ভারতে সমকামিতা আর অপরাধ নয়

ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। ছবি: এএফপি
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। ছবি: এএফপি

সমকামিতা আর অপরাধ নয়। ভারতের সর্বোচ্চ আদালত আজ বৃহস্পতিবার ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা অবৈধ বলে রায় ঘোষণা করলেন। এবং তা হলো সর্বসম্মতভাবে। বহু প্রাচীন ওই ধারায় সমকামিতা অপরাধ বলে গণ্য হতো। এই রায়ের পর দুই প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ বা নারীর মধ্যে সম্মতির ভিত্তিতে যৌন সম্পর্ক স্থাপন আর অপরাধ বলে গণ্য হবে না। কারও যৌন পছন্দ আর বিচার বিভাগের বিবেচনাযোগ্য হবে না।

সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রর নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির এজলাস আজ বেলা সাড়ে ১১টায় এই রায় ঘোষণা করেন। প্রথমে রায় পড়েন প্রধান বিচারপতি, যিনি বলেন, ‘বস্তাপচা ধ্যানধারণাকে বিদায় দিয়ে সব নাগরিককে সমান অধিকার দিতে হবে। সমকামিতাকে অপরাধ করে রাখা অযৌক্তিক ও অসমর্থনীয়।’ বিশিষ্ট সমকামী গীতিকার জেরি হারম্যানের লেখা বিখ্যাত গানে উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আই অ্যাম হোয়াট আই অ্যাম’ বা ‘আমি যা আমি ঠিক তা-ই’। একইভাবে নিজেদের রায় পৃথকভাবে পড়ে শোনান বিচারপতি রোহিনটন নরিম্যান, এ এম খানবিলকর, ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় ও ইন্দু মালহোত্র।

ঐতিহাসিক এই রায়ের পর দেশজুড়ে সমকামী সমাজ ও তাঁদের সমর্থনকারীরা উল্লাসে ফেটে পড়েন। বিভিন্ন স্থানে জড় হয়ে তাঁরা এই রায়কে স্বাগত জানান। শুরু হয় আবির খেলা। নাচ, গান ও আনন্দের এক নতুন উৎসব। ব্যক্তি পরিসরকে যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন, তাঁরাও এই রায়কে যুগান্তকারী বলে মনে করছেন।

ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা দেড় শ বছরেরও বেশি পুরোনো। ১৮৬১ সালে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সরকার এই ধারার প্রবর্তন করেছিল। সেই ধারাকে প্রথম চ্যালেঞ্জ জানায় এইডস ভেদভাও বিরোধী আন্দোলন (এবিভিএ) নামে এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। দিল্লির তিহার জেলে পুরুষ বন্দীদের মধ্যে ওই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কনডম বিলির অনুমতি চেয়েছিল। কিন্তু তিহার জেলের তৎকালীন সুপারিনটেনডেন্ট কিরণ বেদি সেই অনুমতি দিতে অস্বীকার করেন। সেটা ১৯৯৪ সাল। এবিভিএ ওই মামলা বেশি দিন চালাতে পারেনি। চার বছর পর ১৯৯৮ সালে চিত্র পরিচালক দীপা মেহতার সিনেমা ‘ফায়ার’ মুক্তি পায়। সেই সিনেমায় দুই প্রাপ্তবয়স্ক নারী নিজেদের স্বামীকে ছেড়ে পরস্পরের প্রেমে জড়িয়ে পড়েন। সিনেমাটি নিয়ে দেশে সমকামিতার পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্কের ঝড় বয়ে গিয়েছিল।

স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা নাজ ফাউন্ডেশন প্রথম এই আইনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে দিল্লি হাইকোর্টে মামলা করে। সেটা ২০০১ সাল। ২০০৪ সালে দিল্লি হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ মামলাটি খারিজ করে দেন। রিভিউ আবেদন গ্রহণেও অগ্রাহ্য করেন। পরবর্তীকালে দেশজোড়া সমকামী আন্দোলনের জেরে হাইকোর্টকে সুপ্রিম কোর্ট সেই পুরোনো মামলা শোনার নির্দেশ দেন। ২০০৯ সালে দিল্লি হাইকোর্ট জানান, সম্মতির ভিত্তিতে দুই প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে যৌন সম্পর্ক অপরাধ নয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে একাধিক ব্যক্তি ও সংগঠন সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানান। ২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্টের রায় খারিজ করে জানান, ৩৭৭ ধারার সাংবিধানিক বৈধতা রয়েছে। ওই ধারা বাতিল করে সমকামিতাকে বৈধতা দিতে গেলে সংসদে আইন পাস করাতে হবে। ২০১৪ সালে নাজ ফাউন্ডেশন, কেন্দ্রীয় সরকার এবং অন্যদের রিভিউ আবেদন বাতিল হয়। দুই বছর পর আবেদনটি বিবেচনার জন্য পাঠানো হয় পাঁচ বিচারপতির এজলাসে।

এই সময়ের মধ্যে ঘটে যায় দুই যুগান্তকারী রায়। ২০১৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গের মান্যতা দেন। তাঁদের বিরুদ্ধে বৈষম্য সৃষ্টির বিরুদ্ধে রায় দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট জানান, এসব মানুষ সব ধরনের অধিকার পাওয়ার যোগ্য। ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্টের নয় বিচারপতির বেঞ্চ রায় দিয়ে বলেন, ব্যক্তিপরিসর রক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। ব্যক্তিপরিসর রক্ষার অধিকার মৌলিক, এই রায় প্রত্যক্ষভাবে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারার পরিপন্থী। কেন্দ্রীয় সরকারও ৩৭৭ ধারা নিয়ে সিদ্ধান্তের ভার সুপ্রিম কোর্টের বিবেচনার ওপরেই ছেড়ে দেয়। অবশেষে সুপ্রিম কোর্ট সর্বসম্মতভাবে জানিয়ে দিলেন, সমকামিতা আর অপরাধযোগ্য নয়।

এক বছর আগে রিলিজ করেছিল অমিতাভ বচ্চন অভিনীত সিনেমা ‘পিঙ্ক’। সেই সিনেমায় নারী নির্যাতনের মামলায় নির্যাতিত নারীর পক্ষে আদালতে দাঁড়িয়ে আইনজীবী দীপক সায়গলের সওয়াল ছিল, ‘নো মিনস নো’। অর্থাৎ, যৌন সম্পর্ক স্থাপনে অস্বীকার করে কোনো নারী ‘না’ বললে সেই ‘না’কে সম্মান জানাতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির বলা ‘আই অ্যাম হোয়াট আই অ্যাম’ বাক্যটিও সেই দ্যোতনা বহন করে যুগান্তকারী হয়ে থাকল। বৃহস্পতিবার থেকে ভারতীয় সমাজে শুরু হলো এক নতুন অধ্যায়।