মথুরায় হেমা মালিনীর ভাগ্য

হেমা মালিনী
হেমা মালিনী

‘আস্থার জন্য ওঁকে মেকআপ নিতে হয়, আমার হয় না। আমি মেকআপ ছাড়াই কনফিডেন্ট।’

এই কথাটা যাঁর বলা, হলফ করে বলতে পারি, মথুরার অনেকে হয়তো তাঁকে চেনেন না। তবে যাঁর সম্পর্কে বলা, তাঁকে এক ডাকেই চেনে গোটা দেশ। কিন্তু ওই যে বলে না, তুমি যদি আস্থাবান না হও, তাহলে যুদ্ধ জেতা তো দূরের কথা, তরোয়ালটাও ঠিকমতো ধরতে পারবে না। তো, তরোয়ালটা ঠিকঠাক ধরে লড়াইটা শেষ পর্যন্ত চালিয়ে যেতে রাষ্ট্রীয় লোক দলের নরেন্দ্র সিং নিজের চেহারায় কয়েক পোঁচ আস্থা লেপে দিয়েছেন। নইলে এই মথুরায় হেমা মালিনীকে টক্কর দেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়।

ব্রজভূমি মথুরায় বিজেপির হেমা মালিনীকে টেক্কা দিতে নরেন্দ্র সিং বিরোধী জোটের প্রার্থী। বাড়তি কিছুটা জোর তাই তাঁর বাড়তি পাওনা।

সেই জোরের কারণে কি না বলা কঠিন, নরেন্দ্র সিং ইতিমধ্যেই নিজেকে তুলে ধরতে হরেক কিসিম ডায়ালগ দিতে শুরু করেছেন। যেমন ‘হেমা মালিনীকে সিনেমায় দুর্দান্ত দেখতে লাগে। কিন্তু মথুরার মাঠেঘাটে? সেখানে আমিই সুন্দর।’ অনেকটা ওই ‘বন্যেরা বনে সুন্দর’ টাইপের ডায়ালগ। কিংবা ‘হেমা মালিনীকে দেখা যাচ্ছে কোথায়? ঠান্ডা গাড়ির বাইরেই তো বেরোন না? মেকআপ চটকে যাবে যে! বছরে দু–একবার উনি এখানে বেড়াতে আসেন। গত পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা তো এটাই। মথুরার পাবলিক যাকে দেখতে পায়, সে এই বান্দা। বত্রিশ বছর ধরে পার্টিটা আমি এখানেই করি। থাকিও এখানে।’

এই মথুরা গতবার হেমা মালিনীকেই লোকসভায় পাঠিয়েছিল। মোদি হাওয়ায় ভেসে সাড়ে তিন লাখ ভোটে যাঁকে হারিয়েছিলেন, তিনি ছিলেন ২০০৯–এর জয়ী। অজিত সিংয়ের ছেলে জয়ন্ত চৌধুরী। জয়ন্ত এবার সরে গেছেন বাগপতে। ফলে কপাল খুলেছে নরেন্দ্রর। প্রার্থী হিসেবে নরেন্দ্র লাইটওয়েট।

কিন্তু হেমা তবু সিরিয়াস। প্রচারের প্রথম দিনেই গমের খেতে নেমে গেলেন। মাঠে মাঠে পাকা গম কাটা হচ্ছে। এক নারীর হাত থেকে কাস্তে নিয়ে গম কাটা শুরু করলেন। কাস্তে ও গম হাতে ‘মাদার ইন্ডিয়া’ টাইপের পোজ দিলেন। এলাকায় জাট আধিপত্য প্রশ্নাতীত। জাট জাত্যভিমানের সঙ্গে ট্রাক্টর মানানসই, ঠিক যেমন পানির মধ্যে মাছ। হেমা তাই ঘটা করে ট্রাক্টর চালালেন। এসব ছবি ভাইরাল হয়েছে। ভাইরাল তাঁর সাক্ষাৎকারও। ‘বছরে অন্তত আড়াই শ বার মথুরায় এসেছি’ কিংবা ‘এলাকায় এত উন্নয়ন করেছি যে কী কী করেছি মনে নেই’ ধরনের মন্তব্য। মুখে মুখে ফিরছে তাঁর ভাষণও। ‘রাধে রাধে’ সম্বোধনে শুরু ও ‘জয় মোদিজি, জয় ভারত’ বলে ভাষণ শেষের মধ্যবর্তী অংশে মনে করিয়ে দিতে ভুলছেন না, অভিনয়জীবনে এতবার রাধা ও মীরা সেজেছেন যে মথুরা ও তিনি অবিচ্ছেদ্য।

এই রকম একটা সাক্ষাৎকারে হেমা বলে ফেলেন, এলাকায় রাস্তা তৈরি বা নর্দমা পাকা করা এমপির কাজ নয়। ওসব পঞ্চায়েতের কাজ। একেবারে হক কথা। কিন্তু ভোটের সময় হক কথা কি কইতে আছে? ফলে এ নিয়ে মথুরায় খুব আলোড়ন। তিনি রোজ প্রচারে বেরোচ্ছেন মার্সিডিজ বেঞ্জ কিংবা বিএমডব্লিউ চেপে। গাড়ির ‘সান টপ’ খুলে উঠে দাঁড়ানোমাত্র একটা ছেলে ফট করে মাথায় ছাতা মেলে ধরছে। হেমার চোখে রোদচশমা, হাতে থার্মোকলের পদ্মফুল, মুখে ভুবন ভোলানো হাসি। কোথাও কোথাও বড়জোর দু–চারটি বাক্য। তারপর ফের ঠান্ডা গাড়ির অভ্যন্তর। গতবার মোদির হাওয়া ছিল। এবার হাওয়াহীন গুমোট। সেই সঙ্গে জোটবদ্ধ তেজীয়ান বিরোধী। হেমা মালিনী তাই নিশ্চিন্তে নেই।

হেমার নিশ্চিন্তি দুই পুরুষ। প্রথমজন নরেন্দ্র মোদি। গতবার তাঁর নামে প্লাবন বয়েছে, এবারের ভোটও তাঁরই নামে। নইলে বাংলা নববর্ষের দিন গমনা গ্রামের এক জটলা সমস্বরে ‘মোদি মোদি’ করে উঠত না। সেই জটলায় ঠাকুর পঙ্কজ, জাট চন্দ্রপাল, বানিয়া সুশীল এবং অনগ্রসর বাঘেল সম্প্রদায়ের জীবনলালেরা এক সুরে বললেন, ভোট তাঁরা হেমাকে দেবেন না, দেবেন মোদিকে। মথুরার এই সুর বৃন্দাবনেও। বিধবা পল্লিগুলোয়। বিরোধী জোট প্রার্থী জাট নরেন্দ্র অথবা কংগ্রেসের ব্রাহ্মণ প্রার্থী মহেশ পাঠককে অশ্রদ্ধা না করেও জনতার প্রশ্নটা মৌলিক। ‘মানছি, মোদি পাঁচ বছরে আহামরি কিছু করেননি। কিন্তু তাঁর বদলে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন বলতে পারেন? এটা তো প্রধানমন্ত্রী বাছার ভোট?’ এই বিকল্পহীনতাই হেমা মালিনীর বড় সহায়।

নরেন্দ্র মোদির মতোই হেমার আর এক নিশ্চিন্তির নাম ধর্মেন্দ্র। শেষ বেলার প্রচারে স্বামী ধর্মেন্দ্রই তাই মুশকিল আসানের ভূমিকায়।

ধর্মেন্দ্রকে দুদিন ধরে মথুরায় আগলে রাখার দায় হেমারই। এই গরমে দুদিন ধরে তাঁকে নিয়ে রোড শো করিয়ে ও ভাষণ দেওয়ানোর মধ্য দিয়ে হেমা মালিনী জাট ভোট বিভাজন রোখার চেষ্টা করে গেলেন। প্রতিপক্ষ জোট প্রার্থী জাট নরেন্দ্র থেকে জাট মন ফেরাতে প্রচারে ধর্মেন্দ্র তুলে ধরলেন তাঁর নিখাদ ‘জাট’ চাষী চরিত্র।

একটা নমুনা দিই। ‘ফিল্মে আমি ধর্মেন্দ্র। কিন্তু আসলে আমি চৌধুরী ধর্মেন্দ্র সিং। জাতে জাঠ, কর্মে চাষি। এই আপনাদের মতো আমিও খেতি করেছি। খেতের মধ্যে গাছের ছায়ায় বসে খেয়েছি দুপুরের খানা। হাতে করে গরু–মোষকে চারা খাইয়েছি।’

ব্রজবাসীদের ‘শোলে’ সিনেমার সেই বিখ্যাত ডায়ালগ মনে করিয়ে দিয়ে ৮৪ বছরের ‘যুবক’ ধর্মেন্দ্র বলেছেন, ‘গাঁওবালো, আমার বাসন্তীকে না জেতালে আমি কিন্তু এই মথুরার পানির ট্যাংকে চড়ে বসব। আর, জেতালে? বাসন্তীর (শোলের হেমার চরিত্র) সঙ্গে মথুরায় এসে আমার সব হিট ফিল্মের ডায়ালগ শোনাব।’