনে কোল্লাম জেলায় বৃষ্টি হয়েছে স্বাভাবিকের চেয়ে ৫২৭ মিলিমিটার বেশি, ইডুক্কি জেলায় ৪৩৮ মিলিমিটার ও মালাপ্পুরমে স্বাভাবিকের চেয়ে ৩৯৯ মিলিমিটার বেশি বৃষ্টিপাত।

ভয়াবহ বন্যায় বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। কেরালা, ভারত, ১৯ আগস্ট। ছবি: রয়টার্স
ভয়াবহ বন্যায় বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। কেরালা, ভারত, ১৯ আগস্ট। ছবি: রয়টার্স

বৃষ্টির এই বোঝার ওপর শাকের আঁটি হয়ে দাঁড়ায় রাজ্যের জলাধারগুলো। কেরালায় বড় বাঁধ মোট ছয়টা। এগুলোর মধ্যে ইদামালায়ার ও ইডুক্কি জলাধারের ধারণ ক্ষমতা এক বিলিয়ন কিউবিক মিটারেরও বেশি। এগুলো ছাড়া রাজ্যে রয়েছে বেশ কয়েকটা ছোট ছোট জলাধার। প্রতি বছর বর্ষায় এই জলাধারগুলো ভরা থাকে ধারণ ক্ষমতার প্রায় অর্ধেক। এই বছর জুলাই মাসের শেষে বড় ছোট সব জলাধারই টইটুম্বুর হয়ে যায়। আগস্ট মাসের যে সপ্তাহে রেকর্ড বৃষ্টি হলো, সেই সময় সব জলাধারই প্রায় এক শ শতাংশ বোঝাই। বাঁধ বাঁচাতে তাই বাধ্য হয়ে বাড়তি জল ছাড়া হয়। রাজ্য সরকারের স্বীকারোক্তি, ৯ থেকে ১৬ আগস্ট হঠাৎই যে আকাশভাঙা বর্ষণ হবে, সেই আগাম হদিস সরকারের কাছে ছিল না। ছিল না বলে বাঁধ তদারকির দায়িত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁরাও বাঁধ থেকে নিয়মিত জল ছাড়ার কথা ভাবেননি। সম্ভবত তাঁরা ভেবেছিলেন, বর্ষার পরেও জলাধারগুলো টলটলে রাখলে রাজ্যেরই লাভ।

জলাধারগুলো থেকে জল ছেড়ে বাঁধ বাঁচানো সম্ভব হলো ঠিকই কিন্তু তাতে প্লাবনের মাত্রা যায় বেড়ে। কোচি বিমানবন্দর যে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দিতে হয় তার কারণও এই। রাজ্যের নদীগুলোর জলধারণ ক্ষমতাও প্রাকৃতিক নিয়মে কমে গেছে। নদীগুলোর দুধারের প্লাবন ক্ষেত্র, সাধারণত যা চাষের জন্য ব্যবহৃত হয়, বহু স্থানে সেখানে মানুষ বসতি গেড়েছে। এই মানুষজনের অনেকে ভেসে গেছে। তৃতীয় কারণ, পশ্চিমঘাট পর্বতমালার পাদদেশে নিয়ম ভেঙে দেদার বসতি গড়ে তোলা।

মানুষের পাশাপাশি পানিবন্দী গবাদিপশু উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাচ্ছেন উদ্ধারকর্মীরা। কেরালা, ভারত ১৯ আগস্ট। ছবি: এএফপি
মানুষের পাশাপাশি পানিবন্দী গবাদিপশু উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাচ্ছেন উদ্ধারকর্মীরা। কেরালা, ভারত ১৯ আগস্ট। ছবি: এএফপি

বিষয়টা নিয়ে চিন্তিত কেন্দ্রীয় সরকার ২০১০ সালে বিশিষ্ট পরিবেশবিদ মাধব ধনঞ্জয় গ্যাডগিলের নেতৃত্বে এক কমিটি গঠন করে। পশ্চিমঘাট পর্বতমালার পরিবেশ ভারসাম্য কীভাবে রক্ষা করা যায়, সেটাই ছিল কমিটির প্রধান দেখার বিষয়। এক বছর পর কমিটি রিপোর্ট পেশ করে। তাতে বলা হয়, পশ্চিমঘাট পর্বতগাত্রে যেভাবে বসতি গড়া হচ্ছে, তা পুরোপুরি বন্ধই শুধু করতে হবে না, যেসব বসতি গড়া হয়েছে সেগুলি থেকেও মানুষজনকে অন্যত্র সরিয়ে দিতে হবে। নয়তো ভবিষ্যতে বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী। গ্যাডগিল কমিটির সুপারিশ কেন্দ্রীয় সরকার গ্রহণ করেনি। পশ্চিমঘাট পর্বতমালার পাদদেশের ছয় রাজ্য, কেরালা, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক, গোয়া, মহারাষ্ট্র ও গুজরাট—প্রায় সবার কাছ থেকেই বাধা আসে। প্রতিরোধের দরুন গ্যাডগিল কমিটির সুপারিশ গ্রহণ না করে কেন্দ্রীয় সরকার ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন বা ‘ইসরো’-র ডিরেক্টর কৃষ্ণস্বামী কস্তরীরঙ্গনের নেতৃত্বে অন্য একটি কমিটি গঠন করে। গ্যাডগিল কমিটি ৬৪ শতাংশ এলাকাকে পরিবেশের দিক থেকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করেছিল, কস্তুরীরঙ্গন কমিটি তা ৩৭ শতাংশে নামিয়ে আনে। কিন্তু তা সত্ত্বেও রাজ্যগুলো বিরোধিতা কমায়নি। পশ্চিমঘাটের ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল বসতিমুক্ত করতে রাজ্যগুলোর অনীহা এখনো প্রবল।

কেরালায় যত মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তাঁদের অধিকাংশ পাহাড়ে ভূমিধসে। বৃষ্টি অভাবিত বেশি হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমঘাট পাহাড়ে এমন ভূমিধস অতীতে কখনো হয়নি।

কেরালায় বন্যা পরিস্থিতির পূর্বাভাস দেওয়াও কঠিন বলে জানিয়েছেন ভারতের সেন্ট্রাল ওয়াটার কমিশন বা ‘সিডব্লিউসি’। কমিশনের কর্তাব্যক্তিদের মতে, দেশের অন্যত্র যেখানে দু দিন আগে বন্যার পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব, কেরালার ক্ষেত্রে সেটা তিন-চার ঘণ্টার বেশি সম্ভব হয় না। ভারী বর্ষার আগাম আভাস দেওয়া সম্ভব যাতে সমুদ্রে জেলেরা বিপদে না পড়ে। কিন্তু বন্যা পরিস্থিতি বেশি আগে বলা সম্ভব নয়। রাজ্যে ২২টা আবহাওয়া পূর্বাভাস কেন্দ্র থাকা সত্ত্বেও রাজ্য সরকার তাই অসহায়। বন্যা মোকাবিলাতেও ব্যর্থ।