কমিউনিটি নেতাদের সক্রিয় ভূমিকা চাই

কৃষিকাজে ব্যস্ত বাংলাদেশি কর্মীদের সঙ্গে কথা বলছেন শ্রম কাউন্সেলর সিরাজুল ইসলাম
কৃষিকাজে ব্যস্ত বাংলাদেশি কর্মীদের সঙ্গে কথা বলছেন শ্রম কাউন্সেলর সিরাজুল ইসলাম

২০১৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর আমি কাতারে আসি। দিনটি আমার জন্য আজও স্মরণীয় হয়ে আছে। লেখাপড়ার সুবাদে আমি এর আগে দেশের বাইরে থাকলেও কাজের সুবাদে এটিই ছিল প্রথম বিদেশে নিয়োগ।
আমি কাতারে আসার পর আমার লক্ষ্য ছিল, কাতারে বাংলাদেশের শ্রমবাজার কীভাবে আরও সম্প্রসারিত করা যায় এবং এ দেশে কর্মরত শ্রমিকদের সার্বিক সমস্যা সমাধানে তাঁদের পাশে দাঁড়ানো যায়। আমি নিজের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলাম, যাতে সব শ্রেণিপেশার শ্রমিকদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে পারি। আমার কোনো কর্মকাণ্ডে কখনো তারা যেন নিরাশ না হন।
দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে শ্রমিকদের সর্বোত্তম সেবা দেওয়ার অভিপ্রায়ে আমার দরজা যেন সব সময় খোলা থাকে, ইচ্ছা হলেই যেকোনো শ্রমিক আমার সঙ্গে সরাসরি দেখা করা ও কথা বলার সুযোগ পান।
কাতারে আসার আগে আমি দেশে শ্রম প্রতিমন্ত্রীর একান্ত সচিব (উপসচিব) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। শ্রম মন্ত্রণালয়ে প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর ধরে কাজ করেছি। ফলে বাংলাদেশের শ্রম সম্পর্কিত আইন–কানুন ও শ্রমিকদের সমস্যা কীভাবে সমাধান করা হয়ে থাকে, সে সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা ছিল।
এখানে আসার পর আমি প্রথমে কাতারের শ্রম আইন সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি। পাশাপাশি কাতারের শ্রম মন্ত্রণালয় এবং সরকারি–বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে উদ্যোগ নিই। এ দেশে থাকা অন্যান্য দেশের দূতাবাসের শ্রম শাখার সঙ্গে যোগাযোগ এবং তাদের অভিজ্ঞতা থেকেও শেখার চেষ্টা করেছি।
কাতারে শ্রমিকদের অবস্থা সরেজমিনে পরিদর্শন করতে আমি শ্রমিকদের ক্যাম্পে যাতায়াত শুরু করি। এই পরিদর্শন ও শ্রমিকদের সঙ্গে মাঠপর্যায়ে সরাসরি কথা বলার সুবাদে আমি দেখতে পাই, অন্যান্য দেশের শ্রমিকদের চেয়ে বাংলাদেশের শ্রমিকেরা তুলনামূলক কম বেতন পাচ্ছেন। এই স্বল্প বেতনের পেছনে অন্যতম কারণ ছিল বাংলাদেশি শ্রমিকদের কাছে কোনো চুক্তিপত্র না থাকা। ফলে মজুরি কম হওয়ায় বাড়তি আয়ের আশায় শ্রমিকদের কেউ কেউ এখানে এসে অবৈধ কাজে জড়িয়ে পড়ছেন, এমন বাস্তবতাও আমার সামনে স্পষ্ট হতে থাকে।
একপর্যায়ে আমি অনুভব করলাম, এই সমস্যা সমাধান করতে হলে বাংলাদেশি কর্মীদের আগমন ও কর্মসংস্থানের পুরো প্রক্রিয়ায় সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা দরকার। এ লক্ষ্যে আমি দেশে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে এসব বিষয় তুলে ধরতে শুরু করি। এরই ধারাবাহিকতায় সরকার কাতারে আসার আগে শ্রমিকদের চুক্তিপত্র ও ভিসা দূতাবাস থেকে সত্যায়ন করার বাধ্যবাধকতা চালু করে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, কাতারে কাজের ক্ষেত্রে চুক্তিপত্র হচ্ছে বিদেশি শ্রমিকদের রক্ষাকবচ। শ্রমিকদের কাছে তাদের চুক্তিপত্রের কোনো কপি না থাকলে তাঁরা বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন। তাই কোনো অবস্থায়ই চুক্তিপত্র ও তাতে উল্লিখিত বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে না জেনে কাতারে আসা
উচিত নয়।
কাতার সরকার সাম্প্রতিক সময়ে শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণে আইনি সংস্কার ও নানারকম পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বিদেশি শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ, অনলাইনে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বেতন পরিশোধ বাধ্যতামূলক করা, বহির্গমন অনুমতি বাতিলসহ বেশ কিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ এখন বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
সর্বশেষ কাতার কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশসহ সাতটি দেশে ভিসা কেন্দ্র চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শিগগিরই বাংলাদেশে এই কার্যক্রম শুরু করা হবে। ফলে বাংলাদেশ থেকে কাতারে কর্মী আসার প্রক্রিয়া আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে স্বচ্ছ, নিরাপদ ও ঝামেলামুক্ত হবে।
কাতার ভিসা কেন্দ্র চালু হওয়ার ফলে বাংলাদেশি শ্রমিকেরা উল্লেখযোগ্য তিনটি সুফল পাবেন। এর মধ্যে রয়েছে প্রত্যেক কর্মী নিজের চুক্তিপত্র এবং তাঁর বেতন-ভাতা ও সব ধরনের সুবিধা সম্পর্কে জেনে আসার সুযোগ পাবেন। কাতারে আসার পর কোনো কর্মীর স্বাস্থ্য পরীক্ষায় উপযুক্ত বিবেচিত না হওয়ার আশঙ্কা থাকবে না। পাশাপাশি কাতারে আসার পর কাতারি পরিচয়পত্র পেতে তঁার দেরি হবে না এবং কাতারে আসার আগে ভিসা বাতিলের প্রতারণায় কেউ ভুক্তভোগী হবে না।
আজ আমরা বলতে পারি, কাতারে বাংলাদেশি কর্মীর সংখ্যা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি হলেও শ্রমিকদের শ্রম সম্পর্কিত সমস্যা অনেকাংশে কমেছে। এর মূলে রয়েছে দুদেশের পক্ষ থেকে শ্রমিকদের স্বার্থে গৃহীত এমন কিছু পদক্ষেপ, যা অন্যান্য দেশে এখনো বাস্তবায়িত হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে আরও যে বিষয়টি লক্ষণীয়, কাতারে কর্মরত নারী গৃহকর্মীরা মধ্যপ্রাচ্যের যেকোনো দেশের চেয়ে নিরাপদ ও ভালো আছেন।
তবে আমি মনে করি, বাংলাদেশ ও কাতার সরকারের এসব পদক্ষেপের পরও শ্রমিকদের কল্যাণে আরও কিছু কাজ বাকি রয়ে গেছে। যেমন, কাতারে কর্মরত সাধারণ শ্রমিকদের জন্য একটি কল্যাণ তহবিল গঠন করা, শ্রমিকদের মধ্যে আইনি সচেতনতা তৈরিতে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ ইত্যাদি।
আমি বলতে চাই, শ্রমিকদের কল্যাণে কমিউনিটি নেতারা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। দূতাবাসের জনবলের পক্ষে রুটিনমাফিক কাজের বাইরে আলাদা কর্মসূচি পালন সম্ভব হয়ে ওঠে না, আবার এসব কর্মসূচি আয়োজনে আর্থিক বাজেটেরও একটি ব্যাপার থাকে। পাশাপাশি দূতাবাসের কিছু আইনি সীমাবদ্ধতাও আছে। সব মিলিয়ে বলা যেতে পারে, শ্রমিকদের কল্যাণে দূতাবাসের চেয়েও বড় পরিসরে কাজ করতে পারেন কমিউনিটি নেতারা।
কাতারে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকদের অনেকের মধ্যে আইনি সচেতনতা নেই। কর্মক্ষেত্রে কী কী মেনে চলতে হবে, কোন কাজটি কাতারে অপরাধ হিসেবে গণ্য এবং কোন অপরাধে কী শাস্তি হতে পারে—এসব ব্যাপারে অনেকেরই স্পষ্ট ধারণা নেই। শ্রমিকদের মধ্যে এই আইনি সচেতনতা বাড়াতে কমিউনিটি নেতারা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারেন।
প্রায় প্রতি মাসে কাতারে মৃত্যুবরণকারী বাংলাদেশি কর্মীদের মধ্যে দুয়েকজন এমন থাকেন, যাদের বৈধ পরিচয়পত্রের মেয়াদ ছিল না। ফলে এমন মৃত্যু হওয়া কর্মীদের নিয়োগদাতা বা কোম্পানিও অনেক সময় আমরা খুঁজে পাই না। ফলে তাদের মরদেহ দেশে পাঠানোর বেলায় আর্থিক সহযোগিতার প্রয়োজন হয়ে থাকে। একটি কমিউনিটি কল্যাণ তহবিল হলে এ ধরনের সমস্যা খুব সহজে সমাধান করা সম্ভব।
আমি আশা করব, কাতারে বাংলাদেশি কমিউনিটির নেতারা নিজেদের রাজনৈতিক কার্যক্রমের বাইরে বেরিয়ে এসে সামাজিক দায়িত্ববোধের অংশ হিসেবে শ্রমিকদের কল্যাণ ও তাদের মধ্যে আইনি সচেতনতা বাড়াতে উদ্যোগী হবেন।
আমি এমন একটি ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশি কমিউনিটির স্বপ্ন দেখি, যেখানে কোনো রাজনৈতিক বিভেদ থাকবে না, কিন্তু সবাই একসঙ্গে মিলেমিশে স্বদেশি শ্রমিকদের পাশে থাকবেন। কমিউনিটিতে প্রতিনিয়ত প্রশিক্ষণ ও সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মসূচি বাস্তবায়িত হবে। তবেই আমরা পরিণত হব একটি আদর্শ কমিউনিটিতে, যা দেখে অন্য দেশের অভিবাসীরা থেকে শিক্ষা নেবে।

লেখক: শ্রম কাউন্সেলর, বাংলাদেশ দূতাবাস, দোহা, কাতার