কী করতে চান, অমিত শাহ প্রথম দিনেই জানালেন

অমিত শাহ। ফাইল ছবি
অমিত শাহ। ফাইল ছবি

নরেন্দ্র মোদি মন্ত্রিসভার অধিকাংশ সদস্য গত শুক্রবার দায়িত্বভার গ্রহণ করলেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ নতুন দায়িত্ব নিলেন আজ শনিবার দুপুরে। সাদা পাঞ্জাবির ওপর হাল্কা নীল রংয়ের জ্যাকেট পরে ৫৪ বছরের এই ‘স্ট্রং ম্যান’ নর্থ ব্লকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আসেন আজ বারবেলা কাটিয়ে। তাঁকে স্বাগত জানান কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র সচিব রাজীব গৌবা ও অন্যান্য পদস্থ আমলারা।

অমিত শাহর সঙ্গেই আজ কাজে যোগ দিলেন তাঁরই দুই প্রতিমন্ত্রী তেলেঙ্গানার সেকেন্দ্রবাদ থেকে জয়ী জি কিষাণ রেড্ডি এবং বিহারের উজিয়ারপুর কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত নিত্যানন্দ রাই যাদব। দুজনেই অমিত শাহর অতি ঘনিষ্ঠ। সেই অর্থে একান্ত অনুগত ও বিশ্বস্তদের সঙ্গী করে অমিত শাহ শুরু করলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী হিসেবে তাঁর পথ চলা।

প্রথম দিনেই অমিত শাহ মন্ত্রণালয়ের আমলাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন ঠিক কী তিনি করতে চান। মন্ত্রণালয় সূত্রে খবর, আনুষ্ঠানিকতার পর পদস্থ কর্তাদের সঙ্গে প্রথম বৈঠকেই তিনি বলেন, দলের নির্বাচনী ইশতেহারে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংক্রান্ত যে যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া আছে, প্রতিটি অক্ষরে অক্ষরে তিনি পালন করবেন। বৈঠকে তিনি বলেন, দেশের নিরাপত্তা ও স্বার্থের সঙ্গে তাঁদের সরকার কোনোরকম আপস করবে না। তাঁরা প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকার পালন করবেন বলেই দেশের মানুষ তাঁদের প্রতি ভরসা রেখেছেন।

প্রথম বৈঠকে অমিত শাহর এই মন্তব্য নিয়ে ইতিমধ্যেই রাজনৈতিক জল্পনা শুরু হয়ে গেছে। জল্পনা প্রধানত চারটি বিষয়কে কেন্দ্র করে। ১) আসামের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ সহ অন্যত্র জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন তৈরি (এনআরসি)। ২) নাগরিকত্ব সংশোধন বিল পাশ করা। ৩) জম্মু–কাশ্মীরের জন্য বিশেষ সাংবিধানিক রক্ষাকবচ ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার এবং ৪) কাশ্মীরের জন্য ভারতীয় সংবিধানের ৩৫(ক) ধারা বাতিল। নির্বাচনী ইশতেহার, বিজেপি যাকে ২০১৯ সালের নির্বাচনের ‘সংকল্প পত্র’ বলেছে, তাতে এই চারটি বিষয় কার্যকর করার কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, অমিত শাহ জোর দিলেও এই প্রতিশ্রুতিগুলো কার্যকরের চেষ্টা আদৌ করা হবে নাকি প্রতিশ্রুতিগুলো নিতান্তই কাগজে–কলমে থেকে যাবে তা নিয়ে।

শুধু সংকল্প পত্রেই এই বিষয়গুলোর উল্লেখ করা নয়, নির্বাচনী প্রচারে নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ বারবার এই চার বিষয়ের উল্লেখ করেছেন। জম্মু–কাশ্মীরে উল্লেখ করেছেন ৩৭০ ও ৩৫(ক) ধারা বাতিলের, পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম সহ গোটা উত্তর–পূর্ব ভারতে বলেছেন জেতার পর সব রাজ্যে এনআরসি তৈরি করা হবে। পশ্চিমবঙ্গের আলিপুরদুয়ারে এবারের নির্বাচনী জনসভায় শাহ বলেন, ‘ক্ষমতায় এলে আমরা পশ্চিমবঙ্গেও এনআরসি চালু করব। সব অনুপ্রবেশকারীকে তাড়িয়ে বিদায় করব। তবে আমরা দেখব, হিন্দু শরণার্থীরা যেন নিরাপদ থাকেন।’ একাধিক জনসভায় তিনি ‘অনুপ্রবেশকারীদের’ তুলনা করেছিলেন ‘উইপোকা’র সঙ্গে। বলেছিলেন, ‘সবাইকে আমরা দেশ থেকে তাড়াব, কেননা, এদের জন্য প্রকৃত নাগরিকদের ভোগান্তির শেষ নেই।’

সংবিধানের ৩৭০ ধারা জম্মু–কাশ্মীরকে পৃথক মর্যাদা দিয়েছে। এই ধারা জম্মু–কাশ্মীরকে আলাদা পতাকা ও সংবিধান দিয়েছে। ‘দেশের একতা ও অখন্ডতার স্বার্থে’ এই ধারা প্রত্যাহারের দাবি সেই জনসংঘের আমল থেকেই। ৩৫(ক) ধারায় নির্ধারিত জম্মু–কাশ্মীরের প্রকৃত স্থায়ী নাগরিক কারা। ওই ধারায় প্রকৃত নাগরিক ছাড়া অন্য কারো ওই রাজ্যে জমি কেনার অধিকার নেই। বিজেপি মনে করে, এই ধারাও ওই রাজ্যের মানুষজনের স্বার্থ পরিপন্থী। জম্মু–কাশ্মীরের রাজনৈতিক দল পিডিপির সঙ্গে জোট বেঁধে কিছুদিন সরকার চালিয়েছিল বিজেপি। যতদিন তারা সরকারে ছিল ততদিন এই দুই বিষয়ের উপস্থাপনা তারা করেনি। এখন নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই বিষয়ে জোর দিলেও তা কতখানি কার্যকর হবে সে বিষয়ে প্রশ্ন উঠছে।
আসামে এনআরসি তৈরি করা হচ্ছে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে। ১৯৮৫ সালের আসাম চুক্তিতে এই নাগরিক নিবন্ধন তৈরির কথা ছিল। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতীয় রাজ্যগুলোয়, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে, বিজেপি এই নাগরিক নিবন্ধনকে বড় নির্বাচনী ইস্যু করে তুলেছে। একই সঙ্গে জোর দিয়েছে নাগরিকত্ব সংশোধন বিলের ওপর। এই সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে ‘অত্যাচারিত হয়ে চলে আসা অ–মুসলমান নাগরিকদের’ ভারতীয় নাগরিকত্ব দিতে চায় বিজেপি। এই বিষয়ে আপত্তি অধিকাংশ অ–বিজেপি দলের। অ–বিজেপি দলগুলো এ নিয়ে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বারবার বলেছে, এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নাগরিকদের হুমকির মুখে ফেলতে পারে। কিন্তু বিজেপি তাদের সিদ্ধান্তে অনড়।

এনআরসি ও নাগরিকত্ব বিল নিয়ে বাংলাদেশের ‘দুশ্চিন্তা’ দূর করতে সরকারের পক্ষ থেকে একাধিকবার বলা হয়েছে দুটিই ভারতের ‘অভ্যন্তরীণ’ সমস্যা। সরকারি এই বক্তব্য সত্ত্বেও দলগতভাবে বিজেপির শীর্ষ নেতারা বারবার ‘অ–নাগরিকদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ফেরত পাঠানোর’ কথা বলে চলছেন। অমিত শাহও বলেছেন। যদিও কোথায় ফেরত পাঠানো হবে তা বলা হচ্ছে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়ে প্রথম বৈঠকেই মন্ত্রণালয়ের কর্তাদের ‘সংকল্প পত্র’ কার্যকর করার কথা জোর দিয়ে বললেও কীভাবে ও কতটা সম্ভবপর সেই প্রশ্ন অতএব থেকেই যাচ্ছে।