যুক্তরাষ্ট্র চায় ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু সংস্থার বিনাশ

মাহমুদ আব্বাস। ছবি: রয়টার্স
মাহমুদ আব্বাস। ছবি: রয়টার্স

জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু সংস্থার (আনরোয়া) প্রতি সব সাহায্য বন্ধের যে সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্র নিয়েছে, তার একটাই লক্ষ্য, আর তা হলো এই সংস্থাকে পুরোপুরি অকেজো করে দেওয়া। এ কথা বলেছেন ফিলিস্তিন প্রশাসনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। তবে আনরোয়ার প্রধান পিয়ের ক্রায়েনবুল বলেছেন, এই সিদ্ধান্তের ফলে সংস্থাটি সংকটে পড়লেও ঘাটতি পূরণে সক্ষম হবে বলে তিনি মনে করেন।

গত সপ্তাহে এক সিদ্ধান্তে ট্রাম্প প্রশাসন আনরোয়ার জন্য বার্ষিক ৩৫০ মিলিয়ন ডলারের যে অনুদান দিয়ে থাকে, তা পুরোপুরি বন্ধের কথা ঘোষণা করে। ৭০ বছরে বেশি সময় ধরে এই সংস্থা ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের জন্য জরুরি ত্রাণ ছাড়াও খাদ্য, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে সাহায্য দিয়ে আসছে। বর্তমানে এই সংস্থার সঙ্গে রেজিস্ট্রিকৃত ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুর সংখ্যা ৫৩ লাখের মতো। অধিকৃত পশ্চিম তীর ও গাজা ছাড়াও জর্ডান, সিরিয়া ও লেবাননে এই ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র দাবি করেছে, আনরোয়ার কারণে উদ্বাস্তুদের ত্রাণ গ্রহণ একটি অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। দেশটি আরও দাবি করেছে, মোট উদ্বাস্তুর সংখ্যা আরও কম।

আনরোয়ার মোট বার্ষিক বাজেটের পরিমাণ ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। পিয়ের ক্রায়েনবুল ওয়াশিংটন পোস্টকে জানিয়েছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ (ইইউ) বিভিন্ন দেশ অতিরিক্ত সাহায্য দানের প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় তাদের পক্ষে মোট ঘাটতির অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। এরপরও ঘাটতি থাকবে প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলার। ‘পরিস্থিতি এখনো জটিল, তবে আমার বিশ্বাস সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে,’ তিনি বলেন।

উদ্বাস্তু সমস্যা টিকিয়ে রাখার জন্য আনরোয়াকে দায়ী করে যে বক্তব্য যুক্তরাষ্ট্র দিয়েছে, তা প্রত্যাখ্যান করে ক্রায়েনবুল বলেন, এই সমস্যা টিকে থাকার একমাত্র কারণ ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর ব্যর্থতা। অনুদান বন্ধে মার্কিন সিদ্ধান্ত একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, এর সঙ্গে আনরোয়ার ভূমিকার কোনো সম্পর্ক নেই বলে তিনি মন্তব্য করেন।

জাতিসংঘ ও বিভিন্ন দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করলেও ইসরায়েল তাকে স্বাগত জানিয়েছে। অধিকাংশ পর্যবেক্ষক একমত, ইসরায়েলকে খুশি করতেই ট্রাম্প প্রশাসন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সিদ্ধান্তের অন্য কারণ ইসরায়েলের পছন্দমতো একটি শান্তি চুক্তি গ্রহণে ফিলিস্তিনিদের বাধ্য করা। ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই ট্রাম্প ঘোষণা করেছিলেন, তিনি মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি শান্তি পরিকল্পনা পেশ করবেন। এই পরিকল্পনা প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় তাঁর জামাতা জ্যারেড কুশনারকে। প্রস্তাব চূড়ান্ত হওয়ার আগেই ট্রাম্প প্রশাসন জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস সেখানে সরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। উভয় সিদ্ধান্তই আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ইসরায়েলের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট, এই অভিযোগে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ হোয়াইট হাউসের সঙ্গে সব রকম সহযোগিতা বন্ধ করে দেয়। তা সত্ত্বেও একাধিক আরব রাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সমর্থনে একটি শান্তি পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে হোয়াইট হাউস থেকে জানানো হয়েছে। ইসরায়েলি পত্রিকা হা’রেৎস জানিয়েছে, এই প্রস্তাবে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনের বদলে পশ্চিম তীর ও জর্ডানকে নিয়ে একটি কনফেডারেশনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করেছে।

এই প্রস্তাব নিয়ে কুশনার তাঁর সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন, সে কথা উল্লেখ করে মাহমুদ আব্বাস সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, জর্ডানের সঙ্গে কনফেডারেশনে তিনি বিশ্বাসী কি না, কুশনার তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলেন। ‘আমি বলেছি, আমি শুধু জর্ডান নয়, ইসরায়েলের সঙ্গেও কনফেডারেশন চাই। আমি জানতে চাই, ইসরায়েল এমন কোনো কনফেডারেশন চায় কি না।’

পর্যবেক্ষকদের ধারণা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের ওপর এই শান্তি প্রস্তাব গ্রহণে চাপ সৃষ্টির জন্যই এখন আনরোয়াকে অকেজো করে দেওয়া হচ্ছে। অধিকাংশ ফিলিস্তিনি জীবনধারণের প্রয়োজন মেটাতে এই সংস্থার ওপর নির্ভরশীল। অধিকাংশ ফিলিস্তিনি শিশু আনরোয়া পরিচালিত স্কুলে অধ্যয়ন করে থাকে। পশ্চিম তীরের একজন ফিলিস্তিনি মা সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘এসব স্কুল বন্ধ হয়ে গেলে আমাদের ছেলেমেয়েরা কোথায় লেখাপড়া শিখবে, আমরা জানি না।’

যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত চাপ সত্ত্বেও ফিলিস্তিনিরা নতিস্বীকার করবে, এ কথা ভাবার কোনো কারণ নেই। প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন বা পিএলওর সাধারণ সম্পাদক সায়েব এরেকাত যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের সমালোচনায় বলেছেন, ‘এখন তো আমাদের হারানো আর কিছু নেই, তাদের সঙ্গে আমরা কোনো রকম আলাপ-আলোচনায় কেন যাব?’ তিনি জানিয়েছেন, মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়ায় মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালনের যোগ্যতা যুক্তরাষ্ট্র হারিয়েছে।

সে কথা সমর্থন করে একজন ইউরোপীয় কূটনীতিক বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছেন, প্রধান আর্থিক দাতা হিসাবে মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বড় প্রভাব ছিল। এখন অর্থ সাহায্য বন্ধ করে দেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র সেই প্রভাব হারাল।