অন্তর্জালের খবরদারির জন্য চীন সব ব্যবস্থাই নিচ্ছে

ইন্টারনেট সিকিউরিটি কনফারেন্স ২০১৮-এ জনৈক কর্মী একটি সাইবার সিকিউরিটি কোম্পানির মাসকট নিয়ে খেলছেন। বেইজিং, ৪ সেপ্টেম্বর। ছবি: রয়টার্স
ইন্টারনেট সিকিউরিটি কনফারেন্স ২০১৮-এ জনৈক কর্মী একটি সাইবার সিকিউরিটি কোম্পানির মাসকট নিয়ে খেলছেন। বেইজিং, ৪ সেপ্টেম্বর। ছবি: রয়টার্স

পেন্টাগনের ঘুপচি এক অফিসে বসে প্যাকেট ট্রান্সফার প্রযুক্তির গবেষণা চলছিল। সময়টা ১৯৬০-এর দশক। চারপাশে তখন বব ডিলানের শিকল ভাঙার গান: ‘দেয়ার মাস্ট বি সাম কাইন্ডা ওয়ে আউট্টা হিয়ার...’। সেই বিদ্রোহী গানের সুরেই কাব্যলক্ষ্মী খুঁজে নিয়ে পেন্টাগনের গবেষকেরা ১৯৭০-এর দশকে আবিষ্কার করেন আরপানেট। আরপানেট থেকেই ধীরে ধীরে ইন্টারনেটে রূপ পায় এই চিন্তা।

শুরুর দিকে কেবলই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কাজে ব্যবহারের জন্য ছিল ইন্টারনেট। ড্রোন চালনা থেকে শুরু করে স্যাটেলাইট যোগাযোগ, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর বর্তমান আগ্রাসী রূপের পেছনে ইন্টারনেটের ভূমিকা ব্যাপক। তবে আমেরিকানরা ডাকসাইটে বেনিয়া। তাই ইন্টারনেটের বেসামরিক ব্যবহারের ক্ষেত্রও খুঁজে বের করেছিলেন তাঁরাই। ইন্টারনেটকে সেবায় রূপান্তর করে ওটাকে যেদিন বাজারে ছাড়া গেছে যুক্তরাষ্ট্র তো বটেই, পুরো দুনিয়ার চেহারা বদলে গেছে।

ডট কমের যুগে, আমেরিকার বাঘা বাঘা বিনিয়োগকারী কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা লগ্নি করেছেন, তুলে নিয়েছেন নগদ নারায়ণ। অর্থনীতি আর প্রযুক্তিতে কাঁচা টাকার ঝনঝনে বিশ্ববিদ্যালয়েরও নজর পড়েছে প্রযুক্তি শিক্ষার দিকে। উচ্চশিক্ষা ধীরে ধীরে হয়েছে অর্থ উপার্জনের রাস্তা। নতুন ব্যবসা, সেটি সামলানোর জন্য একগাদা নতুন ধরনের কর্মচারী, বাণিজ্য, যুদ্ধের ময়দান, নতুন প্রযুক্তির উদ্ভব—সবই মুক্তবাজারে রাজত্ব করার জন্য দরকার। যুক্তরাষ্ট্র তা-ই করেছে।

তবে ঘটনার মোড় ঘুরতে শুরু করেছে। চীনা রাষ্ট্রনায়ক, সি চিং পিং ২০১২ সাল থেকে ক্ষমতায় আসার পরেই অন্তর্জালকের অন্দরমহল দখলে মন দিয়েছিলেন। পুরো অর্থনীতি আর বিশ্বব্যবস্থাকে এক বিশাল বাজার বানিয়ে ফেলার সমস্যা হলো, যাদের ভোক্তা বেশি, অর্থবছর শেষে পণ্যের দাঁড়িপাল্লা তাদের দিকেই হেলে পড়ে।

চীনের বিশাল জনসংখ্যা, কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা, প্রযুক্তির উৎকর্ষ আর উদ্ভাবনী ক্ষমতা—এ সবকিছুর জোরেই ইন্টারনেটের জগতের সিংহাসন দখল করতে চান প্রেসিডেন্ট সি। ফরেন অ্যাফেয়ার্সের ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর সংখ্যা বলছে, ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের জায়গা দখল করে ফেলেছে চীন। তবে ফরেন অ্যাফেয়ার্স নিশ্চিত নয়, চীনের এই জয়যাত্রা টিকবে কি না।

সি চিং পিংয়ের ভাবনা অন্তর্জালের মসনদ দখল করে রাখার। সেটি করার রোয়াব আছে চিনের। সি চিং পিং স্রেফ ইন্টারনেটের ব্যবহারে রাজা হয়েই ক্ষান্তি দিতে রাজি নন। তিনি চান দুর্ভেদ্য দুর্গ। সে জন্য দেশের জনসংখ্যা, পররাষ্ট্রনীতি, প্রযুক্তির উন্নয়ন—সবকিছু কাজে লাগানোর জন্য প্রস্তুত তিনি।

এই বিশাল কর্মযজ্ঞ হাতে নেওয়ার আগে হালের দুনিয়ার হিসাব বুঝে নিয়েছেন সি। সারা দুনিয়ায় যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ইন্টারনেট ব্যবহার করে আন্দোলন ঘনীভূত হচ্ছে, জনমত তৈরি হচ্ছে, নিজের সভাকক্ষে বসে সে খবর মনোযোগ দিয়ে দেখেছেন সি চিং পিং।

ইন্টারনেটের বিশাল শক্তি। মানুষকে খুব সহজেই একত্র করে ফেলতে পারে—মতামত, চিন্তা, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সহজেই গণপরিসরে পৌঁছে দেওয়া যায়। স্বৈরাচারের গদি জ্বালিয়ে দিতে সামাজিক মাধ্যমে মুহাম্মদ বুয়াজিজির অগ্নিযাত্রার ছবিই যথেষ্ট।

ইন্টারনেটের শক্তি অনেক, বহুমুখী। একই সঙ্গে বাজারের সবচেয়ে তুখোড় পণ্য, বাণিজ্য বিস্ফোরণের নিয়ামক আবার আন্দোলনের বীজ। বহুমতের প্রকাশ ও বিকাশ যেমন করা যায়, তেমনি বাক্‌স্বাধীনতার গলা টিপে মহারাজের বিদূষকও বানানো যায় একে। স্রেফ বিদূষক হলে ভালো হতো, ইন্টারনেটের লাগাম ঠিকমতো হাঁকালে, পুরো রাজ্যের জনগণকে একে অপরের শাসক, শোষক বানিয়ে দেওয়া যায়। তাতে শাসকের মসনদ ও ঠিক থাকে, উন্নয়নের সুবাতাসের গানও গাওয়া যায়। পাশাপাশি তৈরি হয় স্বপ্নের ডিজিটাল দুর্গ।

ফরেন অ্যাফেয়ার্সের মতে, এই প্রযুক্তি চিন্তা, চৈনিক চার রাষ্ট্রীয় পলিসির একেবারে কেন্দ্রে। চীনা শাসকেরা চান না, ইন্টারনেটে জমে থাকা ক্ষোভের প্রকাশ ঘটুক। কিংবা নতুন কোনো মত-পথ-চিন্তার উদ্রেক হোক। তাদের অন্তর্জালে থাকবে স্রেফ শান্তি, উন্নয়ন আর সহমত। এমন কিছু সেখানে থাকবে না, যা শাসকের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, প্রশ্ন করার সাহস দেখায়।

দুই নম্বর নীতিটিও বেশ চেনা চেনা। বাইরের জগতের ওপর নির্ভরশীল চীন আগেও থাকতে চায়নি। নিজের দেশের দুয়ার বন্ধ করে দেওয়া চীনের একেবারে ঐতিহাসিক সংস্কৃতি। প্রযুক্তির দিকেও সেদিকে হাঁটতে চায় তারা। বিদেশি যন্ত্রপাতি কিনে তাদের সাইবার দুর্গ সাজাতে চায় না।

এ ব্যাপারে চীনের তৃতীয় নীতিটি আবার সবার সঙ্গে মেলে। বিশ্বের তাবৎ দেশের প্রশাসন তাদের রাজনীতির ওপরে সাইবার হামলা নিয়ে শঙ্কিত। এই শঙ্কা আরও গাঢ় হয়েছে ২০১৬ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ান হ্যাকার হামলা কেলেঙ্কারিতে।

এ ধরনের হামলায় শুধু নির্বাচনের গণেশ ওলটানো ছাড়াও দেশে বাজারব্যবস্থা আর অর্থনীতির লাল বাতি জ্বালিয়ে দেওয়া যায়। আমেরিকার দেখাদেখি অস্ত্রের ইঁদুরদৌড়ে শামিল হয়ে পুরো বিশ্বে এখন অন্তর্জালকেন্দ্রিক সমরাস্ত্রের রমরমা দিন। সাইবার হামলায় সেই অস্ত্রাগারেও সাড়ে সর্বনাশ হতে পারে।

একদম শেষের নীতিটি চীনা সরকারের পক্ষ থেকে একেবারে কট্টর দক্ষিণপন্থী ভাবনা। সাইবার সার্বভৌমত্ব নামে তাদের একটি গঠনতন্ত্র আছে বলে প্রকাশ করেছে ফরেন অ্যাফেয়ার্স। এই গঠনতন্ত্র, আমেরিকার ইন্টারনেট চিন্তার একদম উল্টো।

সির মতে, ‘নিজের পছন্দমতো সাইবার প্রগতি নির্ধারণ করা সব রাষ্ট্রের অধিকার।’ এমন এক ইন্টারনেটের স্বপ্ন দেখছেন সি চিং পিং, যেখানে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ইন্টারনেটের গলায় বেড়ি পরাতে পারে প্রশাসন।

আটলান্টিকের পশ্চিমের অধিবাসীদের উন্মুক্ত ইন্টারনেট একেবারেই নিষ্পাপ, সেটি বলা যাবে না। তবে বাণিজ্যের জন্য হলেও কিংবা ব্যক্তিস্বাধীনতার সংস্কৃতির প্রতিফলন হিসেবেও তাদের স্বপ্নের ইন্টারনেট আসলেও বাঁধহীন। এখানে সরকারের সমালোচনা করা যায়, প্রেসিডেন্টে ট্রাম্পের ছোট পাঞ্জা নিয়ে চটুল রসিকতা করা যায়।

চীনের স্বপ্নে ওসব চলবে না। চীনের প্রিমিয়ার একেবারে ছিনেজোঁকের মতোই চেপে বসেছে ইন্টারনেটের ওপর। চীনের রাষ্ট্রীয় সেন্সর বোর্ড সোশ্যাল মিডিয়ার বাৎচিতও হাপিশ করে দিতে পারে। চীন সরকারের অসহমত লু শিয়াবাও, ২০১৭ সালে ক্রমাগত অসুস্থ হতে থাকেন। তখন তাঁর ছবিকে ঘিরে অসন্তোষ এবং প্রতিবাদ দানা বাঁধতে থাকে সাইবারসমাজে। সেসব ছবি নিরুদ্দেশ করে দিতে বেশি সময় নেয়নি চীনের রাষ্ট্রীয় ইন্টারনেট সেন্সর বোর্ড।

এ ছাড়া নিজ জনগণের ওপর নজরদারি করতে উন্নত প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়েছেন সি চিং পিংয়ের সরকার। ক্যামেরা, সেন্সর, ফেশিয়াল ও ভয়েস রেকগনিশন, কী নেই সেখানে। একেবারে জাফর ইকবালের সায়েন্স ফিকশনের গল্প মনে পড়িয়ে দেয়। যদিও এই ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত উইঘুর প্রদেশের মুসলিমদের নজরদারিতেই আটকে আছে, তবে সেটা উইঘুরের সীমানা ছাড়াতে বেশি সময় লাগবে না। ব্যবস্থাটিকে সমগ্র চীনে প্রয়োগের জন্য ঘাম ঝরাচ্ছেন চীনা ইঞ্জিনিয়াররা।

নতুন আইন প্রয়োগ হয়েছে, বিভিন্ন চীনে সাইবার কোম্পানি: বাইদু, উইবো, এদের জরিমানা গুনতে হয়েছে আইন ভাঙার দায়ে। এমন কিছু সাইটে রাখা যাবে না, যাতে চীনা রাষ্ট্রের ‘ঐক্যে’ চোট আসে। চীনে ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ভিপিএন) বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। এই ভিপিএন ব্যবহার করেই চীনা স্টার্টআপ, একাডেমিয়া সরকারের জোয়াল থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজত। এমনকি অ্যাপলের চীনা অ্যাপ স্টোর থেকেও গায়েব হয়ে গেছে ভিপিএন।

শেষে বিদেশি কোম্পানিগুলোও নতিস্বীকার করছে। বাণিজ্য বলে কথা। চীন দেশের মতো বিশাল বাজারের লোভ সামলানোর জন্য অধুনা ভোগকেন্দ্রিক, বাজারতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রস্তত নয়।

ধীরে ধীরে সাইবার সব প্রযুক্তির গায়ে মেইড ইন চায়না লেখা দেখতে চান সি চিং পিং ও তাঁর সরকার। দিনে দিনে বাজারকেন্দ্রিক হয়ে পড়া এই অর্থনীতিতে পণ্যের মালিকানা ও ভোগই ধীরে ধীরে ক্ষমতার উৎস হিসেবে প্রমাণিত হচ্ছে। চীন যদি প্রযুক্তির ঘোড়ার গলায় শিকল পরাতে পারে, বাজারের রাজা হতে বেশি দিন লাগবে না। আর বাজারের রাজা হলে নিজের রাজনৈতিক মতাদর্শও সহজে চাপিয়ে দেওয়া যায় সারা বিশ্বে।