গভর্নর পদ থেকে আনোয়ার চৌধুরীকে স্থায়ীভাবে প্রত্যাহার নিয়ে নানা গুঞ্জন

আনোয়ার চৌধুরী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ কূটনীতিক। ছবি: সংগৃহীত
আনোয়ার চৌধুরী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ কূটনীতিক। ছবি: সংগৃহীত

নিয়োগের কয়েক মাসের মধ্যে আনোয়ার চৌধুরীকে কেইম্যান আইল্যান্ডের গভর্নর পদ থেকে স্থায়ীভাবে প্রত্যাহার করা নিয়ে শুরু হয়েছে নানা গুঞ্জন। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই ব্রিটিশ কূটনীতিককে লন্ডনে পদায়ন করা হবে বলে জানানো হয়েছে। তাঁকে প্রত্যাহার করার তথ্য জানিয়ে সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তর এর বেশি কোনো তথ্য দেবে না বলে জানিয়েছে।

এদিকে, অন্য একটি পক্ষ আনোয়ার চৌধুরীর বিরুদ্ধে এই ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার কারণ জানতে চাইছে। তাদের মতে, আনোয়ার চৌধুরী গুরুতর অপরাধ করলে তাঁকে লন্ডনে পদায়ন করা হতো না। তাঁকে গভর্নর পদে পুনরায় নিয়োগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে তারা।

গত বৃহস্পতিবার দ্বীপরাষ্ট্র কেইম্যান আইল্যান্ডের গভর্নর অফিস বিবৃতিতে জানায়, কেইম্যান আইল্যান্ডের গভর্নর পদ থেকে আনোয়ার চৌধুরীকে স্থায়ীভাবে প্রত্যাহার করা হয়েছে। যুক্তরাজ্যের ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ দপ্তরের বরাতে দেওয়া ওই বিবৃতিতে আনোয়ার চৌধুরীকে অপসারণের কোনো কারণ ব্যাখ্যা করা হয়নি। তবে তাঁকে লন্ডনে নতুন করে পদায়ন করা হবে বলে জানানো হয়। অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ওই বিবৃতিতে আরও বলা হয়, বিষয়টি নিয়ে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তর আর বেশি কোনো তথ্য দেবে না।

আনোয়ার চৌধুরী ব্রিটিশ কূটনীতিক হিসেবে নাম লেখানো প্রথম কোনো বাংলাদেশি। তিনি বাংলাদেশে ব্রিটিশ হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

যুক্তরাজ্যের নিয়ন্ত্রণাধীন দ্বীপরাষ্ট্র কেইম্যান আইল্যান্ডে আনোয়ার চৌধুরীকে গত মার্চ মাসে গভর্নর হিসেবে পাঠানো হয়। মাত্র তিন মাসের মাথায় ১৩ জুন তাঁকে গভর্নর পদ থেকে সাময়িক প্রত্যাহারের ঘোষণা আসে। যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে বলা হয়, তাঁর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি অভিযোগ উঠেছে। এসব অভিযোগ তদন্তে চার থেকে ছয় সপ্তাহ সময় লাগবে। কিন্তু অভিযোগগুলো কী এবং কারা এসব অভিযোগ করেছেন, তা নিয়ে কিছুই প্রকাশ করা হয়নি। সেই তদন্তের দীর্ঘ ১৪ সপ্তাহ পার হওয়ার পর আনোয়ার চৌধুরীকে গভর্নর পদ থেকে স্থায়ীভাবে অপসারণ করে লন্ডনে পদায়নের ঘোষণা এল। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো কী এবং তদন্তেই–বা কী পাওয়া গেল, সেসব নিয়ে কোনো ব্যাখ্যা নেই।

কেইম্যান আইল্যান্ডের স্থানীয় টিভি চ্যানেল ‘কেইম্যান কম্পাস’ বলছে, যুক্তরাজ্য সরকারের এমন সিদ্ধান্তে কেইম্যানবাসী ক্ষুব্ধ। তাঁরা আনোয়ার চৌধুরীকে অপসারণের কারণ জানতে চান। দেশটির বিরোধীদলীয় নেতা এজার্ড মিলার এক বিবৃতিতে বলেন, অন্য গভর্নররা যেখানে পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করে কেইম্যানবাসীর মন জয় করতে পারেননি, সেখানে আনোয়ার চৌধুরী মাত্র তিন মাসে সবার মন জয় করে নিয়েছিলেন। অপসারণের কোনো ব্যাখ্যা না দেওয়াকে তিনি ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরের ‘কর্তৃত্বপরায়ণ’ আচরণ বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘পররাষ্ট্র দপ্তর সম্ভবত ভুলে গেছে, ২০ শতকের শুরুর দিকে যখন আমাদের ঔপনিবেশিক প্রভুদের আদেশ বিনা প্রশ্নে মেনে নেওয়া হতো, তা থেকে থেকে আমরা অনেক এগিয়ে গেছি।’

আনোয়ার চৌধুরী কেইম্যানবাসীর উদ্বেগ নিরসনে যেসব কাজ শুরু করেছিলেন এবং দুর্নীতি বন্ধে যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সেসব সম্পন্ন করতে গভর্নর হিসেবে তাঁর মেয়াদপূর্তির সুযোগ দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি। এজার্ড মিলার আরও বলেন, আনোয়ার চৌধুরী যদি গুরুতর কোনো অপরাধ করতেন, তাহলে তাঁকে লন্ডনে সরকারি কাজে পুনরায় পদায়ন করা হতো না।

কেইম্যান কম্পাস তাদের প্রতিবেদনে বলছে, তারা আনোয়ার চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং তদন্তের ফলাফল বিষয়ে বারবার ব্রিটিশ সরকারের কাছে জানতে চেয়েছে। কিন্তু ব্রিটিশ ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিস এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে।

আনোয়ার চৌধুরী ১৯৮৫ সালে রয়্যাল নেভির ‘ইঞ্জিনিয়ারিং স্ট্র্যাটেজিস্ট’ হিসেবে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। ২০০৪ সালে তিনি বাংলাদেশে ব্রিটিশ হাইকমিশনার হিসেবে নিয়োগ পান। যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ পাওয়া প্রথম দুই অশ্বেতাঙ্গর একজন আনোয়ার চৌধুরী। বাংলাদেশে দায়িত্ব পালনের সময়ে তিনি সিলেটে হজরত শাহজালাল (রা.) মাজার প্রাঙ্গণে গ্রেনেড হামলার শিকার হন। ওই ঘটনায় তিনজন নিহত হয়েছিলেন। আর আহত হন আনোয়ার চৌধুরীসহ ৪০ জন। ওই গ্রেনেড হামলার অভিযোগে হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি হান্নানসহ তিন জঙ্গিকে গত বছর ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

আনোয়ার চৌধুরী ২০০৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ছিলেন। এরপর ২০১১ সাল পর্যন্ত তিনি ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিসের অধীন ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট বিভাগের পরিচালক ছিলেন। ২০১৩ সালে তাঁকে লাতিন আমেরিকার দেশ পেরুতে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত করা হয়। ওই দায়িত্বের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই তাঁকে কেইম্যান আইল্যান্ডের গভর্নর করার খবর আসে।

যুক্তরাজ্যের অধীন ১৪টি বৈদেশিক ভূখণ্ড রয়েছে। তার মধ্যে ক্যারাবিয়ান সাগরের পশ্চিমাংশে অবস্থিত কেইম্যান আইল্যান্ড অন্যতম। তিনটি আলাদা দ্বীপ নিয়ে এই কেইম্যান আইল্যান্ড গঠিত, যার মোট আয়তন ২৬৪ বর্গ কিলোমিটার। লোকসংখ্যা ৬০ হাজারের মতো। প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভা গঠন করে প্রশাসন পরিচালনা করেন। আর গভর্নর সর্বোচ্চ ব্যক্তি হিসেবে ব্রিটিশ সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে বোঝাপড়া এবং নজরদারির কাজটি করেন।

কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য বিশ্বের অসৎ কোম্পানি ও ধনকুবেররা যে কয়েকটি দ্বীপরাষ্ট্রে কোম্পানি নিবন্ধন করেন, তার মধ্যে কেইম্যান আইল্যান্ড অন্যতম। সম্প্রতি ব্রিটিশ সরকার কর ফাঁকি ঠেকাতে এর নিয়ন্ত্রণাধীন বৈদেশিক ভূখণ্ডগুলোয় নিবন্ধিত কোম্পানির মালিকানা প্রকাশ বাধ্যতামূলক করে আইন পাস করে। এ কারণে কেইম্যান আইল্যান্ডের কোম্পানিগুলো অধিকতর গোপনীয় স্থানে সরে যেতে পারে এবং এতে কেইম্যান আইল্যান্ডের অর্থনীতি ঝুঁকিতে পড়বে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়।

অনেকের মতে, গভর্নরের মতো শীর্ষ পদে আসীন হলেও আনোয়ার চৌধুরী নিজের বন্ধুসুলভ আচরণ দিয়ে গত তিন মাসেই বেশ সাড়া ফেলেন। স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোকে তিনি বেশ কয়েকটি সাক্ষাৎকার দেন। তিনি কেইম্যানবাসীর জন্য আমলাতান্ত্রিক বাড়াবাড়ি কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেন।

আনোয়ার চৌধুরীর অবর্তমানে ডেপুটি গভর্নর কেইম্যান আইল্যান্ডে ভারপ্রাপ্ত গভর্নরের দায়িত্ব পালন করছেন।