চীনে 'নাই' হয়ে যাওয়ার নেপথ্যে

সি চিন পিং ও মাও।
সি চিন পিং ও মাও।

কিছুদিন আগে হঠাৎ করেই নিখোঁজ হয়ে যান ‘এক্স-ম্যান’ ও ‘আয়রন ম্যান’খ্যাত অভিনেত্রী ফান বিংবিং ও ইন্টারপোলের প্রধান মেং হোংউআই। এই দুজন চীনা নাগরিকের হঠাৎ নিখোঁজ হওয়া নিয়ে শোরগোল পড়ে গেল বিশ্বে। চীনেও তোলপাড়।

বিবিসি অনলাইনের খবরে জানানো হয়, কয়েক মাস নিখোঁজ থাকার পর হঠাৎ করেই গেল অক্টোবরের শুরুতে জনসমক্ষে হাজির হয়ে যান ফান। কর ফাঁকি দেওয়া নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন। ক্ষতিপূরণ হিসেবে তিনি অর্থও দেন সরকারকে। ফানের ফিরে আসার দুদিনের মাথায় ‘নাই’ হয়ে যান ইন্টারপোলের প্রধান মেং হোংউআই। তাঁর স্ত্রীর দাবি, হারিয়ে যাওয়ার আগে স্বামী হোয়াটসঅ্যাপ থেকে তাঁকে একটি ছুরির ইমোজি টেক্সট করেছিলেন। এর অর্থ দাঁড়ায়—তিনি বিপদে।

এরপর ৮ অক্টোবর চীনা কর্তৃপক্ষ জানায়, ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। দুটি ঘটনায় আবারও প্রমাণ করে যে জোর করে গুম হওয়া চীনের জন্য নতুন কিছু নয়।

ইকোনমিস্টের খবরে জানানো হয়, ২০১৬ সালে চীনের পুলিশ কর্মকর্তা মেং হোংউআই ইন্টারপোলের প্রধান নির্বাচিত হন। এ ঘটনাকে দেশটির গণমাধ্যম ফলাও করে প্রচার করে। এরপর দুই বছর পরেই চিত্রটি সম্পূর্ণ উল্টো। মেং ‘নাই’ হয়ে যান। পরে বলা হয়, তিনি চীনে আটক আছেন।

অভিনেত্রী ফান বিংবিং ও ইন্টারপোলের সাবেক প্রধান মেং হোংউআই। ছবি: এএফপি
অভিনেত্রী ফান বিংবিং ও ইন্টারপোলের সাবেক প্রধান মেং হোংউআই। ছবি: এএফপি

৬৪ বছর বয়সী ইন্টারপোলের প্রধান মেং হোংউআইকে চীনের কর্মকর্তারা সেপ্টেম্বরে নিজের হেফাজতে নেন। ইন্টারপোলের সদর দপ্তর থেকে চীনে আসার পথেই তিনি নিখোঁজ হন। প্রথমে অবশ্য চীনা কর্মকর্তারা এ কথা মানতে চাননি। ৭ অক্টোবরের আগে তাঁরা স্বীকারই করেননি। পরে তাঁরা স্বীকার করেন যে মেং নাই হয়ে যাননি।

মেং হোংউআই চীনের প্রথম ব্যক্তি, যিনি ইন্টারপোলের প্রধান হয়েছিলেন।

ইন্টারপোলের প্রধান মেং হোংউআইয়ের স্ত্রী দাবি করেছিলেন, নাই হয়ে যাওয়ার আগে মেং তাঁকে একটি ছুরির ইমোজি পাঠিয়েছিলেন। মেংয়ের হোয়াটসঅ্যাপ থেকে পাঠানো এই ইমোজির অর্থ দাঁড়ায় তিনি ঘোরতর বিপদে। আর চীনে প্রবেশের পরই মেং এই ইমোজি বউয়ের কাছে পাঠান। মেং নাই হয়ে যাওয়ার পর তাঁর স্ত্রী ও দুই সন্তান হুমকি পান। তবে এ সময় ফ্রান্স–পুলিশ তাঁদের পাশে দাঁড়ায়। তাঁদের নিরাপত্তার মধ্যে রাখা হয়। এরপরই বলা হয়, মেং ইন্টারপোল থেকে পদত্যাগ করেছেন।

প্রশ্ন হচ্ছে, মেংকে কত দিন এভাবে থাকতে হবে। আসলে কেউও তা জানে না। চীন বলছে, ঘুষ নেওয়ার কারণে মেংকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। মেং হোংউআইয়ের আটকের বিষয়টি এটাই প্রমাণ করে যে, চীনে কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, রাজনৈতিকভাবে পার্টির নীতি ও আদর্শের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় না রাখার অর্থই মেংয়ের ভাগ্যবরণ। দেশটির কেন্দ্রীয় নেতা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের আদর্শে সম্মত হওয়া। আর চীনের কর্মকর্তারা যে ভাষায় কথা বলছেন, তাতে প্রমাণ হয় যে ইন্টারপোলের সাবেক প্রধান মেং হোংউআইয়ের মামলাটি কেবল দুর্নীতিসংশ্লিণ্ট নয়, রাজনৈতিকও।
ইকোনমিস্টের প্রতিবদনে বলা হয়েছে, ‘এভাবেই রাজনীতি ধ্বংস হয়ে যায় এবং পতন হয়।’

২০১২ সাল চীনের মসনদে বসেন সি চিন পিং। এরপরই তিনি শুরু করেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান। এই অভিযানে হাজারো ব্যক্তিকে জেলে পোরা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা হচ্ছে। ন্যাশনাল সুপারভিশন কমিশনের (এনএসসি) মাধ্যমে এই ধরপাকড় চলে।

অভিনেত্রী ফান বিংবিং। ছবি: রয়টার্স
অভিনেত্রী ফান বিংবিং। ছবি: রয়টার্স

অসীম ক্ষমতা
এনএসসি গঠনের অন্যতম উদ্দেশ্যই হলো দলের মধ্যকার ভিন্নমতের টুঁটি চেপে ধরা। শুধু রাজনৈতিক দলের নেতারাই নন, এনএসসির নজরে থাকেন সরকারি কর্মকর্তারাও। এনএসসির এজেন্টরা যাকে সন্দেহ হয়, তাকেই ধরেন। ৬ মাস জিজ্ঞাসাবাদ করেন। আর সন্দেহভাজন ব্যক্তির স্বজনকে কিছুই জানানো হয় না। অভিযুক্ত ব্যক্তি কোনো আইনি সহায়তাও পান না। কারণ যিনি এনএসসির জালে ধরা পড়েন, তাঁর স্বজনেরা জানেন না তিনি কোথায় আছেন।

মেংয়ের প্রতি চীনের মনঃক্ষুণ্নের কয়েকটি কারণের একটি হলো রেড নোটিশ জারি না করা। এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ইউঘুর সম্প্রদায়ের পক্ষের একজন প্রচারক পালিয়ে জার্মানিতে যান। তাঁর বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করতে চীনের আবেদন নাকচ করে দেন ইন্টারপোলপ্রধান মেং। আর এতে খ্যাপা সি চিন পিং সরকার। ফলাফল মেংয়ের নাই হয়ে যাওয়া।

লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের অধ্যাপক কিউ জিন বলেন, পশ্চিমা সমালোচকেরা বলছেন, নিজের মুঠোয় সব ক্ষমতা নেওয়ার জন্য ছয় বছর ধরে সি চিন পিং সম্ভাব্য সবকিছুই করেছেন। তাঁদের কথা একদিক থেকে সত্য। যেমন তিনি কিছু অর্থনৈতিক নীতি–সিদ্ধান্ত নিজের হাতে নিয়েছেন, যা আগে প্রধানমন্ত্রীর হাতে ছিল। কিন্তু মনে রাখতে হবে, শক্তিশালী ও কঠোর নেতা মানে কর্তৃত্ববাদী নেতা নয় এবং বড় ধরনের সংস্কারের জন্য এ রকম একজন শক্তিশালী নেতাই দরকার। সি চি পিং তাঁর প্রথম মেয়াদেই জেনে গেছেন তাঁর সামনের বাধা কী কী। এখন তিনি সেই বাধা সরানোর বিষয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ।

চীনে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান দিন দিন কঠোর হচ্ছে। এটি এখন একটি কাঠামোতে রূপ নিচ্ছে। এখন পর্যন্ত দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে শাস্তি পেয়েছেন প্রায় ১০ লাখ সরকারি কর্মকর্তা।

তবে এর সঙ্গে একমত নন সমালোচকেরা। তাঁদের মতে, দুর্নীতি শব্দটি ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দাই লোটা হচ্ছে। চীনের একসময়ের প্রভাবশালী নেতা জু ইয়াংকেংকে এর লক্ষ্য বানানো হয়েছিল। ২০১৫ সালে তাঁকে জেল দেওয়া হয় ঘুষের অভিযোগে। আর এবার আলোচনায় এল অভিনেত্রী ফান বিংবিং ও ইন্টারপোলের প্রধান মেং হোংউআইয়ের ঘটনা।

কেন এমনটি হচ্ছে?
এশিয়া সোসাইটির সিনিয়র ফেলো ইসাক স্টোন ফিস বলেছেন, চীনা কমিউনিস্ট পার্টি বিশ্বকে দেখাতে চাইছে যে, তাদের নিজেদের নিয়মকানুনই এখানে চলবে। এরাই নিয়ন্ত্রক এবং আর কারও কাছে তারা এসবের ব্যাখ্যা দিতে আগ্রহী নয়।
ইসাক স্টোনের মতে, ইন্টারপোলপ্রধানের ঘটনা জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক কিংবা আইএমএফের মতো বিশ্ব সংস্থাগুলোর দিকে একটি পরিষ্কার বার্তা। বার্তাটি হলো—চীনা নাগরিক যেখানেই কর্মরত থাকুক না কেন, তিনি যেকোনো সময়ই আটক হতে পারেন। আর আগাম তথ্য ছাড়াই সেটি হতে পারে।

বিশ্লেষকেরা মনে করেন, নাই হয়ে যাওয়ার সব ঘটনার ইঙ্গিত হলো দেশের ভেতরে কঠোর বার্তা দেওয়া; যে কেউই হোক তিনি ছাড় পাবেন না।
সারা বিশ্ব কীভাবে দেখছে সেটি নয়; বরং সেখানে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ও চীনা কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি আনুগত্যই প্রথম ও সবশেষ কথা।

‘নাই’ হয়ে যাওয়ার পর
অনেকেই নির্মমতার শিকার হয়েছেন। ঘুমাতে দেওয়া হয় না, মারধর করা হয়, যৌন নির্যাতনও করা হয় বলে অভিযোগ আছে। ইলেকট্রিক শক দেওয়াসহ নির্যাতনের নানান পন্থা অবলম্বন করা হয় জিজ্ঞাসাবাদের সময়। আর এটা নির্ভর করে কোন বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে তার ওপর। অথবা কাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে, সেটিও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য হতে পারে। আটক থাকার সময় যা–ই ঘটুক না কেন যাঁরাই হাওয়া হয়ে যান, তাঁরাই ফিরে এসে নিজের দোষ স্বীকার করেন। যেমন অভিনেত্রী ফান কিংবা ইন্টারপোলপ্রধানের দায়িত্ব পালন করা মেং করেছেন।