অর্থনীতি চনমনে, রাজনীতি টগবগে

বুথ-ফেরত সমীক্ষা বা ‘এক্সিট পোল’-এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে যত সংশয়ই থাকুক, এই জরিপ ভারতের রাজনীতি ও অর্থনীতিকে চনমনে করে তুলেছে। গত রোববার সন্ধ্যায় বুথ-ফেরত সমীক্ষা বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএকে আরও একবার ক্ষমতায় বসানোর ইঙ্গিত দেওয়ামাত্র দেশের অর্থবাজার উজ্জীবিত হয়ে উঠেছে। গতকাল বাজার খোলার সামান্য কিছু সময়ের মধ্যে ডলারের তুলনায় রুপির বিনিময় মূল্য ৭০ পয়সার বেশি বেড়েছে।

বুথ-ফেরত সমীক্ষা অর্থনীতির পাশাপাশি রাজনীতিকেও টগবগে করে তুলেছে। প্রকৃত ফল বেরোনোর দুদিন বাকি থাকলেও মধ্যপ্রদেশের কংগ্রেস সরকারকে ফেলে দিতে বিজেপি তৎপর হয়ে উঠেছে। রাজ্যের বিরোধী নেতা গোপাল ভার্গব রাজ্যপাল আনন্দিবেন প্যাটেলকে চিঠি লিখে জানিয়েছেন, সরকার তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে। তাই দ্রুত বিধানসভা ডেকে সরকারকে গরিষ্ঠতার প্রমাণ দিতে বলা হোক। মধ্যপ্রদেশ বিধানসভার মোট আসনসংখ্যা ২৩০। গত বছরের ভোটে কংগ্রেস জেতে ১১৪ আসন। সরকার গড়তে প্রয়োজন ১১৬ সদস্যের সমর্থন। বহুজন সমাজ পার্টির দুই এবং সমাজবাদী পার্টির একজন সদস্য কংগ্রেসকে সমর্থন দিচ্ছেন। অর্থাৎ সরকারের ভাগ্য ঝুলে রয়েছে এক সুতোয়।

সমীক্ষা অনুযায়ী নরেন্দ্র মোদি আরও একবার প্রধানমন্ত্রী হলে কর্ণাটক সরকারের স্থিতিশীলতাও প্রশ্নের মুখে পড়বে। ওই রাজ্যে একক গরিষ্ঠ দল বিজেপি হলেও ধর্মনিরপেক্ষ জনতা দলকে মুখ্যমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিয়ে কংগ্রেস সরকার গড়েছে। কিন্তু জোট নিয়ে দুই দলেই বিস্তর সমস্যা। এক্সিট পোল সত্যি হলে এটাই স্পষ্ট হবে, দুই দল জোটবদ্ধ হয়েও বিজেপির মোকাবিলায় ব্যর্থ।

আপাতত দুই শিবিরই ২৩ মের প্রকৃত ফলের অপেক্ষায়। ফল বেরোনোর দিনই বিজেপির শীর্ষ নেতারা বৈঠকে বসবেন ঠিক করেছেন। তার আগে আজ মঙ্গলবার সব শরিক দলের নেতাকে নৈশভোজে আপ্যায়ন করছেন বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ। বিরোধী শিবিরও তৎপর। তেলেগু দেশম নেতা চন্দ্রবাবু নাইডু তিন দিন ধরে বিরোধী শিবিরের বড় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সোমবার তিনি কলকাতা যান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলতে। রোববার জানা গিয়েছিল, বহুজন নেত্রী সোমবার দিল্লি এসে সোনিয়া-রাহুলের সঙ্গে বৈঠক করবেন। তবে সোমবার তাঁর দলের পক্ষে জানানো হয়, এমন কোনো কর্মসূচি আপাতত নেই। আজ বিরোধী নেতারা দল বেঁধে নির্বাচন কমিশনে যাচ্ছেন ইভিএম নিরাপদ রাখা ও কারচুপি হতে না দেওয়ার দাবিতে।

বুথ-ফেরত সমীক্ষায় উৎফুল্ল শাসক দল বিজেপি। বিভিন্ন নেতা ইতিমধ্যেই বলতে শুরু করেছেন, এই ভোট ছিল মোদি সরকারের পক্ষে। বিরোধী মহল ভোটের ফলে বিস্মিত। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইতিমধ্যেই বলেছেন, অর্থবাজারকে চাঙা করা এবং ইভিএমে কারচুপি করতেই এই ফল দেখানো হয়েছে। কংগ্রেস এবং অন্য বিরোধী নেতারাও বুথ-ফেরত সমীক্ষার ফল নস্যাৎ করেছেন। সমীক্ষার কার্যকারিতা নিয়েই তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন।

প্রশ্ন হলো, এক্সিট পোল কতটা ঠিক হয়, কতটাই-বা ভুল। যে পদ্ধতিতে এই সমীক্ষা চালানো হয়, তা কতটা বিশ্বাসযোগ্য ও কার্যকর, তা নিয়েও বারবার প্রশ্ন উঠেছে। এবারও সেই প্রশ্ন প্রবলভাবে উঠে এল।

এ ধরনের বিজ্ঞানভিত্তিক সমীক্ষার জনক জর্জ গ্যালপ। জনমত সমীক্ষক হিসেবে তাঁর প্রথম সাফল্য ১৯৩৬ সালে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় তিনি সবাইকে অবাক করে দিয়ে জানিয়েছিলেন, ভোটে জিতবেন ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট। রুজভেল্টের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আলফ্রেড ল্যান্ডন। তখনো পর্যন্ত সমীক্ষকেরা সাধারণত টেলিফোন গাইড ঘেঁটে এবং গাড়ির মালিকদের তালিকা নিয়ে ফোন করে জানতে চাইতেন নেতা হিসেবে কাকে তাঁরা পছন্দ করছেন। গ্যালপ প্রথম বিজ্ঞানভিত্তিক সমীক্ষা শুরু করেন। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জর্জরিত মানুষদের চাহিদা, তাদের আর্থসামাজিক অবস্থানকে গুরুত্ব দিলেন। বিভিন্ন শ্রেণির এই মানুষদের মনোভাবকে গুরুত্ব দিয়ে গ্যালপ নির্দিষ্টভাবে জানিয়ে দেন, রুজভেল্টই দায়িত্ব পেতে চলেছেন। তাঁর সেই ঘোষণা সবাইকে অবাক করলেও সেটাই হয়েছিল ঠিক।

জনমত সমীক্ষার নবতম রূপ এক্সিট পোল। ভোটের আগে মানুষের মন বোঝার তুলনায় ভোটের পর মনোভাব জানা সহজতর বলে দিন দিন ভারতে বুথ-ফেরত সমীক্ষা ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু কোন সংস্থা কত মানুষকে ‘স্যাম্পল’ হিসেবে ব্যবহার করছে এবং কোন মডেলে সমীক্ষা করছে, তা সাধারণত জানাতে চায় না। এর ফলে সমীক্ষা কতটা নির্ভুল হচ্ছে, তা বোঝার উপায় থাকে না। তা ছাড়া সামাজিক বিন্যাস, অর্থনৈতিক অসাম্য, গ্রাম ও শহরের প্রভেদ, পুরুষ ও নারীর ভিন্ন রকমের চাহিদা, নীরব ভোটার এবং অসত্য তথ্য দেওয়া সমীক্ষকদের ‘মেথড’কে প্রায়শই ভুল প্রতিপন্ন করে। ২০০৪ সালে অটল বিহারি বাজপেয়ির সরকার যে দ্বিতীয়বার সুযোগ পাবে না, সেই আন্দাজ কোনো সমীক্ষক সংস্থাই ধরতে পারেনি। বরং তাঁর সরকারের প্রকল্পগুলো, যা কিনা ‘ইন্ডিয়া শাইনিং’ বলে পরিচিতি লাভ করে, তাঁকে আরও একবার ক্ষমতাসীন করবে, এই ধারণা সবাই ছড়িয়ে দেয়। ভোটের ফল বেরোলে দেখা যায় কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জিতেছে। পাঁচ বছর পর ২০০৯ সালে সবাই যখন ইউপিএ সরকারের অবসানের ছবি এঁকে দিয়েছে, তখন দেখা যায় মনমোহন সিংয়ের ওপর মানুষ আরও একবার আস্থা রেখেছেন। ২০১৪ সালে জনমত সমীক্ষা ও বুথ-ফেরত ফল আবার নির্ভুল হয়। কিন্তু বিজেপি যে ২৮২ আসন পেয়ে একক ক্ষমতায় সরকার গড়ার মতো অবস্থায় আসবে এবং কংগ্রেস যে হাফ সেঞ্চুরিও করতে পারবে না, নির্দিষ্ট করে কেউ তা জানাতে পারেনি।

জর্জ গ্যালপ যদি আধুনিক জনমত সমীক্ষার জনক হন, এক্সিট পোলের জনক কে, নেদারল্যান্ডসের সমাজতত্ত্ববিদ মারসেল ভ্যান ড্যাম, না যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ারেন মিটোফস্কি, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। দুজনেই ১৯৬৭ সালে নিজের দেশের নির্বাচনে তাঁদের মতো করে এক্সিট পোল চালু করেছিলেন।

শুধু ভারতই নয়, বিশ্বের অন্যত্রও বহুবার এক্সিট পোল ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ১৯৯২ সালে ব্রিটেনের সাধারণ নির্বাচনের পর দুটো সংস্থার বুথ-ফেরত সমীক্ষা প্রধানমন্ত্রী জন মেজরকে হারিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু ফল বেরোলে দেখা যায়, হাউস অব কমনসে সদস্যসংখ্যা কমলেও কনজারভেটিভ পার্টিকে তিনি জয়ী করেছেন। ২০১৬ সালে অস্ট্রিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও বুথ-ফেরত সমীক্ষার ফল ভুল প্রমাণিত হয়েছে। একেবারে হালে অস্ট্রেলিয়ায় এক্সিট পোলকে ভুল প্রমাণ করে জয়ী হন স্কট মরিসন।

ভারতে কী হবে—সেই জল্পনা চলবে আরও দুদিন। ভিন্ন ভিন্ন ‘স্যাম্পল সাইজ’, ভিন্ন ধরনের মডেল ও আর্থসামাজিক বিভিন্নতার দরুন কি না জানা নেই, রোববার যতগুলো সংস্থা ভারতের লোকসভা ভোটের বুথ-ফেরত সমীক্ষা প্রকাশ করেছে, তাদের মধ্যেও ফারাক বিস্তর। বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ আরও একবার সরকার গড়ছে, এই এক জায়গায় সবাই ঠিক। সব পরিষ্কার হবে ২৩ মে।