হোয়াটসঅ্যাপে বই লিখে বন্দীর সাহিত্য পুরস্কার জয়

পাঁচ বছর ধরে মানুস দ্বীপে বন্দী জীবন যাপন করছেন ইরানি কুর্দি সাংবাদিক বেহরুজ বুচানি। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
পাঁচ বছর ধরে মানুস দ্বীপে বন্দী জীবন যাপন করছেন ইরানি কুর্দি সাংবাদিক বেহরুজ বুচানি। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

ইরানি কুর্দি সাংবাদিক বেহরুজ বুচানি অস্ট্রেলিয়ায় আশ্রয়ের সন্ধানে নৌকায় পাড়ি দিচ্ছিলেন সাগর। বিপজ্জনক এ যাত্রার কারণে তাঁকে অস্ট্রেলিয়া কর্তৃপক্ষ বন্দী করে। পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি বন্দী জীবন যাপন করছেন। মাঝে আটক কেন্দ্র পাল্টেছেন। এখন শ–খানেক মানুষের সঙ্গে রয়েছেন পাপুয়া নিউগিনির মানুস দ্বীপে। নিঃসঙ্গ বন্দী জীবনে হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা লিখে লিখে গোটা একটি বই লিখে ফেলেন তিনি। আর সেই বইটি এ বছর অস্ট্রেলিয়ার সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার জয় করেছে।

বিবিসি অনলাইনের খবরে জানানো হয়, দ্বীপে আটক অবস্থায় হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা লিখে ‘নো ফ্রেন্ড বাট দ্য মাউন্টেনস’ (পাহাড় ছাড়া কোনো বন্ধু নেই) শিরোনামে বই লেখেন বুচানি। তাঁর লেখা এই বইটি ২০১৯ সালে ‘ভিক্টোরিয়ান প্রাইজ ফর লিটারেচার’ পুরস্কার লাভ করে। এ পুরস্কারের অর্থ মান হচ্ছে এক লাখ অস্ট্রেলিয়ান ডলার (৬০ লাখ ৯৭ হাজার টাকার বেশি)। সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার ছাড়াও নো ফ্রেন্ড বাট দ্য মাউন্টেনস ভিক্টোরিয়ান প্রিমিয়ারস লিটারারি অ্যাওয়ার্ডসের নন–ফিকশন শাখায় পুরস্কার জিতেছে। এর অর্থমূল্য ২৫ হাজার অস্ট্রেলিয়ান ডলার (১৫ লাখ ২৪ হাজার টাকার বেশি)।

বুচানি পাপুয়া নিউগিনির সেই বন্দিশালা থেকে অস্ট্রেলিয়ায় প্রবেশের অনুমতি পাননি। ২০১৩ সালে প্রথম আটক হন বুচানি। ওই আটক কেন্দ্রটি নিয়ে বিতর্কের জের ধরে তা ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের শেষে বন্ধ করে দেওয়া হয়। তাঁদের সরিয়ে নেওয়া হয় মানুস দ্বীপে। আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে নৌকায় করে অস্ট্রেলিয়ায় যাত্রা করার ব্যাপারে দেশটির নীতিমালা অনেক কঠোর। নৌকায় করে বিপজ্জনকভাবে প্রতিবছর অনেকে অস্ট্রেলিয়ায় প্রবেশের চেষ্টা করেন। বিপজ্জনক যাত্রায় বিপুলসংখ্যক মানুষের মৃত্যুও হয়েছে। তাই এ যাত্রাকে নিরুৎসাহিত করতে অস্ট্রেলিয়া এ ব্যাপারে কঠোর নীতিমালা তৈরি করেছে।

এ বছর পুরস্কারজয়ী অন্য সাহিত্যিকেরা যখন মেলবোর্নে আনন্দ উদ্‌যাপন করছেন তখন বন্দিদশা থেকে বিবিসির কাছে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বুচানি জানান, এ পুরস্কারপ্রাপ্তির পর তাঁর প্রচলিত আনন্দের বাইরে এক অন্য রকম অনুভূতি কাজ করছে। তিনি বলেন, ‘একদিক দিয়ে আমি খুব আনন্দিত। কারণ এমন দুরবস্থার মধ্যেও আমরা মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছি। এই পরিস্থিতির মধ্যে অনেক মানুষ ভয়ে দিন কাটাচ্ছে। আরেক দিক দিয়ে মনে হচ্ছে পুরস্কার পাওয়ার আনন্দ উদ্‌যাপনেরও অধিকার নেই আমার। কারণ আমার অনেক বন্ধু এখানে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের প্রথম কথা হচ্ছে স্বাধীনতা পাওয়া, এই দ্বীপের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে নতুন জীবন শুরু করা।’

২০১৩ সালে বুচানি প্রথমবার আটকের পর ওই বিতর্কিত আটক কেন্দ্রে বসে ফারসি ভাষায় বই লেখা শুরু করেন। তিনি হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ছোট ছোট বার্তায় লিখে পাঠাতেন ওমিদ তোফিঘাইয়ান নামের একজন অনুবাদকের কাছে।
বুচানি বলেন, ‘হোয়াটসঅ্যাপ আমার অফিসের মতো। আমি কাগজে লিখতে পারতাম না। কারণ ওই সময় প্রতি সপ্তাহে বা প্রতি মাসে নিরাপত্তা প্রহরীরা আমাদের কক্ষে এসে হামলা চালাত এবং আমাদের যা কিছু আছে তা তল্লাশি করত। আমি দুশ্চিন্তা করতাম যে আমার লেখাগুলো হয়তো হারিয়ে ফেলব। তাই আমার জন্য ভালো ছিল তা লিখে ফেলা এবং সঙ্গে সঙ্গে তা বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া।’

২০১৩ সালে বন্দী অবস্থায় ওই আটক কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বুচানি বেশ সোচ্চার ছিলেন। এ কারণে তাঁর পরিচিতিও ছিল। তিনি যুক্তরাজ্যের গার্ডিয়ান পত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। মানুস দ্বীপে নির্বাসিত জীবন নিয়ে নিয়মিত টুইট করেন এবং অস্ট্রেলিয়ার কঠোর নীতি নিয়ে সমালোচনা করেন অনলাইনে। তিনি একটি তথ্যচিত্রও তৈরি করেছেন মুঠোফোনে। তাঁর সঙ্গে এখন ১০০ বন্দী রয়েছেন ওই দ্বীপে। পাপুয়া নিউগিনিতে তিনি শরণার্থীর মর্যাদা পেয়েছেন। কিন্তু আরও অনেক শরণার্থীর মতো তিনিও সেখানে থাকতে চান না।

বুচানি জানান, সাংবাদিকতা নিয়ে তাঁর সঙ্গে ইরানি কর্তৃপক্ষের সমস্যা শুরু হয়। তিনি বন্দী হতে চাননি বলে ইরান ছেড়ে পালান। কিন্তু এখন সেই বন্দী জীবনই যাপন করতে হচ্ছে।

‘ভিক্টোরিয়ান প্রাইজ ফর লিটারেচার’ পুরস্কারের জন্য সাধারণভাবে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক বা স্থায়ী বসবাসের অনুমতি পাওয়া ব্যক্তিরাই শুধু আবেদন করতে পারেন। তবে বুচানির বইটির ব্যাপারে জুরি বোর্ডের সদস্যরা এতটাই মুগ্ধ হন যে তাঁদের বিশেষ অনুরোধে বইটিকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়।