শিক্ষাবিপ্লবে মরিয়া চীন

পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়, বেইজিং, চীন। ছবি: রয়টার্স
পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়, বেইজিং, চীন। ছবি: রয়টার্স

বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক পরাক্রমশালী রাষ্ট্র চীন। সামরিক শক্তি ও প্রতিরক্ষা, নতুন নতুন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উপকরণ উদ্ভাবন এবং উন্নয়নে দেশটি যথেষ্ট এগিয়ে। সেই তুলনায় শিক্ষাক্ষেত্রে যেন এগিয়ে যেতে পারেনি।

যুক্তরাজ্যের সাপ্তাহিক প্রকাশনা টাইমস হায়ার এডুকেশন সাময়িকীর সর্বশেষ জরিপে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে চীনের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই। বিষয়টি তাদের ভাবিয়ে তুলেছে। অবশ্য সাংহাই র‌্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষ ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে চীনেরই আছে ৪৫টি বিশ্ববিদ্যালয়। এতে অবশ্য তারা সন্তুষ্ট নয়। শিক্ষাক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়ে শীর্ষস্থান দখল করতে চীন এখন মরিয়া। আর এ জন্য দেশটির নামকরা সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর আরও বেশি জোর দিয়েছে চীনা কর্তৃপক্ষ।

১৯১১ সালে বেইজিংয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়। শতাধিক বছরের পুরোনো এই বিশ্ববিদ্যালয় এখন গবেষণা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত বিষয়ে চীনাদের গর্বের প্রতীক। পশ্চিমা গবেষণাভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আদলে পরিচালিত হচ্ছে চীনের সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়। এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয় পরস্পর প্রতিবেশী ও প্রতিযোগী, যা কিনা চীনের অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ হিসেবে খ্যাত। সিংহুয়া হচ্ছে প্রচলিত ও বাস্তবধর্মী বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং, সাবেক প্রেসিডেন্ট হু জিনতাওসহ বিখ্যাত অনেকেই। আর পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে দেশটির কবি, দার্শনিক ও বিপ্লবীদের তীর্থস্থান। চীনের সাবেক শীর্ষ নেতা মাও সেতুং এই বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা করেছিলেন। ১৯৮৯ সালে তিয়েনআনমেন স্কয়ারে বিক্ষোভে বিশ্ববিদ্যালয়টি অগ্রণী ভূমিকা রাখে।

লন্ডনভিত্তিক সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন বলছে, ১৯৯৫ সাল থেকে চীনা কেন্দ্রীয় সরকার দেশটির বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্বের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করতে লাখ লাখ ডলার ব্যয় অব্যাহত রেখেছে। এর আওতায় প্রথম ২১১টি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রায় ১০০টি প্রতিষ্ঠানকে প্রস্তুত করা হয়েছে। ২০১৫ সাল থেকে চালু করা হয়েছে ডবল ফার্স্ট ক্লাস প্ল্যান প্রকল্প। এর লক্ষ্য দ্রুততম সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বমানে পরিণত করা ও প্রতিষ্ঠানের পরিসর বাড়ানো।

যেকোনো কিছুর পেছনে অর্থ হচ্ছে মূল চালিকা শক্তি। সেই অর্থ খরচ করতে প্রস্তুত চীন। অর্থায়ন প্রক্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে উৎকৃষ্ট মানের গবেষণায় অনুপ্রাণিত করে। চীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক গবেষণায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের যথেষ্ট প্রণোদনারও ব্যবস্থা রয়েছে। প্রযুক্তি ও প্রতিযোগিতানির্ভর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারও নীতিনির্ধারণে পরিবর্তন নিয়ে আসছে। বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, উন্নত গবেষণা, র‌্যাঙ্কিংয়ে অন্তর্ভুক্তি ও অগ্রগতির জন্য শিক্ষা খাতে চীন ছাড়াও ভারত, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, ফ্রান্স, জার্মানি বিপুল অর্থ ব্যয় করছে। প্রতিবেশী দেশ ভারত তাদের ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বমানে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এমনকি নাইজেরিয়ার মতো দেশ ২০২০ সালের মধ্যে তাদের অন্তত দুটি বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বের শীর্ষ ২০০টির মধ্যে অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।

সিংহুয়ার মেধাবী শিক্ষার্থীরা সেরা গবেষক হয়ে দেশের উন্নয়নে কাজ করেন কিংবা দেশের হয়ে বিদেশে গবেষণায় নিযুক্ত হন। ২০১৭ সালে সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয় ১ হাজার ৩৮৫ জনকে ডক্টরেট উপাধি দিয়েছে। একেই সময় যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এমআইটি) ৬৫৪ জনকে ডক্টরেট দেওয়া হয়। অবশ্য এই সংখ্যা সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাফল্যের প্রধান কারণ নয়। সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালের ভাইস চেয়ারম্যান ইয়াং বিন বলেন, ‘সিংহুয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন ছিল ১৯৭৮ সালে, যখন ডেং জিয়াওপিং (প্রয়াত রাজনীতিক) বলেন, চীন বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী বিদেশে পাঠাবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘১০ হাজার শিক্ষার্থী বিদেশে পাঠানো প্রয়োজন। আমাদের বৈজ্ঞানিক শিক্ষার স্তর উন্নত করার এটাই হচ্ছে অন্যতম প্রধান পথ।’

সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়, বেইজিং, চীন। ছবি: সংগৃহীত
সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়, বেইজিং, চীন। ছবি: সংগৃহীত

৪০ বছর ধরে সিংহুয়া এবং দেশের অন্য শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের কৃতিত্ব ধরে রেখেছে। এখানে অত্যন্ত প্রশিক্ষিত মানুষের সমাবেশ ঘটে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি আকর্ষণ বাড়াতে সরকারও অতিরিক্ত সম্পদ ও প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করে আসছে। ইয়াং বিন বলেন, ‘অনেক জাপানি মানুষ নোবেল পুরস্কার জিতেছেন। জনগণের প্রশ্ন, কেন চীনারা নোবেল পাচ্ছেন না?’ ১৯৭০ সালে অ্যান্টিম্যালেরিয়াল ড্রাগ আবিষ্কারের জন্য বিজ্ঞানে একমাত্র নোবেল পেয়েছেন টিউ ইউইউ। এ ক্ষেত্রে জাপানের ২৩ ও আমেরিকার আছে ২৮২টি নোবেল পুরস্কার রয়েছে। এ বিষয়ে ইয়াংয়ের ভাষ্য, স্বল্পমেয়াদি ফলাফলের জন্য এটি ভালো। কিন্তু অপ্রতিরোধ্য গবেষণার জন্য এটি সত্যিকার অর্থে বড় কিছু নয়।

সচরাচর বিদেশি ভাষার প্রতি চীনাদের তেমন আগ্রহ লক্ষ করা যায় না। শিক্ষা, গবেষণা, চিকিৎসা, বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা মাতৃভাষা ব্যবহার করে থাকে। আর এ জন্য কিছু ক্ষেত্রে যেমন সুবিধা আছে, তেমনি অসুবিধাও রয়েছে। বিশ্বের শীর্ষ জার্নালগুলো ইংরেজি ভাষায় লিখিত ও প্রকাশিত হয়, যা চীনা বিজ্ঞানীদের জন্য প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলায় অনেকে প্রতীকী বা সাংকেতিক ভাষা ব্যবহার করেন। সিংহুয়ার শিক্ষা বিভাগ বলছে, চীনা সামাজিক বিজ্ঞানীরা অভিযোগ করেছেন, তাঁদের সেরা ধারণা বা গবেষণা অনুবাদ করা কঠিন। অন্যদিকে, ইংরেজি ভাষায় রচিত বিভিন্ন গবেষণাকর্ম চীনা ভাষায় অনুবাদে বিশেষজ্ঞ সহজলভ্য নয়। ফলে ভাষাগত জটিলতা চীনাদের জন্য একটা সমস্যা বটে। তবে সর্বজনীন আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইংরেজিকে তারা গুরুত্ব দিতে শুরু করেছে।

মোদ্দা কথা হচ্ছে, শিক্ষাক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটাতে এবং বিশ্বের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাতারে চীনের বিশ্ববিদ্যালয়কে অন্তর্ভুক্তি করতে যা করা প্রয়োজন, তা–ই তারা করে যাচ্ছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সিংহুয়া জার্নাল অব এডুকেশনের সম্পাদকীয় পরিষদের সদস্য সিমন মার্জিনসন বলেন, আগামী পাঁচ বছর কিংবা এর কম সময়ের মধ্যে নাম্বার ওয়ান বিশ্ববিদ্যালয় হবে সিংহুয়া।