সালমানকে ওই শিশুরা কি ক্ষমা করবে?

সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। ইয়েমেনে সৌদি জোটের অভিযানকে এই যুবরাজের আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতির বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখেন কেউ কেউ (রয়টার্সের ফাইল ছবি)
সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। ইয়েমেনে সৌদি জোটের অভিযানকে এই যুবরাজের আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতির বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখেন কেউ কেউ (রয়টার্সের ফাইল ছবি)

বোমারু বিমান থেকে ধেয়ে এল প্রাণঘাতী বোমা। আঘাত করল স্কুলবাসে। বিকট শব্দে প্রকম্পিত হলো পুরো এলাকা। এরপর আগুনের লেলিহান শিখা, ধোঁয়ার কুণ্ডলী, শিশুদের অসহায় আর্তনাদ। চোখের পলকেই মৃত্যুর কোলে ঠাঁই পেল ৪০টিরও বেশি শিশু। তারপর সারি সারি কবর।

ইয়েমেনের সাদা প্রদেশে স্কুলবাসে চালানো ভয়ংকর হামলার এমন বর্ণনাই পাওয়া যায় গণমাধ্যমে। সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোট গত ৯ আগস্ট ওই হামলা চালায়। আর এই জোটকে প্রকাশ্যেই মদদ দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র।

স্কুলবাসে ওই হামলার পর বিশ্বজুড়ে ব্যাপক সমালোচনা ও নিন্দার ঝড় ওঠে। তারপরও এত দিন চুপচাপ থাকা সৌদি জোট গত শনিবার ওই হামলার জন্য ভুল স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশ করেছে। কিন্তু কেন দুঃখপ্রকাশ? সিএনএন বলছে, এমনি-এমনি এই দুঃখপ্রকাশ করেনি সৌদি জোট। পেছন থেকে কলকাঠি নেড়েছে সেই যুক্তরাষ্ট্রই।

ইয়েমেনে শিয়া মতবাদে বিশ্বাসী হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সৌদি জোটের অভিযানকে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতির বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখেন কেউ কেউ। ২০১৫ সালে সৌদি আরবের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোনীত হন সালমান। ওই বছরের জুনে শুরু হয় সৌদি জোটের ইয়েমেন অভিযান। লক্ষ্য, দেশটিতে সৌদি মদদপুষ্টদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখা ও ‘চিরশত্রু’ ইরানের মদদপুষ্ট হুতিদের নিশ্চিহ্ন করা। গত বছরের জুনে সৌদি সিংহাসনের উত্তরাধিকারী নিযুক্ত হওয়ার পর যেন সেই অভিযানের গতি ও প্রাণহানি আরও বেড়েছে। ওই অভিযান এখনো চলছে। জাতিসংঘ বলছে, এই অভিযানে এখন পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। আহত হয়েছেন ৫৫ হাজার। হতাহতদের বেশির ভাগই বেসামরিক জনগণ। ইয়েমেনের চলমান পরিস্থিতিকে ভয়াবহ মানবিক সংকট বলেও উল্লেখ করেছে সংস্থাটি।

শিশুদের দাফনের জন্য খোড়া হয় সারি সারি কবর (রয়টার্সের ফাইল ছবি)
শিশুদের দাফনের জন্য খোড়া হয় সারি সারি কবর (রয়টার্সের ফাইল ছবি)

এমন পরিস্থিতিতে বাসে হামলায় ৪০ শিশুসহ মোট ৫৬ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে সৌদি জোট। সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোটে রয়েছে, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), বাহরাইন, কুয়েত, মিশর, জর্ডানসহ কয়েকটি দেশ। বিবিসি সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা এসপিএর বরাত দিয়ে বলছে, সৌদি জোট ওই হামলার জন্য ভুল স্বীকার করেছে। এক বিবৃতিতে সৌদি জোট বলছে, এ ঘটনায় জোটের জয়েন্ট ফোর্সেস কমান্ড দুঃখ প্রকাশ করে সমবেদনা জানিয়েছে। এই হামলার জন্য দায়ীদের জবাবদিহির আওতায় আনারও ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। সিএনএনের এক প্রতিবেদনে সৌদি জোটের দুঃখপ্রকাশের পেছনের কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও গত সোমবার সৌদি যুবরাজ সালমানের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। এ ছাড়া একজন তিন তারকার মার্কিন জেনারেল সৌদি সরকার ও জোটের নেতাদের সঙ্গে সরাসরি দেখা করে ইয়েমেন অভিযান নিয়ে আলোচনা করেন। এরপরই গত শনিবার সৌদি রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থায় বিবৃতি দিয়ে স্কুলবাসে হামলার জন্য দুঃখপ্রকাশ করা হলো।

তার মানে সৌদি জোট আসলে নিজ থেকে দুঃখপ্রকাশ করার প্রয়োজন বোধ করেনি। যুক্তরাষ্ট্রের চাপে বিবৃতি দিয়ে দুঃখপ্রকাশ করলেও অভিযান বন্ধ বা কমিয়ে আনার ব্যাপারে সুস্পষ্টভাবে কোনো কথা বলেনি। বরং অভিযান চালিয়ে যাওয়ার পক্ষেই তারা। আর যুক্তরাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে ‘সর্প হইয়া দংশন করো/ওঝা হইয়া ঝাড়োর’ নীতিতে রয়েছে। যে বোমা ওই শিশুদের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে, সেটা যুক্তরাষ্ট্রেরই বোমা। সিএনএন বলছে, ২২৭ কিলোগ্রাম ওজনের লেজার গাইডেড এমকে ৮২ মডেলের ওই বোমা যুক্তরাষ্ট্রই সৌদি আরবের কাছে বিক্রি করে। শুধু ৯ আগস্টই নয়, এর আগে ২০১৬ সালের অক্টোবরে একই ধরনের বোমা দিয়ে সৌদি জোটের হামলায় ১৫৫ জন নিহত হন। একটি দাফন অনুষ্ঠানে ওই হামলা চালানো হয়েছিল। তারও আগে ওই বছরের মার্চে সৌদি জোটের আরেক হামলায় ৯৭ ইয়েমেনি নিহত হন। ওই হামলায় সৌদি জোট ব্যবহার করেছিল এমকে ৮৪ মডেলের বোমা। অক্টোবরে সৌদি হামলায় ১৫৫ জন নিহত হওয়ার পর তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ‘মানবাধিকার নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে’ হামলার প্রযুক্তি সৌদি আরবের কাছে বিক্রি নিষিদ্ধ করেন। এরপর ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় এসে গত বছরের মার্চে ওই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়। এখন সেই যুক্তরাষ্ট্রই আবার দুঃখপ্রকাশ করতে মিত্র সৌদি জোটকে চাপ দিল।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও। সৌদি যুবরাজের সঙ্গে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কথা বলার কয়েক দিনের মধ্যে সৌদি জোটের দুঃখপ্রকাশের বিবৃতি আসে (এএফপির ফাইল ছবি)
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও। সৌদি যুবরাজের সঙ্গে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কথা বলার কয়েক দিনের মধ্যে সৌদি জোটের দুঃখপ্রকাশের বিবৃতি আসে (এএফপির ফাইল ছবি)

সৌদি জোট যেদিন দুঃখপ্রকাশ করল, তার পরদিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) স্কুল বাসে ওই হামলাকে ‘যুদ্ধাপরাধের শামিল’ বলে উল্লেখ করে।

কিন্তু এই নিন্দা, ক্ষোভ, সমালোচনা সত্ত্বেও সৌদি আরব কিংবা যুবরাজ সালমান কী করলেন! নৃশংস এই হামলার পর দুঃখপ্রকাশ করা নিয়েও ভাঁওতাবাজি করলেন! নিষ্পাপ শিশুদের হত্যার পর নিজ থেকে দুঃখপ্রকাশের মানবিকতাটুকুও দেখাতে পারলেন না! ওই শিশুরা কি তাঁকে ক্ষমা করবে?