সম্রাট আকিহিতোর তিন দশক কেমন গেল?

সম্রাট আকিহিতো ও সম্রাজ্ঞী মিচিকো । ছবি: রয়টার্স
সম্রাট আকিহিতো ও সম্রাজ্ঞী মিচিকো । ছবি: রয়টার্স

জাপানের সম্রাট আকিহিতোর রাজত্বের আজ শেষ দিন। জাপানের ইতিহাসে ২০০ বছরের মধ্যে এই প্রথম একজন সম্রাট সিংহাসন ত্যাগ করতে যাচ্ছেন। দিনটি জাপানিদের জন্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।

২০১৬ সালে জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভিডিওবার্তায় সম্রাট আকিহিতো তাঁর এই ইচ্ছার কথা দেশবাসীর সামনে তুলে ধরেছিলেন। তখন আকিহিতো বলেছিলেন, তিনি উদ্বিগ্ন, বয়স হয়ে যাওয়ায় ভবিষ্যতে তিনি হয়তো আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হবেন না।

একই বছর অসুস্থতার কারণে সম্রাট আকিহিতো হাসপাতালে শয্যাশায়ী ছিলেন। তখন তাঁর মনে হয়েছিল, সিংহাসন ছেড়ে বিশ্রাম নেওয়ার সময় সামনে উপস্থিত হয়েছে।

তবে সম্রাট রাজত্ব ছেড়ে দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও জাপানে সহজে তা পূরণ হওয়ার নয়। কেননা, সাংবিধানিক ধারার পাশাপাশি সম্রাটের পরিবারের দেখভাল করার দায়িত্বে নিয়োজিত ইম্পিরিয়াল হাউসহোল্ড এজেন্সিসংক্রান্ত আইনে পরিষ্কার উল্লেখ আছে, সম্রাটের দায়িত্ব পালনের মেয়াদ আজীবন। ফলে, সম্রাটের ইচ্ছা পূরণ করে নিতে জাপানের সংসদ ও সরকারকে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে হয়। এ ক্ষেত্রে প্রধান বিবেচ্য বিষয়—সিংহাসন ত্যাগ করার পর সম্রাটের অবস্থান কী হবে, তা ঠিক করে নেওয়া।

জাপানে ১৮১৭ সালে সবশেষ সম্রাটের সিংহাসন ত্যাগের ঘটনা ঘটে। তখন জাপানে সাংবিধানিক কাঠামোভিত্তিক শাসনব্যবস্থা ছিল না। শোগুন সমরনায়কদের আধিপত্যের সামনে সম্রাটের হাতে ন্যস্ত প্রকৃত ক্ষমতা ছিল খুবই সীমিত। ফলে, সিংহাসন ত্যাগের পর সম্রাটের জীবন অনেকটাই নির্ভরশীল ছিল শোগুন প্রশাসনের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর। তবে এখন তো আর সেই দিন নেই।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোয় নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র জাপানে চালু থাকায় সম্রাটের সিংহাসন ত্যাগের সঙ্গে জড়িত সমস্যা নিয়ে আগে সেভাবে চিন্তাভাবনা করা হয়নি। সম্রাট আকিহিতোর জন্য অবসরে যাওয়ার সুযোগ করে দিতে নতুন কিছু আইন জাপানের সংসদকে কার্যকর করতে হয়, যে প্রক্রিয়া ছিল কিছুটা সময়সাপেক্ষ। এসব আইনগত দিকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটি হলো সিংহাসন ত্যাগের পর সম্রাট ও সম্রাজ্ঞীর অবস্থান ঠিক কী হবে, তা নির্ধারণ করা। সংশোধিত আইনে ইমেরিটাস সম্রাট ও ইমেরিটাস সম্রাজ্ঞী নামের দুটি পদ সৃষ্টি করে নেওয়া হয়েছে। সম্রাট আকিহিতো ও সম্রাজ্ঞী মিচিকো ১ মে থেকে জাপানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এই পদের অধিকারী হবেন।

গ্র্যান্ড চেম্বারলিন বা সম্রাটের পরিবারের প্রধান তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব হচ্ছে সম্রাটের দৈনন্দিন দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সম্পর্কিত সব রকম বিষয়ের ব্যবস্থা করে দেওয়া। সাধারণত সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তাকে এই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ইমেরিটাস সম্রাটের জন্যও সে রকম একটি পদ তৈরি করে নিতে হয়েছে। সম্রাট আকিহিতোর সুবিধা-অসুবিধার কথা বিবেচনা করে শিনজো আবের নেতৃত্বাধীন সরকার গ্র্যান্ড চেম্বারলিনের দায়িত্ব পালনরত কর্মকর্তা চিকাও কাওয়াইকে নতুন সেই পদে নিয়োগ দিয়েছে। একই সঙ্গে যুবরাজ নারুহিতো সিংহাসনে আসীন হলে ১ মে থেকে আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব পালনে নতুন সম্রাটকে সহযোগিতা করতে ইউরোপীয় ইউনিয়নে জাপানের সাবেক রাষ্ট্রদূত নবুতাকে ওদানোকে নতুন গ্র্যান্ড চেম্বারলিন নিয়োগ করা হয়েছে।

এপ্রিল মাসের শুরু থেকে সিংহাসন ত্যাগের সঙ্গে জড়িত মোট ১১টি আনুষ্ঠানিকতা সম্রাট ও সম্রাজ্ঞীকে সেরে নিতে হয়েছে। এসব আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে প্রধান দুটি ছিল টোকিওর শহরতলিতে প্রয়াত পিতা সম্রাট হিরোহিতোর সমাধিতে গিয়ে নিজের সিংহাসন ত্যাগ সম্পর্কে অবগত করা ও মিয়ে জেলার ইসে মন্দির ভ্রমণ। ইসে শিন্তো মন্দিরকে শিন্তো ধর্মাবলম্বীদের জন্য সবচেয়ে পবিত্র মন্দির হিসেবে গণ্য করা হয়। জাপানের কিংবদন্তিতে উল্লেখ আছে, সূর্যদেবী আমাতেরাসু ওমিকামি আড়াই হাজার বছর আগে সম্রাটের পরিবারের প্রথম পুরুষকে মর্ত্যে পাঠিয়ে দেওয়ার সময় রাজক্ষমতার যে তিনটি প্রতীক সঙ্গে দিয়েছিলেন, আজ পর্যন্ত সেগুলো দেশের তিনটি পবিত্র স্থানে সংরক্ষিত আছে। আয়না বা দর্পণটি রাখা আছে টোকিওতে সম্রাটের প্রাসাদের ভেতরের মন্দিরে। তরবারি আছে মিয়ে জেলার অন্য একটি মন্দিরে। অলংকারের সংরক্ষণ স্থান হচ্ছে ইসে মন্দির। সাধারণত, নতুন সম্রাটের অভিষেকের সময় সেই তিন পবিত্র প্রতীক ইসে মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়। এবার অবশ্য সিংহাসন ত্যাগের সূত্রে সম্রাট আকিহিতো ও সম্রাজ্ঞী মিচিকো বাইরে সংরক্ষিত দুটি প্রতীক সঙ্গে নিয়ে যান। ইসে মন্দিরে সেগুলো একত্র হয়।

ইসে মন্দির ভ্রমণ থেকে ফিরে বাকি কয়েকটি দিন পরিবারের সঙ্গে একান্তে কাটিয়ে ৩০ এপ্রিল শেষ ভাষণ দেওয়ার প্রস্তুতি সম্রাট আকিহিতো এখন নিচ্ছেন। সেই ভাষণের মধ্যে দিয়ে তিনি শেষ করবেন তাঁর তিন দশকের দায়িত্ব পালন। জাপানে সমাপ্তি হবে গৌরবময় একটি অধ্যায়ের।

কেমন ছিল সম্রাট আকিহিতোর তিন দশকের রাজত্বকাল? প্রশ্নের উত্তর সম্রাটের নিজের একটি বক্তব্যের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া সম্ভব। গত বছরের শেষ দিকে শেষবারের মতো সাংবাদিকদের সামনে উপস্থিত হয়ে তিনি বলেছিলেন, যুদ্ধের প্রভাবমুক্ত শান্তিপূর্ণ পরিবেশে দায়িত্ব পালন শেষ করতে পেরে তৃপ্তি অনুভব করছেন তিনি।

এটা ঠিক যে গত তিন দশকে সম্রাট আকিহিতো সিংহাসনে আসীন থাকা অবস্থায় জাপানকে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হয়নি। যুদ্ধ পরিহার করা দেশের সংবিধান এই ক্ষেত্রে বড় অবদান রাখতে পেরেছে। সম্রাট তাঁর কোনো ভাষণেই সংবিধানের প্রসঙ্গ সরাসরি উল্লেখ না করলেও পরোক্ষে রাজনীতিবিদদের কাছে সেই বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন যে রাজনীতিবিদেরা জাপানকে বারবার যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা থেকে বিরত থাকেননি।

সম্রাট আকিহিতোর রাজত্বকালেই মার্কিন বাহিনীর যুদ্ধপ্রচেষ্টায় সহায়তা করার জন্য ইরাকে সৈন্য পাঠানো থেকে জাপান বিরত থাকেনি। সংবিধানে যুদ্ধ পরিহারের ধারাকে কীভাবে পাশ কাটানো যায়, সেই চেষ্টাও জাপানের রাজনীতিবিদেরা করে গেছেন। তবে তারপরও সরাসরি কোনো যুদ্ধে জাপানকে জড়িত হতে হয়নি। সেদিক থেকে সম্রাট আকিহিতোর রাজত্বকালের হেইসেই নামকরণকে সার্থক বলতে হয়। হেইসেইয়ের অর্থ হচ্ছে শান্তি অর্জন। ফলে সম্রাট যখন বলেন, যুদ্ধ এড়িয়ে যেতে পারার জন্য তৃপ্তির বোধ নিয়ে দায়িত্ব পালন তিনি শেষ করছেন, তখন ধরে নিতে হয়, কালের নামকরণের সার্থকতাকেই তিনি তুলে ধরছেন।

সম্রাট আকিহিতোকে জাপানের নাগরিকেরা মনে রাখবে নাগরিক জীবনের কাছে নেমে আসা এক সম্রাট হিসেবে। দেশের যেকোনো দুর্যোগে সম্রাটের পরিবারকে সব সময় দেখা গেছে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ছুটে গিয়ে সাধারণ লোকজনকে সান্ত্বনা দিতে। দেশের নাগরিকদের জন্য এটা অবশ্যই বড় এক প্রাপ্তি যে ঐতিহ্য এখন তাঁর পুত্র অব্যাহত রাখবেন।

আজ সম্রাট আকিহিতোর সিংহাসন ত্যাগের ঠিক পরপর শুরু হতে যাওয়া নতুন কিছু আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে দিয়ে এক দিন পর সিংহাসনে আরোহণ করবেন যুবরাজ নারুহিতো। বিকেল পাঁচটায় সম্রাটের প্রাসাদে নির্ধারিত সিংহাসন ত্যাগের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন ৩০০ জনের মতো বিশিষ্ট অতিথি। প্রধানমন্ত্রী আবে সিংহাসন ত্যাগের ঘোষণা দেওয়ার পর শেষবারের মতো সম্রাট সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেবেন।

পরদিন সকাল সাড়ে ১০টায় নির্ধারিত ভিন্ন এক অনুষ্ঠানে যুবরাজ নারুহিতোর সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হওয়ার প্রমাণ হিসেবে নতুন সম্রাটের সামনে রাখা টেবিলে গ্র্যান্ড চেম্বারলিন সূর্যদেবীর কাছ থেকে পাওয়া তিনটি মহামূল্য সম্পদের মধ্যে দুটি—তরবারি ও অলংকার এবং সেই সঙ্গে সাম্রাজ্যের সিলমোহর একে একে স্থাপন করবেন। এর মধ্যে দিয়ে শেষ হবে যুবরাজ নারুহিতোর বৈধ উত্তরাধিকারী হওয়ার আনুষ্ঠানিকতা। সম্রাটের পরিবারের পুরুষ সদস্যদের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার সদস্যসহ সরকারের তিনটি শাখার প্রতিনিধিরা ছোট আকারের সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন। প্রথাগতভাবে এই অনুষ্ঠান সম্রাটের পরিবারের নারী সদস্যদের উপস্থিত থাকার অনুমতি দেয় না। তাই এবারও তাঁরা অনুপস্থিত থাকবেন। তবে এবারের আয়োজনের একটি ব্যতিক্রম হবে মন্ত্রিসভার নারী সদস্য সাৎসুকি কাতাইয়ামার অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া। আর এর মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে উঠবেন আধুনিক জাপানের ইতিহাসে সম্রাটের আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব গ্রহণের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া প্রথম নারী।

আগামী ৪ মে নতুন সম্রাট ও সম্রাজ্ঞী প্রথমবারের মতো সমবেত শুভাকাঙ্ক্ষীদের ধন্যবাদ জানাতে সম্রাটের প্রাসাদের বারান্দায় উপস্থিত হবেন। সকাল ১০টা থেকে শুরু করে মোট ছয়বার তাঁরা সেখানে উপস্থিত হয়ে সমবেত দর্শকদের উদ্দেশে হাত নেড়ে কৃতজ্ঞতা জানাবেন। এর মধ্যে দিয়ে শেষ হবে আনুষ্ঠানিকতার প্রথম পর্যায়। আগামী ২২ অক্টোবর নির্ধারিত অভিষেক অনুষ্ঠানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের উপস্থিতিতে জাপানের নতুন সম্রাট নারুহিতো বিশ্ববাসীর সামনে নিজের উপস্থিতির ঘোষণা দেবেন।