ভারতের সঙ্গে শান্তি চায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী!

খবরটা বেশ অবাক করে দেওয়ার মতোই। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ‘চিরশত্রু’ ভারতের সঙ্গে শান্তি চায়। সুসম্পর্ক চায়। হঠাৎ তাদের এই মনোভাব কেন? অর্থ ও বাণিজ্যবিষয়ক সাময়িকী ‘ব্লুমবার্গ’ বলছে, পাকিস্তানের অর্থনীতির অবস্থা সম্প্রতি খুব একটা ভালো না। এ ছাড়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও পাকিস্তানকে খুব ভালো চোখে দেখছেন না। এসব ব্যাপারই পাকিস্তানের ‘মহাক্ষমতাধর’ সেনাবাহিনীকে ভারতের বিষয়ে সুর নরম করতে বাধ্য করছে। 

পাকিস্তানের বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়ার কিছুটা ‘নরমপন্থী’ হিসেবে খ্যাতি রয়েছে। বিশেষ করে তাঁর পূর্বসূরিদের চেয়ে তিনি যথেষ্টই উদার। সম্প্রতি পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে সীমান্ত নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিতে কিছুটা ছাড় দিয়েছে। শিখ তীর্থযাত্রীদের জন্য সীমান্ত খুলে দেওয়া এর একটি উদাহরণ। পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল বাজওয়া একে উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি বড় উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
তবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারতের সঙ্গে শান্তি চায় আরও কিছু কারণে। সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের খরচ হিসাবে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে যে ২০০ কোটি ডলার সাহায্য দিত, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সম্প্রতি সেটি বন্ধ করে দিয়েছেন। এটি বন্ধ করার কারণ বর্ণনা করতে গিয়েও পাকিস্তানের বিপক্ষে রীতিমতো উষ্মা প্রকাশ করেছেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তে পাকিস্তান সামরিক ও আর্থিক, দুই দিক দিয়ে পুরোপুরি চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ব্যাপারটি পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে যথেষ্ট ভাবিয়ে তুলেছে।
চীনের ‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড’ নীতিতে পাকিস্তানের জোরালো সমর্থন আছে। এর বিনিময়ে পাকিস্তানে চীন প্রায় ৬০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে। কিন্তু এই বিনিয়োগ পাকিস্তানের দেনার বোঝাই কেবল বাড়িয়েছে। এই বোঝা পাকিস্তানকে রাষ্ট্র হিসেবে দেউলিয়াত্বের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তবে সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) পাকিস্তানকে বড় অঙ্কের ঋণ ছাড় করায় প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ও তাঁর সরকার হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। আশির দশকের পর এ নিয়ে ১৩ বার পাকিস্তানের ঋণ মাফ করতে হলো আইএমএফকে।
সেনাপ্রধান জেনারেল বাজওয়া প্রকাশ্যে চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড নীতিকে সমর্থন করলেও ভেতরে-ভেতরে পুরো বিষয়টি নিয়েই অত্যন্ত উদ্বিগ্ন পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী।
ভারতের সঙ্গে শান্তি প্রক্রিয়া শুরুর ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল গত আগস্টে ইমরান খানের ক্ষমতায় বসার পর থেকেই। জুলাইয়ে নির্বাচনে জিতেই যে বক্তৃতাটি ইমরান দিয়েছিলেন সেখানে ভারতের সঙ্গে শান্তির বিষয়টি জোরালোভাবেই ছিল। তিনি বলেছিলেন, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও রাজনৈতিক দলগুলো ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা কাশ্মীর দ্বন্দ্ব মিটিয়ে ফেলতে একমত। সম্প্রতি ইমরান খান স্বীকার করেছেন, ২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর মুম্বাইয়ে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় জড়িত লস্কর-ই-তাইয়েবা পাকিস্তানের আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়েছে। তবে শান্তির প্রশ্নে ভারত এখনো পর্যন্ত ইমরান খান বা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কোনো উদ্যোগকেই প্রকাশ্যে স্বাগত জানায়নি। এ ব্যাপারে কোনো আগ্রহও প্রকাশ করেনি।
পাকিস্তানের বিপক্ষে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ একই ধরনের—পাকিস্তান সব সময়ই সন্ত্রাসীদের চারণভূমি। এই দায় পাকিস্তান কখনোই এড়াতে পারেনি। ভারত সব সময়ই অভিযোগ করে যে লস্কর-ই-তাইয়েবা ২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বরে মুম্বাইয়ে ভয়াবহ হামলা চালিয়েছে, তারা এখনো পাকিস্তানে আশ্রয়-প্রশ্রয় পাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের সঙ্গে শান্তি প্রক্রিয়া শুরুর যে তোড়জোড় হঠাৎ করে পাকিস্তান করছে, সেটির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তারা বোঝাতে চাইছে যে শান্তির প্রশ্নে তারা আন্তরিক। কিন্তু সন্ত্রাসবাদের প্রশ্নে নিজেদের অবস্থানের কার্যকর কোনো পরিবর্তন না ঘটিয়ে শান্তি প্রক্রিয়ার আহ্বান সে কারণেই ভারতকে সন্দিগ্ধ করে তুলেছে। এমনিতেই আগামী বছরের মে মাসের আগেই ভারতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। পাকিস্তান খুব ভালো করেই জানে, এই সময় ভারতের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীই কেবল নয়, রাজনৈতিক অঙ্গনেও জোরালো থাকবে পাকিস্তান-বিরোধিতা। পাকিস্তান এখন চাচ্ছে, প্রস্তাবগুলো পেশ করে এ ব্যাপারে এগিয়ে থাকতে। পারলে পেছনের দরজার কূটনীতি দিয়ে এগিয়ে যেতে, যাতে ভারতের পরবর্তী নতুন সরকার মসনদে বসার সঙ্গে সঙ্গে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের প্রতি কিছুটা নরম হয়েছে। সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের ব্যয় হিসেবে তারা পাকিস্তানকে যে ২০০ কোটি ডলার দিত, সেটি বন্ধ করে দেওয়ার পর পাকিস্তান যে অথই সাগরে পড়েছে, তার মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র বা ট্রাম্প প্রশাসন চিঠি লিখে পাকিস্তানকে তালেবানের সঙ্গে আলোচনা আয়োজন বা মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চাচ্ছেন ২০০১ সাল থেকে চলে আসা তালেবানবিরোধী যুদ্ধের একটা স্থায়ী অবসান। ব্যাপারটি কিছুটা হলেও স্বস্তি এনেছে পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনীর মধ্যে।
পাকিস্তানের সামরিক শক্তির সবচেয়ে বড় উৎস যুক্তরাষ্ট্রও চায় ভারতের সঙ্গে তাদের মোটামুটি ভালো সম্পর্ক। একই সঙ্গে ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রও চাচ্ছে পাকিস্তানের সামরিক শক্তির একটা বড় অংশ এ অঞ্চলে উগ্রপন্থীদের দমনে ব্যবহার করুক তারা।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার ‘দোষারোপের সম্পর্ক’ ৭২ বছর ধরে চলে আসছে। এই দুটি দেশ একে অন্যের বিরুদ্ধে তিনটি বড় ধরনের যুদ্ধ করেছে। সীমান্তে দুই দেশের সেনাবাহিনীর মুখোমুখি অবস্থান এখন আর কোনো বিরল ঘটনা নয়। এমন শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির মধ্যে পাকিস্তানের সেনাপ্রধানের কথাবার্তা ও উদ্যোগ আশা জাগায়। ভারত এই উদ্যোগটাকে কেবল বিশ্বাসে নিতেই সময় নিচ্ছে। এই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কটা যদি শক্তিশালী কোনো তৃতীয় পক্ষীয় চাপে স্বাভাবিক হয়, সেটি মন্দ হয় না। কিন্তু এমনটি হবে কবে? আদৌ কি হবে?