ধুবড়ির আতর সাম্রাজ্যে ব্যাপারীর থাবা

আসামের ধুবড়ি শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা ব্রহ্মপুত্র নদ। ছবি: প্রথম আলো
আসামের ধুবড়ি শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা ব্রহ্মপুত্র নদ। ছবি: প্রথম আলো

আসামের রাজধানী গুয়াহাটিতে দলের রাজ্য কার্যালয়ে একান্তে পাওয়া গেল রাজ্য বিজেপির সভাপতি রঞ্জিত দাসকে। প্রশ্ন করা হয়, রাজ্যের ১৪টির মধ্যে কটি আসন পাবেন? জবাব দিতে দেরি করেননি। বললেন, ‘লিখে নিন ১৩টি। ১৪টিই পেতাম। কিন্তু ...!’ 

এই ‘কিন্তু’র ব্যাখ্যা অনেক। বিজেপি বা তাঁদের জোট শরিক অসম গণপরিষদ (অগপ) শিবিরে কান পাতলেই শোনা যায় এই ‘কিন্তু’র হরেক কারণ। আসনটি নিয়েও প্রশ্ন করা বোকামি। কারণ আসামের প্রায় সবাই জানেন, কোন আসনটি পাচ্ছে না বিজেপি। আসনটির নাম ধুবড়ি।
গুয়াহাটি থেকে ঝা-চকচকে রাস্তা ধরে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার পথ গেলে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তবর্তী জেলা সদর ধুবড়ি। লোকসভা আসনটির নামও শহরের নামেই। এই আসনটি খরচের খাতায় রেখে দিয়েছে বিজেপি। অবশ্য তারা নিজেরা লড়ছেও না। আসনটি ছেড়ে দিয়েছে শরিক দল অগপকে। লড়াই হচ্ছে তালাচাবি বনাম হাত। হাত কংগ্রেসের প্রতীক। আর তালাচাবি আঞ্চলিক দল এআইইউডিএফের। পরপর দুবার তালাচাবি এই আসন থেকেই জিতেছে। জিতেছেন দলের প্রধান, আতর দুনিয়ার বাদশা বদরুদ্দিন আজমল। এবার অবশ্য আতরের বদলে অন্য গন্ধ পেতে শুরু করেছেন সাবেক এই কংগ্রেসি নেতা।
কৃষিপ্রধান ধুবড়ি। ধুবড়ি লোকসভা কেন্দ্রে আজমলকে এবার শক্ত চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন কংগ্রেসের আবু তাহের ব্যাপারী। গত দুবারের বিধায়ক তিনি। তরমুজের খেতকে পাশ কাটিয়ে গুয়াহাটি থেকে ধুবড়ি শহরে আসার পথে শুধু হাত আর তালাচাবির দাপট। অগপর প্রতীক হাতি আছে। তবে সংখ্যায় খুব কম।

পুরো ভারতে ভারতের মোট ১৫টি লোকসভা কেন্দ্রে মুসলিমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। অর্থাৎ ৫০ শতাংশেরও বেশি মুসলিম ভোটার। ধুবড়ি সেই ১৫টির একটি। নয়টি শহর আছে ধুবড়িতে। ছয়টিতে অবশ্য হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। ধুবড়ি সদরেও তা-ই। ব্রহ্মপুত্র পারে ধুবড়ি শহরে ২০১১-র আদমশুমারি অনুযায়ী হিন্দু ৬৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ। তবে গোটা জেলায় হিন্দু ১৯ দশমিক ৪২ শতাংশ। মুসলিম ৭৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ। তাও আট বছর আগের হিসাব। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, এখন মুসলিমদের সংখ্যা আরও বেড়ে গেছে। স্থানীয় সাংবাদিক পারভেজ সুলতান জানান, ধুবড়ির মোট ভোটার ১৭ লাখ। এর মধ্যে ৬ লাখ হিন্দু। এই ৬ লাখের মধ্যে আবার ৩ লাখ বাঙালি হিন্দু। বাকি সবই মুসলিম ভোটার। পারভেজ নিশ্চিত, মুসলিমদের বড় অংশই ভোট দেবে না বিজেপি জোটকে।

আসামের মুখ্যমন্ত্রী তথা বিজেপি নেতা সর্বানন্দ সোনোয়াল অবশ্য ‘আল্লা’র নামে ভোট চেয়ে মুসলিমদের উন্নয়নে তাঁর সরকারের গুণকীর্তন করে গেছেন। কিন্তু তাতে খুব একটা কাজ হবে বলে মনে হচ্ছে না। অগপর জাভেদ ইসলাম জিততে পারেন, এই গুঞ্জনটাও নেই ধুবড়িতে। তৃণমূলপ্রধান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার সীমান্তবর্তী আসনটিতে এসে সভা করেছেন। কোচ-রাজবংশীদের ভোটের কথা মাথায় রেখে তৃণমূলও প্রচার চালাচ্ছে। কিন্তু ঘাসফুলের প্রার্থী নুরুল হুসেন চৌধুরির লড়াই এখন জামানত রক্ষা করার, বলছেন ধুবড়ির মানুষ।

ভোটের প্রচারে এসেছিলেন বিরোধী দলনেতা তথা কংগ্রেস নেতা দেবব্রত শইকিয়া। ব্রহ্মপুত্র পারে দাঁড়িয়ে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘লিখে নিন, কংগ্রেসই জিতছে। কারণ মুসলিমরা বুঝে গিয়েছেন, বদরুদ্দিন আসলে বিজেপির লোক। মানুষের আস্থা ফিরে এসেছে কংগ্রেসের ওপর।’ অগপর জাভেদ অবশ্য কংগ্রেসের সঙ্গে এআইইউডিএফের গোপন আঁতাতের অভিযোগ করছেন। কিন্তু মানতে নারাজ দেবব্রত। তাঁর দাবি, মুসলিমদের স্বার্থ বিজেপির কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন আজমল। তাই তাঁরা আজমলকে আসামের রাজনীতি থেকে উৎখাত করতে চান।

চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট ৭০ বছরের বৃদ্ধের। সাদা দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বোলাতে কংগ্রেসের প্রতি নিজের অভিমান উগরে দিচ্ছেন। নিজেকে প্রকৃত বিজেপিবিরোধী বলেই দাবি করে আজমলের দাবি, তিনি এখনো ইউপিএ-তেই আছেন। তাই শুধু জেতা তিনটি আসনেই প্রার্থী দিয়েছেন। তবু কংগ্রেস ‘বেইমানি’ করছে। অভিযোগ আজমলের। আর কংগ্রেস পাল্টা বলছে, ‘ধুবড়ি বা আসামের মুসলিমদের সঙ্গেই বেইমানি করেছেন আজমল। তাঁর শাস্তি তিনি এবার পাবেনই।’

ধুবড়ি পুলিশ সুপারের কার্যালয়। ছবি: প্রথম আলো
ধুবড়ি পুলিশ সুপারের কার্যালয়। ছবি: প্রথম আলো

কাল মঙ্গলবার আসামে তৃতীয় তথা শেষ দফায় লোকসভার ভোট। গণনা ২৩ মে। সেদিনই জানা যাবে ধুবড়ি কাকে ‘বেইমান’ ভাবছে। আপাতত বিজেপিবিরোধী দুই শিবির নিজেদেরই প্রকৃত ‘মুসলিমদরদি’ প্রমাণে ব্যস্ত। ক্যাব (নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল), এনআরসি (নাগরিক নিবন্ধন) থেকে শুরু করে পাকিস্তানে সার্জিকাল স্ট্রাইক, অনুপ্রবেশ, এমনকি ফি বছর ব্রহ্মপুত্রের বন্যা—ভোটের প্রচারে সবই ছিল ধুবড়িতে। কিন্তু মূল ইস্যুই হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘বেইমানি’। ভোটটাই তাই হয়ে দাঁড়িয়েছে কার্যত বেইমানি আর ইমানদারির। এই লড়াইয়ের মাঝে কিন্তু নাগরিকত্ব প্রমাণে ভিড় বাড়ছে বিদেশি ট্রাইব্যুনালে।