স্কাইপে খাসোগি হত্যার নির্দেশ!

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম স্কাইপে সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে হত্যার নির্দেশনা দিয়েছিলেন সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের জ্যেষ্ঠ ঘনিষ্ঠ সহযোগী সৌদ আল-কাহতানি। বার্তা সংস্থা রয়টার্স এমনটাই জানিয়েছে।

সৌদ আল কাহতানির নানান অপকর্মের বর্ণনা তুলে ধরেছে রয়টার্স। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সৌদ আল-কাহতানি সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের হয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম চালান। দেশজুড়ে অভিজাত শ্রেণির মানুষকে গ্রেপ্তারের মূল হোতাও তিনি। লেবাননের প্রধানমন্ত্রী (পরে পদত্যাগ করেন) সাদ আল-হারিরিকে তিনি আটক করেছিলেন। দুটি গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রমতে, তিনি জামাল খাসোগিকে নৃশংসভাবে হত্যার অভিযান পরিচালনা করেছেন। স্কাইপের মাধ্যমে তিনি হত্যার নির্দেশনা দিয়েছেন।

জামাল খাসোগিকে ইস্তাম্বুল দূতাবাসে হত্যা করা হয়েছে বলে জানায় সৌদি আরব। এটা নিয়ে বিশ্বে নানান সমালোচনার মুখে পড়েন সৌদি রাজপরিবার। ক্ষোভ বাড়তে থাকে বিশ্বে। ঠিক সেই সময়ে প্রকাশ হলো সৌদ আল কাহতানির নাম। তিনি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের শীর্ষ সহযোগী। শনিবার সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় মাধ্যমে বলা হয়েছে, কাহতানি ও অন্য চারজন কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করেছেন বাদশাহ সালমান।

সৌদি রাজপরিবারের ভেতরের খবর রাখেন এমন একটি সূত্র বলেছে, এ ঘটনায় মোহাম্মদ বিন সালমানের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে। আর এটা পুনরুদ্ধারে অনেক সময় লাগবে। যুবরাজ সালমানকে রক্ষা করছেন বাদশাহ। কিন্তু কাহতানি একবার বলেছিলেন, তিনি কখনো তার বসের (যুবরাজ সালমান) অনুমোদন ছাড়া কিছু করেন না। কিছুদিন আগে এক টুইটে তিনি লিখেছিলেন, ‘আপনি কি মনে করেন আমি নির্দেশনা ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত নেই? আমি একজন চাকরিজীবী। আমার বাদশা ও যুবরাজের নির্দেশনা শুধু বিশ্বস্ততার সঙ্গে বাস্তবায়ন করি।’

রয়টার্সের পক্ষ থেকে কাহতানির সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি কোনো উত্তর দিতে রাজি হন নি। কয়েক দিনের মধ্য টুইটারে তার বায়োগ্রাফি পরিবর্তন হয়ে গেছে। তিনি এত দিন সৌদি ফেডারেশন ফর সাইবার সিকিউরিটি, প্রোগ্রামিং অ্যান্ড ড্রোনসের চেয়ারম্যানের রয়েল অ্যাডভাইজার ছিলেন।

সৌদি আরবের একজন কর্মকর্তা শনিবার বলেছেন, খাসোগি হত্যার পুরো অপারেশন নিয়ে কিছু জানতেন না যুবরাজ। তিনি অবশ্য কাউকে অপহরণ অথবা হত্যার নির্দেশ দেননি। গত তিন সপ্তাহ ধরে এ সংকট জটিল থেকে জটিলতর হতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে খাসোগির পরিণতি নিয়ে ঘন ঘন অবস্থান পরিবর্তন করে সৌদি আরব। প্রথমে তারা তার হত্যার ঘটনা অস্বীকার করে। তারপর বলে, কনস্যুলেটের ভেতরে হাতাহাতির একপর্যায়ে তিনি মারা গেছেন।

খাসোগির পোশাক পরে অন্য কর্মকর্তা বের হন
এর আগে জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ‘নতুন তথ্য’ দিয়ছিলেন সৌদি আরবের এক শীর্ষ কর্মকর্তা। ১৫ জন সৌদি কর্মকর্তার ইস্তাম্বুল যাওয়া, খাসোগিকে কনস্যুলেটের ভেতরে ভয়ভীতি দেখানো এবং প্রতিরোধের মুখে টুকরো টুকরো করার বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে রয়টার্সকে তথ্য দিয়েছেন ওই কর্মকর্তা।

সৌদি ওই কর্মকর্তা বলেন, কনস্যুলেটের ভেতরে জামাল খাসোগিকে হত্যা করা হয় এবং হত্যার পর খাসোগির পোশাক পরে এক কর্মকর্তা কনস্যুলেট থেকে বের হয়ে যান। জামাল খাসোগি কনস্যুলেট থেকে বেরিয়ে গেছেন এটা প্রমাণ করতেই এমন কৌশলের আশ্রয় নেওয়া হয়।

সৌদি কর্মকর্তা বলেন, সৌদি আরবের গোয়েন্দা সংস্থার উপপ্রধান মেজর জেনারেল আহমেদ আল-আসিরি ১৫ জনের দল গঠন করেন। জামাল খাসোগির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁকে বুঝিয়ে দেশে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিল সরকার। এ জন্য ১৫ সদস্যের এ দলকে ইস্তাম্বুলে পাঠানো হয়। তাঁকে ফিরিয়ে আনতে শান্তিপূর্ণ উপায় অবলম্বনের স্থায়ী আদেশ জারি ছিল ১৫ সদস্যের দলের প্রত্যেক সদস্যর প্রতি। তবে অনুমতি ছাড়া যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও ছিল ১৫ জনের। দলটির পরিকল্পনা ছিল, ইস্তাম্বুলের বাইরে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত খাসোগিকে আটকে রাখার হবে। শেষ পর্যন্ত যদি রিয়াদে ফিরতে না চান তবে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হবে।

খাসোগি জানতে চান, ‘আমাকে অপহরণ করতে চান?’
সৌদি কর্মকর্তারা বলেন, ১৫ জনের দলে অনেক নির্দেশনা ছিল। কিন্তু শুরুতেই সবকিছু ভুল পথে পরিচালিত হতে থাকে। একপর্যায়ে কর্মকর্তারা আদেশ লঙ্ঘন করে দ্রুত সহিংস হয়ে ওঠেন। তারা খাসোগিকে কনসাল জেনারেলের কার্যালয়ে নেয়। যেখানে মাহের মুতরেব নামের এক কর্মকর্তার সঙ্গে তিনি তর্কে জড়িয়ে পড়েন।

খাসোগি মুতরেবকে বলেন, যদি তিনি এক ঘণ্টার মধ্যে কনস্যুলেট ভবন থেকে বের না হন, তাহলে তুরস্ক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন বাইরে থাকা তার বান্ধবী।

মুতরেব কূটনৈতিক নীতি-নৈতিকতা লঙ্ঘন করছেন উল্লেখ করে খাসোগি বলেন, আপনি আমার সঙ্গে কী করতে যাচ্ছেন। আপনি কী আমাকে অপহরণ করতে চান? মাহের মুতরেব বলেন, হ্যাঁ। আমরা তোমাকে ওষুধ দেব এবং এখান থেকে তুলে নিয়ে যাব। এরপর খাসোগি চিৎকার শুরু করলে তাকে শান্ত করতে মুখে কাপড় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। চিৎকার থামানোর চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে শ্বাসরোধে মারা যান খাসোগি।

ঘটনার ১৭ দিন পর ‘হাতাহাতির একপর্যায়ে খাসোগির মৃত্যু’ হয়েছে বলে বিবৃতি দিয়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। এর আগপর্যন্ত ঘটনার ব্যাপারে টানা অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছিল দেশটি।

২ অক্টোবর তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেট ভবনে ব্যক্তিগত কাগজপত্র আনার প্রয়োজনে ঢোকার পর থেকে নিখোঁজ ছিলেন সৌদির খ্যাতনামা সাংবাদিক খাসোগি। শুরু থেকে তুরস্ক দাবি করে আসছে, খাসোগিকে কনস্যুলেট ভবনের ভেতর সৌদি চরেরা হত্যা করেছে। গত বছর সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ক্ষমতা গ্রহণের পর রোষানলে পড়েন খাসোগি। তিনি দেশ ছেড়ে স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। ওয়াশিংটন পোস্ট-এ যুবরাজ মোহাম্মদের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে একের পর এক কলাম লেখেন। অভিযোগ উঠেছে, যুবরাজের নির্দেশে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এ হত্যা সংঘটিত হয়েছে।

খাসোগির দেহ কোথায়?
খাসোগির মৃত্যুর খবর স্বীকার করে সৌদি আরব বলে, ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেট ভবনের ভেতরে হাতাহাতির একপর্যায়ে জামাল খাসোগি মারা যান। এতে বলা হয়, গোয়েন্দা উপপ্রধান আহমাদ আল-আসিরি ও যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের জ্যেষ্ঠ ঘনিষ্ঠ সহযোগী সৌদ আল-কাহতানিকে এ ঘটনায় বরখাস্ত করা হয়েছে।

সৌদির প্রধান আইন কর্মকর্তা শেখ সৌদ আল-মোজেব এক বিবৃতিতে খাসোগির মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তবে খাসোগির দেহ কোথায় রাখা হয়েছে, এ ব্যাপারে তিনি কোনো তথ্য দেননি।

বিবৃতিতে বলা হয়, কনস্যুলেট ভবনের ভেতর যে লোকগুলোর সঙ্গে খাসোগির দেখা হয়েছিল, তাঁদের সঙ্গে তাঁর মারামারি হয়। একপর্যায়ে খাসোগি মারা যান। বিবৃতিতে খাসোগির আত্মার শান্তি কামনা করা হয়েছে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ঘটনার ব্যাপারে আরও তদন্ত চলছে। এ ঘটনায় ১৮ জন সৌদি নাগরিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দুই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে।

বরখাস্ত হওয়া সৌদ আল-কাহতানি ছিলেন সৌদি রাজ কোর্টের প্রভাবশালী সদস্য এবং যুবরাজ মোহাম্মদের উপদেষ্টা। টুইটারে তাঁর ১০ লাখেরও বেশি অনুসারী রয়েছে।