চীন-কাতার সম্পর্ক সৌদির মাথাব্যথা

মাত্র কয়েক বছর আগে দোহায় উদ্বোধন হয়েছে চীনা প্রতিষ্ঠান দোহা মার্টের। এর মাধ্যমে সূচনা হয়েছে চীন–কাতার বাণিজ্য সম্পর্কের
মাত্র কয়েক বছর আগে দোহায় উদ্বোধন হয়েছে চীনা প্রতিষ্ঠান দোহা মার্টের। এর মাধ্যমে সূচনা হয়েছে চীন–কাতার বাণিজ্য সম্পর্কের

কাতারে আমার প্রবাস জীবনের এক দশক পূর্ণ হয়েছে। দোহা শহরে আসার পর পর রাস্তা-ঘাট, শপিং মল, কোথাও প্রবাসী চীনা নাগরিক তেমন একটা চোখে পড়েনি, যা আমাকে রীতিমতো বিস্মিত করেছিল। পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রতি পাঁচজনের একজন হচ্ছে চীনা। বিশ্বের এমন কোনো বড় দেশ নেই, যেখানে খুঁজে পাওয়া যাবে না ‘চায়না টাউন’। আমেরিকার নিউইয়র্ক, অস্ট্রেলিয়ার সিডনিসহ বিশ্বের অনেক বড় বড় শহরের কোনো কোনো এলাকায় গেলে মনে হবে যেন চীনের কোনো শহরে আছি।
দোহা শহরের বারওয়া বাণিজ্যিক এলাকায় ‘ড্রাগন মার্ট’ চালু হয়েছে মাত্র কয়েক বছর হলো। ১৯৮৮ সালে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর থেকে কাতারের সঙ্গে চীনের বাণিজ্য ঢিমেতালেই চলছিল। কিন্তু গত বছরের জুন মাসে কাতারের ওপর নজিরবিহীন অবরোধ আরোপের পর থেকে ড্রাগনের দেশ চীন কাতারের অর্থনীতির ত্রাণকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। কাতারের ওপর অবরোধের কালোছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। নিষ্পত্তির কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। প্রয়োজনে ৫০ বছর ধরে অবরোধ চলবে বলে এমন বাগাড়ম্বরপূর্ণ কথা শোনা যাচ্ছে সৌদি আরবের কর্মকর্তাদের মুখে। প্রতিবেশী দেশগুলোর অন্যায় অবরোধের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য কাতারকে অপরিমেয় শক্তি জোগাচ্ছে এশিয়ার সুপার পাওয়ার চীন।

এদিকে অবরোধের পর পর অর্থনীতি, আমদানি-রপ্তানি, সামরিক ও নিরাপত্তা খাতে কাতারের আমিরের নেওয়া কিছু দূরদর্শী ও কুশলী পদক্ষেপের সুফল এখন পাওয়া যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক আর্থিক তহবিলের তথ্যানুযায়ী কাতারের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার গত বছরের ২ দশমিক ১ শতাংশ থেকে এ বছর ২ দশমিক ৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যিক উদ্বৃত্তও বেড়েছে ৫০ শতাংশ। সব মিলিয়ে সৌদি জোটের অবরোধের নেতিবাচক প্রভাবও ক্ষীয়মাণ হয়ে আসছে।
কাতারের সঙ্গে চীনের আমদানি-রপ্তানি ও সামরিক সহযোগিতা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। কাতারের সবচেয়ে বড় আমদানিকারক দেশ হিসাবে আমেরিকার স্থান দখল করে নিয়েছে চীন। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, কাতারে আমদানির প্রায় ১৫ শতাংশ এখন চীন থেকে আসে। অন্যদিকে চীনও বসে নেই। তাদের জ্বালানি চাহিদা মেটানোর জন্য কাতার থেকে চীনের গ্যাস আমদানির পরিমাণ আগের চেয়ে ৭৫ ভাগ বেড়েছে। বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করতে গত তিন বছর ধরে দোহা শহরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ‘মেড ইন চায়না’ বাণিজ্য মেলা।
এ ছাড়া দুই দেশের মধ্যে নাগরিকদের যাতায়াতের জন্য আগে থেকে ভিসা জোগাড় করার বিধি-নিষেধও তুলে দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি চীনের কাছ থেকে কাতারের স্বল্প-পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র কেনার খবরও শোনা যাচ্ছে। যদিও সরকারিভাবে এখনো কোনো ঘোষণা আসেনি। তবে, চীনের সঙ্গে কাতারের ঘনিষ্ঠ সামরিক সহযোগিতা সৌদি জোটের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চীনারা খুবই পরিশ্রমী জাতি। আবেগ-তাড়িত হয়ে তারা কোনো ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত নেয় না। কাতারের সঙ্গে চীনের সহযোগিতা এভাবে চললে, কিছুদিনের মধ্যে কাতারের ব্যবসা-বাণিজ্যের একটি বিশাল অংশ যদি চীনাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়, তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
চলতি মাসেই প্রথম আলো মধ্যপ্রাচ্য সংস্করণ চতুর্থ বর্ষে পা দিচ্ছে। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ কমিউনিটিতে প্রথম আলোর পাঠকপ্রিয়তা বেড়েছে বহুগুণ। পত্রিকায় স্থানীয় কমিউনিটির সংবাদ ছাড়াও বেশ কিছু বিভাগ পাঠকদের মধ্যে সাড়া জাগিয়েছে। যেমন চাকরির খোঁজ, আরবি ভাষা শিক্ষা, জেনে রাখুন, বাংলাদেশে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের আঁকা ছবি, আইনি পরামর্শের বিভাগ ইত্যাদি। চাকরির খোঁজ এবং আইন বিভাগের পরামর্শ অনেকের কাজে লাগছে বলে জানিয়েছেন বেশ কিছু পাঠক। এটি প্রথম আলোর বড় ধরনের সাফল্য বলতে হবে।
তবে ছোটদের পাতা করা যায় কিনা এবং এতে বাংলাদেশ স্কুল ও কাতারের অন্যান্য স্কুলে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি ছাত্র-ছাত্রীদের লেখা ও আঁকা-জোকা শামিল করতে পারলে খুব ভালো হয়। এতে কিছু বাড়তি গ্রাহকও পাওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া দেশের মতো নিয়মিত সাহিত্য সভা, শিশুতোষ অনুষ্ঠান, রক্তদান কর্মসূচির মতো জনকল্যাণমূলক আয়োজনের উদ্যোগ নিতে পারে প্রথম আলো।
গ্রাহকদের বাড়িতে নিয়মিত পত্রিকা সরবরাহ আগের চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর হয়েছে। পত্রিকা পাচ্ছি না বলে আগের মতো অভিযোগ তেমন একটা শোনা যায় না। পত্রিকা বিলি করার ব্যাপারে প্রথম আলোর এজেন্ট আগের চেয়ে এখন বেশি মনোযোগী বলেই মনে হচ্ছে। এটা পত্রিকার কাটতি বাড়াতে সাহায্য করবে।
কাতারের বাংলাদেশ কমিউনিটিতে প্রথম আলো পত্রিকার গ্রাহকের সংখ্যা আগের চেয়ে যে বেড়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এটা কাতারের বুকে প্রথম আলোকে টিকিয়ে রাখার জন্য যথেষ্ট কিনা জানি না। প্রথম আলো বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় পত্রিকা। অনলাইন জনপ্রিয়তায় সবার শীর্ষে রয়েছে প্রথম আলো। গুগল ইঞ্জিনে অনুসন্ধান করলেই এর সত্যতা যাচাই করা যাবে। তবে বাংলাদেশের জনপ্রিয়তা দিয়ে কাতারে একটি পত্রিকার সাফল্য আশা করা যায় না। প্রবাসে বাংলা পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশের জন্য সাংবাদিকদের বেতন, পত্রিকা ছাপানোর খরচ, গ্রাহকদের কাছে পত্রিকা বিলি ইত্যাদি বিভিন্ন আনুষঙ্গিক খাতে প্রতি মাসে প্রচুর খরচ হয়। এখানে যেহেতু সরকারি বিজ্ঞাপন পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই, তাই গ্রাহক ফি এবং বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন থেকেই পুরো খরচ তুলে আনতে হয়, যা কাতারের মতো প্রবাসে সত্যিই দুরূহ ব্যাপার।
কাতারে প্রবাসী বাংলাদেশিদের যেসব ব্যবসা রয়েছে তার মধ্যে কেবল হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া কারও বিজ্ঞাপন পত্রিকায় চোখে পড়ে না। নিয়মিত বড় অঙ্কের বিজ্ঞাপন না পেলে পত্রিকা প্রকাশনার খরচ মেটানো সম্ভব নয়। বিদেশের মাটিতে একটি বাংলা পত্রিকার প্রকাশনা চালু রাখতে আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। কাতারের চার লাখ বাংলাদেশ কমিউনিটির মাত্র এক শতাংশ আগ্রহ দেখালেই গ্রাহকের সংখ্যা চার হাজারে গিয়ে দাঁড়ায়। আসুন না, বিজ্ঞাপন দিতে না পারি তাতে কি? সবাই অন্তত পত্রিকার গ্রাহক হওয়ার চেষ্টা করি।

লেখক: প্রকৌশলী ও গবেষক