পণ্যমূল্য নিয়ে ক্ষোভ বাড়ছে ইমরান খানের পাকিস্তানে

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নিয়ে ক্ষোভ বাড়ছে পাকিস্তানের সাধারণ জনগণের। ছবি: এএফপি ২.  প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইমরান খানের শপথ
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নিয়ে ক্ষোভ বাড়ছে পাকিস্তানের সাধারণ জনগণের। ছবি: এএফপি ২. প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইমরান খানের শপথ

ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিক এবং প্রধানমন্ত্রী হওয়া ইমরান খান পাকিস্তানে ক্ষমতাসীন হয়েছেন এক বছর হয়ে গেল। পাকিস্তানিদের অনেক স্বপ্নের কথা শুনিয়ে গত বছরের ২৫ জুলাই নির্বাচনে জয়লাভ করে তিনি প্রধানমন্ত্রী হন। এর মধ্যে এক বছর হয়ে গেছে। সাধারণ মানুষকে দেখানো সেই স্বপ্ন অপূর্ণই রয়ে গেছে। অর্থনৈতিক সংকটে জেরবার জনগণের ক্ষোভের মুখে এখন ইমরান খান সরকার।

রুপির মান কমে যাওয়া ও মূল্যস্ফীতির কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে হিমশিম খাচ্ছে পাকিস্তানের সাধারণ লোকজন।

ইমরান খান সরকারের বর্ষপূর্তির প্রাক্কালে বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের ২৫ জুলাই ভোটের আগে থেকেই পাকিস্তানে অর্থনৈতিক সংকট শুরু হয়। বিশ্লেষকেরা সতর্ক করেছিলেন এই বলে যে নতুন সরকারকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।

ক্ষমতার শুরুর দিকের এক বক্তৃতায় ইমরান খান জনগণকে আতঙ্কিত না হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। নির্বাচনী প্রচারাভিযানে তিনি দেশকে ইসলামি কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার আশ্বাস দিয়েছিলেন।

ইমরান খান ক্ষমতায় আসার পরপরই পাকিস্তানি মুদ্রা রুপির মূল্য ৩০ শতাংশ কমে যায়। মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ শতাংশ। ধারণা করা যাচ্ছে, এটা আরও বাড়বে।

শামা পারভিন (৩০) নামের এক নারী পণ্যমূল্য নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘টমেটোর দাম আকাশ ছুঁয়ে ফেলছে।’ সস্তা টমেটোর খোঁজে করাচির অসহ্য গরমে কয়েক কিলোমিটার হেঁটে বাজারে যান বলে তিনি জানান। বললেন, জীবন কঠিন হয়ে পড়েছে।

মেহেদি প্যাক বিক্রেতা মোহাম্মদ আশরাফ (৬০) বলেন, ‘আমার প্রতিদিনের খরচ জোগাতে কমপক্ষে এক হাজার রুপি আয় করা প্রয়োজন। আমি বড়জোর ৫০০ থেকে ৬০০ রুপি উপার্জন করতে পারি। মাঝেমধ্যে ভাবি, যদি অসুখে পড়ি, তাহলে চিকিৎসা ও ওষুধপথ্যের খরচ চালাব কী করে? মনে হয়, আমি মরে যাব।’

বিশ্লেষকেরা সতর্ক করেছেন, পাকিস্তানের জনসংখ্যা দ্রুতগতিতে বাড়ছে। এর হার কমাতে হবে। এ বছর জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ২ দশমিক ৪ শতাংশে নামাতে হবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সবশেষ ৬০০ কোটি ডলার ঋণ মঞ্জুর করলেও দেশটিতে স্বল্পমেয়াদি কোনো কার্যক্রম নেওয়া হয়নি। আইএমএফের সঙ্গে পাকিস্তানের সুসম্পর্ক রয়েছে। এর আগেও অনেকবার আইএমএফ সংকটের মুখে পাকিস্তানকে সহায়তা দিয়েছে। আইএমএফের দ্বারস্থ যাওয়ার আগে ইমরান খান চীন, সৌদি আরবসহ ‘বন্ধুদেশগুলোর’ কাছ থেকে শত কোটি ডলার ঋণ ও বিনিয়োগ নিশ্চিত করেছেন। কিন্তু এরপরও তা দেশটির জন্য যথেষ্ট নয়।

পাকিস্তানিরা দৃশ্যত অর্থনৈতিক চক্রের অন্তহীন করাল দর্শনে পড়েছে। কৃচ্ছ্রসাধনার দায় পড়েছে লাখ লাখ দরিদ্র মানুষের ওপর। গভীরে প্রোথিত কাঠামোগত সংস্কারের দাবি এখন অন্তঃসারশূন্যে পরিণত হয়েছে। এ মাসের শুরুতে ব্যবসায়ীরা এক দিনের ধর্মঘট পালন করেছেন। গত শুক্রবার দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে রাওয়ালপিন্ডি শহরের দিকে আট হাজার মানুষের পদযাত্রা কর্মসূচি পালিত হয়।

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইমরান খানের শপথ
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইমরান খানের শপথ

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস করা আয়াজ আহমেদ (৩২) নামের এক ব্যক্তি ইমরান খান সরকারের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এ সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ। দিনকে দিন তারা দেশকে আরও দরিদ্র বানাচ্ছে।

কাল বৃহস্পতিবার ইমরান খান সরকারের এক বছর পূর্তিতে বিরোধী দলগুলো গণসমাবেশের পরিকল্পনা করেছে।

করাচির মসলাবিক্রেতা নাসিম আখতার বলেন, ‘এক দিনও উপার্জন না করলে আমার চলে না।’

দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আসগর আলী। তিনি বলেন, ধারণা করা যাচ্ছে, আসছে দিনগুলোয় ৮০ লাখেরও বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করবে। সে ক্ষেত্রে এ সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের কথা তুলে ধরেন তিনি। এই অভিযানের মাধ্যমে বিরোধী নেতাদের জেলে ঢোকানো হচ্ছে এবং তাঁদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ‘হয়রানির শিকার’ হচ্ছে। এতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

এ ব্যাপারে দেশটির ইসলামি ব্যাংকিংবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান শাহিদ হাসান সিদ্দিকি বলেন, ‘১৯৯৮ সাল থেকেও এখন পরিস্থিতি খারাপ।’ ওই বছর পারমাণবিক পরীক্ষার কারণে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা থেকে রক্ষা পায় পাকিস্তান। তাঁর মতে, এখানে করও একটি ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পাকিস্তানি জনগণের মধ্যে মাত্র ১ শতাংশ কর দেন বলে ধারণা করা হয়। ইমরান খান সরকার করের আওতা বাড়াতে চাপ সৃষ্টি করে। কিন্তু সরকারি কর্মকর্তাদের নেওয়া নতুন স্কিমগুলোয় পরিস্থিতির খুব একটা পরিবর্তন আসেনি।

শাহিদ হাসান সিদ্দিকি বলেন, নতুন স্কিমের আওতায় ১ দশমিক ৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো অর্থ সাদা করার সুযোগ পাচ্ছেন ধনীরা। অথচ দরিদ্র মানুষদের প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে ১৭ শতাংশ বিক্রয় কর দিতে হয়।

তবে কর বিষয়ে বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ উমের ফারুকের মত হচ্ছে, এরপরও যেসব নীতি নেওয়া হয়েছে, তা ‘যথেষ্ট ভালো’। সরকারের জন্য সত্যিকারের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কীভাবে তারা তা বাস্তবায়ন করবে। তবে বাস্তবায়নের এই সময়ের মধ্যেই হতাশা বাড়ছে।

৩৫ বছর বয়সী মোহাম্মদ ইমরান নামের করাচির এক সবজিবিক্রেতা আক্ষেপ করে বললেন, তিনি আর ঋণ শোধ করতে পারছেন না। তিনি আরও বলেন, ‘আমার কী করা উচিত? একদিন হয়তো আমি আত্মহত্যাই করব।’