অস্ত্র বানাতে প্রযুক্তির এই অপব্যবহার!

হারোপ ড্রোন—মানুষের দৃষ্টি ও শ্রবণসীমার বাইরে থেকে ওত পাতার মোক্ষম অস্ত্র
হারোপ ড্রোন—মানুষের দৃষ্টি ও শ্রবণসীমার বাইরে থেকে ওত পাতার মোক্ষম অস্ত্র

হারোপ, নামটা হয়তো অধিকাংশের কাছে অপরিচিত। কিন্তু জানেন কি, উড্ডয়নস্থল থেকে ছুটে গেল ‘হারোপ’ অনেকটা তেজি ঘোড়ার মতো। না, নিজের গতির জন্য বিখ্যাত নয় ‘হারোপ’। এই ড্রোনের মূল কাজ ইতস্তত ঘুরে বেড়ানো। ভূপৃষ্ঠ থেকে অনেক উঁচুতে। এত উঁচুতে যে নিচে যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থানরত কারও পক্ষে তাকে দেখা বা তার পাখার শব্দ শোনাও অসম্ভব। দৃষ্টি ও শ্রবণসীমার বাইরে থেকে এই ড্রোন ওত পেতে থাকে মোক্ষম সুযোগের। কাজ সেরে নিজেই ফিরে যেতে পারে ঘাঁটিতে। করতে পারে সহজ অবতরণ। যদি সে ভুল ঠিকানায় ফেরে, তাতেও সমস্যা নেই সন্দেহজনক বস্তু হিসেবে রাডারের কোপানলে পড়ার আগেই তার সিগন্যাল পড়ে নিয়ে নিজেকে তার মতো করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে ‘হারোপ’-এর।

ইসরায়েলি অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ (আইএআই) নির্মাণ করেছে এই ‘হারোপ’ নামের ড্রোন। এক দশকের বেশি সময় ধরে এই ড্রোন তারা বাজারে বিক্রি করছে। আইএআইয়ের উল্লেখযোগ্য দুই ভোক্তা হচ্ছে ভারত ও জার্মানি। যদিও দুই দেশের কেউই এই ড্রোনকে রাডার ফাঁকি দেওয়ার সক্ষমতা নিয়ে স্বয়ংক্রিয় মোডে পরিচালনা করেনি। তারা দূর নিয়ন্ত্রণের (রিমোট কন্ট্রোল) মাধ্যমেই একে পরিচালনা করেছে। ২০১৬ সালে আর্মেনিয়া-আজারবাইজান সংঘাতের সময়ও ‘হারোপ’ ব্যবহৃত হয়েছে। সেখানেও নিয়ন্ত্রণ ছিল কোনো মানুষের হাতেই। তবে সিরিয়ার প্রেক্ষাপটটি ভিন্ন। সিরিয়াতেই সম্ভবত ‘হারোপ’ তার পূর্ণ সক্ষমতা তথা স্বাধীনতা ভোগ করতে পেরেছিল বলে মনে করে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট।

শুধু হারোপ নয়, বিশ্বব্যাপী বহু অস্ত্রের সঙ্গে এখন যুক্ত হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিষয়টি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে গবেষণা এখন অন্য এক মাত্রায় উন্নীত হয়েছে। চালকবিহীন গাড়ি, কর্মী রোবটসহ নানা ধরনের বিষয় সামনে আসছে। মানুষ আরও অনুপুঙ্খ, আরও নিপুণ কাজের জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার শরণ নিচ্ছে। নিজেই তৈরি করছে নিজের সহকারীকে। কিন্তু এই অভিমুখ এক ভয়াবহ শঙ্কার জন্ম দিচ্ছে। এই শঙ্কা থেকেই ৫০টি দেশের ৮৯টি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) যৌথভাবে ‘ঘাতক রোবট প্রতিহত’ করার দাবিতে প্রচার শুরু করেছে। এই প্রচার কার্যক্রম একই সঙ্গে ভয়াবহ ক্ষমতাসম্পন্ন অস্ত্র ও অমানবীয় বুদ্ধিমত্তার বিষয়টি সামনে নিয়ে আসছে, যার কথা বহু আগেই উদ্ধৃত হয়েছে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিতে।

গবেষণাপ্রতিষ্ঠান স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (সিপ্রি) ২০১৭ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়, হারোপ একা নয়। এমন অন্তত ৪৯টি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র এরই মধ্যে বিশ্বের সামরিক বিভাগে যুক্ত হয়েছে, যেগুলোর লক্ষ্য নির্ধারণ এবং তাতে আঘাত করার ক্ষমতা রয়েছে কোনো মানুষের সরাসরি নির্দেশ ছাড়াই। এমনকি এমন অস্ত্র যে একেবারে নতুন তা-ও নয়। কারণ, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে আঘাত হানতে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র বহু আগেই তৈরি করেছে মানুষ। নির্দিষ্ট একটি রাডারের সিগন্যাল শনাক্ত করেই হামলাস্থল নির্ধারণ করে আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র। কামানের গোলা থেকে এগুলো একেবারেই আলাদা। উল্লেখ করা যেতে পারে স্থলমাইনের কথা, যা শত শত বছর ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এসব স্থলমাইন একবার পেতে দিলেই মানুষের কাজ শেষে। এরপর তাকে যে-ই মাড়াবে, তাকেই উড়িয়ে দেবে সে। এ জন্য কারও নির্দেশের প্রয়োজন পড়ে না তার।

এই স্বয়ংক্রিয় তথা স্বাধীন অস্ত্রের শক্তি বাড়ছে। সময়ের সঙ্গে আরও বেশি করে স্বাধীন হচ্ছে এগুলো। এ অবস্থায় এই ধরনের অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ মানুষের হাতে রাখার বিষয়টি ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এ নিয়ে আলোচনা চলছে, কিন্তু সমাধান আসছে না। হারোপের কথা বলা হলো। কারও কাছে থাকা হারোপ সম্পূর্ণ স্বাধীন নাকি মানুষের নিয়ন্ত্রণাধীন, তা একমাত্র এর পরিচালনায় থাকা সফটওয়্যারই বলতে পারে। কে কোন সফটওয়্যারটি ব্যবহার করছে, তা সততার সঙ্গে তথ্য ভাগাভাগি ছাড়া জানা সম্ভব নয়।

হারোপ ড্রোন—মানুষের দৃষ্টি ও শ্রবণসীমার বাইরে থেকে ওত পাতার মোক্ষম অস্ত্র
হারোপ ড্রোন—মানুষের দৃষ্টি ও শ্রবণসীমার বাইরে থেকে ওত পাতার মোক্ষম অস্ত্র

আধা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র অনেক আগে থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে পৃথিবীতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং এর পরবর্তী সময়ে এ ধরনের অস্ত্রের বিকাশ হয়েছে সবচেয়ে বেশি। ইকোনমিস্ট বলছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেই টর্পেডো ব্যবহৃত হয়, যা শব্দ, রাডার সিগন্যাল কিংবা তাপ শনাক্তের মধ্য দিয়ে হামলার লক্ষ্য নির্ধারণে সক্ষম। কিন্তু এই টর্পেডোর নিয়ন্ত্রণটি শেষ পর্যন্ত ছিল মানুষের হাতেই। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র এবং এর মিত্রদের ব্যবহার করা প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। যুক্তরাষ্ট্র এবং এর মিত্রদেশগুলোর নৌবাহিনী ‘ফ্যালাংক্স’ নামের এই প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ব্যবহার করে। এই ব্যবস্থা একবার চালু করে দিলেই এর সামনে অপরিচিত যা আসবে, তাকেই আঘাত করবে। মানুষের পক্ষে মোকাবিলা করা কঠিন এমন দ্রুত ছুটে আসা ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংসের ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা জরুরি। একই ধরনের স্বয়ংক্রিয় ‘রোবট গান’ ব্যবহার করা হয় উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার সীমান্তে। এই প্রযুক্তি এখন আরও বেশি দক্ষ হয়ে উঠছে। কম্পিউটারের শক্তি বাড়ছে। ফলে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের কোনো নির্দিষ্ট বস্তু শনাক্তের দক্ষতাও বাড়ছে। আইফোন যখন তার ব্যবহারকারীর চেহারা শনাক্ত করে তাকে স্বাগত জানাতে পারে, তখন সামরিক খাতে ব্যবহৃত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন অস্ত্রের দক্ষতা সহজেই অনুমেয়। আর ক্রমবর্ধমান এই দক্ষতাই শঙ্কার জন্ম দিচ্ছে।

তবে এখন পর্যন্ত স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে পর্যবেক্ষণের মতো কাজগুলোতেই। ড্রোন, সাবমেরিন থেকে শুরু করে এ ধরনের ব্যবস্থা এখনো হামলার কাজে সরাসরি ব্যবহার করা হয়নি। এ ধরনের ক্ষমতাসম্পন্ন যন্ত্রগুলোর নিয়ন্ত্রণ মানুষ এখনো নিজের হাতেই রেখেছে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ইংল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলে স্যালিসবারিতে বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ‘স্বয়ংক্রিয় যোদ্ধাদের’ একটি মহড়া অনুষ্ঠিত হয়। মহড়াটি মূলত উদ্ধারকাজ, পর্যবেক্ষণ, রসদ সরবরাহের মতো বিষয়গুলোকে নিয়ে চালানো হয়েছিল বলে উল্লেখ করা হয় ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্নয়ন একই সঙ্গে মানুষের সাফল্য ও শঙ্কা—দুটিকেই মূর্ত করে। গত বছর প্রকাশিত ফোর্বসের এক প্রতিবেদনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে মানুষের জন্য সম্ভাব্য সবচেয়ে বড় বিপদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। একই সঙ্গে এ বিষয়টির সম্ভাবনার দিকটিও এতে তুলে ধরা হয়। একই শঙ্কাকে উপজীব্য করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ইন্ডিয়া টুডেসহ বিশ্বের বড় বড় পত্রিকা। এসব পত্রিকায় প্রয়াত পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং থেকে শুরু করে টেসলার প্রতিষ্ঠাতা এলন মাস্ক পর্যন্ত অনেককেই উদ্ধৃত করা হয়েছে, যেখানে তাঁদের প্রায় সবাই এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে অস্ত্র উৎপাদন ও গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংশ্লেষ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

তাঁদের এই শঙ্কা যৌক্তিক নিঃসন্দেহে। কারণ, পেন্টাগনের গবেষণা কেন্দ্র ডিএআরপিএ দীর্ঘদিন ধরে এ নিয়ে গবেষণা করছে । ইকোনমিস্ট জানাচ্ছে, সেখানে এখন আর ফাইটার-বোম্বারকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। গণবিধ্বংসী স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের বদলে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে নিপুণভাবে আঘাত করতে সক্ষম অস্ত্রের প্রতি তাদের আগ্রহ বেশি। ইউরোপীয় ক্ষেপণাস্ত্র প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এমডিবিএ এমন ক্ষমতাসম্পন্ন অস্ত্র তৈরির গবেষণা করছে, যা কিনা তাকে দেওয়া আদেশগুলো নিজের মতো করে সাজাতে পারবে। এমনকি একাধিক অস্ত্রকে একই আদেশ দেওয়া হলে, তারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যমে সমন্বয় করে নিতে পারবে। এসব গবেষণার ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় গুরুত্ব পাচ্ছে, তা হলো নিয়মিত সেনাবাহিনী পোষা বিপুল খরচ। কিন্তু অস্ত্রকে বেতন দিতে হয় না। আর পেনশনের তো কোনো প্রশ্নই আসে না।

গোটা বিষয়টা এমন এক দিকে যাচ্ছে, যখন ভবিষ্যৎ প্রযুক্তির সম্ভাবনা ও শঙ্কা নিয়ে তর্ক শুরু হয়েছে। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিতে দেখানো প্রযুক্তি দানবের গ্রাসে পৃথিবী এমন দৃশ্য যেন মূর্ত হয়ে উঠছে ক্রমশ। এই দৃশ্য আর যা-ই হোক, কোনোভাবেই স্বস্তিকর নয়। অনেকেই সতর্ক করছে, দিচ্ছে বিবৃতি। আন্দোলনও হচ্ছে। ভবিষ্যৎ পৃথিবী ও প্রজন্মকে নিরাপদ রাখতে সামনে আনা হচ্ছে নানা বিকল্প। কিন্তু কোনো বিকল্পই ঠিক নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। কারণ, মানুষের আকাঙ্ক্ষা। বিশ্ব মোড়লেরা আগেও প্রতিযোগিতায় নেমে বিশ্বকে ঠেলে দিয়েছিল খাদের কিনারায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ বহন করছে। এই প্রতিযোগিতা ও বিশ্ব শাসনের অভিলাষ মূলত মানুষই পোষণ করে। প্রযুক্তি এখনো এই স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্ন কোনোটাই দেখতে শুরু করেনি। এখনো প্রস্তুত নয় সে। সে কীভাবে প্রস্তুত হবে এবং তার পরিণতি কী হবে, তা আদতে এখনো মানুষের ওপরই নির্ভর করছে।